শুক্রবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৪

'দানে দানে তিন দান'


সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি এবং আরও অনেক দিন বেঁচে থাকলে নতুন করে বহুকিছু দেখবো। আমার ক্ষুদ্রতম জীবনকালের মধ্যে আমি যদি নিজের জীবনটাকে সংক্ষিপ্ত আকারে মাত্র তিনটি পর্বে আলাদা করি, তাহলে সেখানে চমকপ্রদ একটি ব্যাপার দেখতে পাই যে— আমার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক ভাবে এমন একটা অদ্ভুত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, যার দশ ভাগের একভাগ-ও গত একশো কিংবা এক হাজার বছরের মধ্যে ঘটেনি, তার আগের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রথম অংশে পৃথিবীকে আস্তে আস্তে প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত হতে দেখেছি, দ্বিতীয় অংশে গিয়ে খুবই দ্রুত গতিতে চারপাশের সবকিছু পাল্টে যেতে দেখেছি এবং শেষ অংশে এসে একের পর এক ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখা শুরু করলাম। জানি না জীবনের একেবারে শেষ সময়ে গিয়ে আরও কতো বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো! ক্ষুদ্র সেফটিপিন থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট পর্যন্ত আমার দেখা লাইফের এই দীর্ঘ জার্নি টা সম্পন্ন হয়েছে খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে। ভালোভাবে সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই।


কৃষিনির্ভর একটি দরিদ্র দেশে জন্ম নিয়ে জীবনের প্রথম অংশে আমি দেখেছিলাম উৎসবমুখর একটি আটপৌরে জনগোষ্ঠী আমার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তখনকার সময়ের প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ছিল আশ্চর্যজনক এক সারল্য এবং পরস্পরের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। ধর্মের ভিত্তিতে কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তখনও মানুষের সাথে মানুষের এতটা বিভেদ সেভাবে সৃষ্টি হয়নি। তখনকার মানুষেরা ছিল ভীষণ পরিশ্রমী এবং আমুদে প্রকৃতির। প্রচণ্ড খেটেখুটে নিজের পরিবারের অন্নের সংস্থান হয়ে গেলেই তারা বিনোদনের উপকরণের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। নিখাঁদ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এই ষড়ঋতুর দেশে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে ভাবার মতন সময় তখনো আসেনি। আমার শৈশবে বাড়িতে একটা টু-ব্যান্ড প্যানাসনিক রেডিও ছিল, ওটা চালু করে আমার কাকা প্রতিদিন সকালে ফুল ভলিউমে সংবাদ শুনতেন। সংবাদ শেষ হবার একটু পর শুরু হতো গানের অনুষ্ঠান। আমার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আমার প্রয়াত কাকা কল্যাণ কুমার দাস ভারত থেকে একটি টেপরেকর্ডার নিয়ে এসেছিলেন। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখনই প্রথম আমাদের বাড়িতে 'নিপ্পন' ব্র্যান্ডের একটি সাদাকালো টেলিভিশন কেনা হয়। অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার আগে আমি প্রথমবারের মতো একটি ক্যাসিও ঘড়ি কিনেছিলাম।


জীবনের প্রথম অংশে আমার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার সময়ে প্রতিটি প্রয়োজনীয় উপকরণ এসেছে একটার পর একটা। ঠিক যখন যেটার যতটুকু প্রয়োজন, সেই হিসাব নিখুঁতভাবে মেনে। এরজন্য পুরো বিবর্তন প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করা আমার জন্য সহজ। আমার কৈশোরে আমি প্রচুর পরিমাণ চিঠিপত্র লিখে ডাকযোগে প্রিয় মানুষের কাছে পাঠিয়েছি। ভূমিষ্ঠ হয়েই ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম পাইনি, তাই অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হবার প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে অভিযোজিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের দ্বিতীয় অংশে এসে আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম— সবকিছুই খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পরিবর্তন আস্তে আস্তে সংঘটিত হলে মানুষ এগুলোর সাথে অভিযোজিত হবার সময় পায়। আমরা সেই সময় পাচ্ছিলাম না। রেডিও, টেপরেকর্ডার খুব দ্রুত হারিয়ে গেল। সিডি প্লেয়ার, ডিভিডি, এফএম রেডিও, ডিজিটাল ক্যামেরা, ডিজিটাল ঘড়ি, মাইক্রো এসডি কার্ড ইত্যাদি জিনিসগুলো যতটা দ্রুত এলো— হারিয়ে গেল তারচেয়েও দ্রততায়। শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের কয়েকটি বিবর্তন প্রক্রিয়া সংঘটিত হলো মাত্র পনের বছরের মধ্যে। দেশে প্রথম চালু হওয়া মোবাইল ফোনটি দেখতে চাইলে এখন মিউজিয়ামে যেতে হবে। এতটা দ্রুত গতির পরিবর্তন কোনো স্বাভাবিক বিষয় না।


বর্তমান উত্তরাধুনিকতার অসংগতি নিয়ে আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছি। এটা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে ঠিকই, কিন্তু পরোক্ষভাবে সুখ কেড়ে নিয়েছে। সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য বিষয় দুটির মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আগেকার দিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক ঝামেলা করে সিনেমা হলের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে একটা মুভি দেখা ঝামেলাপূর্ণ বিষয় হলেও বিষয়টির মধ্যে মানসিক সুখ ছিল। এখন নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করে যেকোনো মুভি ডাউনলোড করার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য আছে, কিন্তু সেই মানসিক সুখ আর নেই। আমার জীবনের তৃতীয় অংশে গিয়ে আমি ক্রমাগত ভাবে মানুষের জীবন থেকে সুখ নামক বিষয়টি হারিয়ে যেতে দেখেছি। দু'মাইল পায়ে হেঁটে কষ্ট করে স্কুলে গিয়ে শিক্ষা লাভের মধ্যে যে প্রশান্তি ছিল, ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে সেটা ঘুণাক্ষরেও অনুভব করা সম্ভব না। প্রযুক্তি আমাদের মাঝে দূরত্বের এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। আমরা মানুষেরা একটু একটু করে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছি এবং সেই হতাশার ফলশ্রুতিতে আমরা আক্রমণাত্মক মানসিকতা অর্জন করছি। ঐ যে আমার বর্ণনায় বলেছিলাম— জীবনের দ্বিতীয় অংশে আমাদের সামনে থেকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি এতটা দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়েছে যে, এখন নতুন কিছুই আমাদের আর সহজে সন্তুষ্ট করতে পারে না। এখনকার দিনে আমরা সবাই কমবেশি অসন্তুষ্ট হয়ে জীবন যাপন করি।


বর্তমান সময়ে আমরা ত্রিমুখী সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমত. বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে চরম অস্থিরতা এবং সহিংসতা বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া। তৃতীয়ত. নতুন নতুন বেশকিছু প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার। এখন বিপদ আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। আমরা কিভাবে এইসব সংকট মোকাবিলা করে নিজেদের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখবো, সেটা না ভেবে বরং আমরা বেশি বেশি নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছি। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহের একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণী হিসেবে জীবনের ত্রিমুখী সংকটে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে আমি আজকাল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করি। হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে তেমন কোনো বীভৎসতার সাক্ষী হবো। একটা জীবন ধরে একটানা শুধুই সাফল্যের পর সাফল্য প্রত্যক্ষ করলাম, নিত্যনতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আর মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চার সুফল ভোগ করলাম, তাহলে বিপর্যয় কেন নয়? প্রকৃতির নিয়মেই রয়েছে— যতটুকু সুফল, ততটুকুই কুফল। এই নিয়ম অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতি যদিও তার নিয়মে কিছুটা ঢিমেতালে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর সমূহ রোগব্যাধি নিয়ে হাজির হবে, কিন্তু তার আগেই আমরা মানুষেরা নিজেদের মধ্যে সেই তিন নাম্বার মহাযুদ্ধ লাগিয়ে দেবো। এভাবেই হ্যাট্রিক পূর্ণ হবে। কথায় আছে না— দানে দানে তিন দান!


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

২২.০৮.২০২৪ খ্রিঃ

বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

'বিস্মৃতির কথা'

 বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে মানুষের মন থেকে একটু একটু করে অসংখ্য পূর্বের স্মৃতি হারিয়ে যেতে থাকে। হয়তো কয়েক বছর কেটে যাবার পর হঠাৎ করে সামনে এমন কিছু একটা বিষয় এসে যায়, যেটা দেখে বহুকাল আগের কোনো একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আবার কখনো কখনো স্বপ্নের মধ্যেও বহুকাল আগের কিছু একটা ঘটনা অস্পষ্ট ভাবে দেখা দেয়। উদাহরণ দেই— আজ সারাদিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। দুপুরে প্রবল বৃষ্টির সময়ে আমাদের উঠোন থেকে তীব্রভাবে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সেখান থেকে ছোট ছোট একঝাঁক মাছ সাঁতরে চলেছে। ঠিক তখনই কিভাবে যেন মনে পড়ে গেল খুব ছোটবেলায় বৃষ্টির মধ্যে আমি গামছা দিয়ে উঠোন থেকে সাঁতরে যাওয়া ছোট ছোট মাছ ধরতাম। একবার প্রায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরার সময় একটা জোঁক এসে আমার পায়ে লেগেছিল, এটা দেখেই আমি বিকট চিৎকার করে দৌড়ে ঘরে উঠতে গিয়ে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার কপালের কাছে খানিকটা জায়গা কেটে গিয়েছিল। ব্যাস, এতটুকুই। এর আগে বা পরের আর কোনো স্মৃতি নেই। অনেক চেষ্টা করেও সেই সময় বা তার কাছাকাছি আর কোনো ঘটনা মনে করতে পারলাম না। অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা মনে আসতে চায়, কিন্তু কিছুতেই সেটা আর গুছিয়ে নিতে পারি না।


সপ্তাহ খানিক আগে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলাম— খুব সম্ভবত মায়ের সঙ্গে আমি মামাবাড়ি যাচ্ছি। একটু ভুল বললাম, আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাচ্ছি। মা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন আর বাবার হাতে ভারী কোনো ব্যাগ। আমার পায়ের জুতোজোড়া খুবই টাইট লাগছিল বলে আমি বায়না করে মায়ের কোল থেকে নেমে পড়লাম। এরপর আমি দৌড়াচ্ছি। বাবা-মা আমাকে থামতে বলছেন, কিন্তু আমি দৌড়ে চলেছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একটি স্কুলঘরের সামনে চলে এলাম। স্কুলঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ওটা আসলে কোনো স্কুলঘর না, একটা কালী মন্দির। মন্দিরের ভেতর মানুষজন নেই। চারপাশে অদ্ভুত দর্শন অসংখ্য মূর্তি। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে বাবা-মা কে ডাকছি, কিন্তু তারা আর আমার আশেপাশেই নেই। এই স্বপ্ন দেখার পর গভীর ভাবে চিন্তা করলাম, শৈশবে আমার সাথে কখনো কি এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল? চোখ বন্ধ করে আমি ভীষণ মনযোগী হয়ে চিন্তা করলাম। কিছুটা অস্পষ্ট ভাবে কোনো একটা বিষয় মনে আসতে চায়, কিন্তু কিছুতেই সেটা পরিষ্কার ভাবে গুছিয়ে নিতে পারি না।


প্রায় এক মাস আগে বেশ আটঘাট বেঁধে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম। ভৌতিক ধরনের রহস্যময় একটি গল্প। খুব হিসেব করে গল্পের প্লট নির্ধারণ করে ঝটপট লিখে যাচ্ছি। টানা আটটি পৃষ্ঠা লেখার পর— ওটুকু পড়েই রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর বর্ণনা, এতটা নিখুঁত প্রেজেন্টেশন! তখন আমার চোখে প্রায় জল এসে যাবার যোগাড়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আট পৃষ্ঠার পর গল্প আর একটা লাইনও এগিয়ে নেওয়া গেল না। এরপর যা-ই লিখি না কেন, কেমন জানি খাপছাড়া মনে হয়। কোনোভাবে আর গুছিয়ে নিতে পারলাম না। প্রাণপণে চেষ্টা করেও আজকাল কিছুই আর গোছানো হচ্ছে না। নাকি শুরু থেকে সবকিছু অগোছালো করেই রেখেছিলাম আমি! অগোছালো জীবন, অগোছালো সময়, অগোছালো চিন্তা আর অগোছালো ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে ক্রমাগত ভাবে বার্ধক্যে ঢোকার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে— ইদানীং কেমন জানি এক অর্থহীন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অনুভূতির মধ্যে হারিয়ে যাই। এরপর সম্বিত ফিরে এলে গভীর ভাবে পুরোটা ভেবে দেখার চেষ্টা করি। সমস্ত ভুলত্রুটি আর যাবতীয় হিসাবনিকাশ একটু একটু করে মেলাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সেটা আর গুছিয়ে নিতে পারি না। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

৩০.০৬.২০২৪ খ্রিঃ

'আত্মহননের কারণ নিয়ে আলোচনা'

 প্রায় বছর দশেক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে একটি ডকুমেন্টারি ভিডিও দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। ভিডিওটির বিষয়বস্তু এরকম যে— একটি তৃণভোজী প্রাণী তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি জলাশয়ে নেমে তৃষ্ণা নিবারণের মুহূর্তে একদল ক্ষুধার্ত হায়েনা সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। হিংস্র হায়েনার থেকে বাঁচার তাগিদে নিরীহ পশুটি জলে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে অন্য পাড়ে গিয়ে যখন পৌঁছালো, ততক্ষণে হায়েনার দল সেখানে পৌঁছে গেছে। পশুটি আবারও বহুকষ্টে সাঁতার কেটে অন্য দিকে রওনা হলো, কিন্তু সেখানেও হায়েনা চলে গেছে। সে তার সমস্ত প্রচেষ্টা করে যেদিক থেকে উঠে যেতে চেষ্টা করে, সেখানেই হায়েনারা দাঁড়িয়ে থাকে। সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পশুটির তখন ডুবে যাবার দশা। সে শেষবারের মতো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে জলাশয়ের তীরে উঠে দাঁড়ালো, প্রচণ্ড পরিশ্রমে সে তখন হাঁপাচ্ছে। ঠিকমতো বুকভরে দুইবার নিঃশ্বাস নেবার আগেই তার ওপর হিংস্র হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মেরে ফেললো।


আজকালকার এই ভুল ব্যবস্থাপনার বৈষম্যের পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশি বেশি আত্মঘাতী হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অসংখ্য আত্মহত্যার সংবাদ শুনতে পাচ্ছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে এটার বিরুদ্ধে খুব দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। ফেসবুকেই এটা নিয়ে অনেক বার লিখেছি। আমি সবসময় বলতাম— যা-ই ঘটুক, কখনো নিজেকে শেষ করে দেওয়া যাবে না। প্রতিকূলতার এই পৃথিবীতে যেভাবেই হোক সার্ভাইব করতে হবে। নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আপনি হারিয়ে গেলে কারো কিছুই এসে যাবে না, শুধুমাত্র আপনিই নিজের জীবন টা নষ্ট করবেন। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নিলে আপনাকে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে। হাল ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের সাথে শঠতা, এটা একটা কাপুরুষোচিত আচরণ। এই টাইপের অসংখ্য অসংখ্য গালভরা বয়ান নানান ভাবে, নানান উপমায় একটি সময় আমি লিখেছিলাম।


ইদানীং সামগ্রিক বাস্তবতা আর প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিরূপ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে— যে মানুষগুলো ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা হয়তো তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছিল। সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পরেই তারা শেষমেশ নিশ্চিত একটি পরিনতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে। সত্যিকার অর্থে আমার কাছে তাদের এখন আর ততটা নির্বোধ মনে হয় না। এই পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণীর ভীড়ে মানুষও একটি সাধারণ জীব। আর দশটি প্রাণীর মতো সে-ও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এতো সুন্দর এই গ্রহের আলো-বাতাসে ভালোমন্দ মিশিয়ে স্বাভাবিক একটা জীবন কাটিয়ে দিতে কে না চায়! জীবন তো মোটে একটা। তবুও যখন কোনো কিছুতেই আর কিছু হয় না, যখন জীবনের সামগ্রিক প্রতিকূলতা চক্রব্যূহের সেই সপ্তরথীর মতন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ক্রমাগত ভাবে আক্রমণ করে যায়, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের অবস্থা হয় সেই নিরীহ হরিণটির মতো— যে বারবার করে সাঁতার কেটে হাঁচড়েপাঁচড়ে তীরে উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু তীরে দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র একদল হায়েনা। সে বারবার করে সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে একটি সময় নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

০৮.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'বই পড়া এবং জ্ঞানার্জন'

 একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে আজ সামান্য আলোচনা করতে চাই। বলতে গেলে তা প্রায় আড়াইশো বছর ধরে একটি ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে পাকাপোক্ত ভাবে সেট হয়ে গেছে যে— জ্ঞানার্জন করার আসল উদ্দেশ্যই হলো টু-পাইস কামানো। খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মধ্যে এই বিষয়টি এমন গভীর ভাবে ঢুকে গেছে যে, তারা এটার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি আজও। আমাদের উপমহাদেশে ব্যপকভাবে এই ধারণাটির বিস্তৃতি ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে। তখনকার দিনে তথাকথিত 'শিক্ষিত' সমাজ থেকে বাল্যশিক্ষার বইয়ে একটি বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে— 'লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।' তৎকালীন সময়ের কোমলমতি শিশুরা এই বাক্য মনস্তাত্ত্বিক ভাবে গ্রহণ করে বড় হয়েছিল। তারাও একটা সময়ে গিয়ে তাদের সন্তানদের মধ্যে এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং বংশপরম্পরায় এই ধারণাটি এতটাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, এখনকার দিনে বইপত্র পড়া কিংবা জ্ঞানার্জনের পেছনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে অর্থোপার্জন সংশ্লিষ্ট বিষয়।


আমি বাগেরহাট শহরের একজন রিক্সাচালক ভদ্রলোক কে চিনি, যিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর সংসারের নানান অভাব অনটনের কারণে তিনি আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি তার পেশাগত জীবনে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই ভদ্রলোকের একটি চমৎকার অভ্যাস আছে। তিনি গল্প-উপন্যাস পড়তে ভীষণ পছন্দ করেন। কয়েকদিন আগে তার রিক্সায় যেতে যেতে তিনি আমার সাথে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি সায়েন্স ফিকশন নিয়ে আলোচনা করলেন। একটা পর্যায়ে আমি তাকে এক কাপ চা অফার করলে তিনি সম্মত হলেন। রিক্সাটি ভৈরব নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা দু'জন একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম। এরপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি আমাকে কয়েকটি কথা বললেন, কথাগুলো বলার একপর্যায়ে তীব্র অভিমানে তার চোখে জল এসে গেল। তার কথার সারমর্ম ছিল এরকম— তার গল্পের বই পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। বই পড়ার জন্য তিনি কয়েকদিন গণগ্রন্থাগারে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে গেলে মানুষ তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। তাই তিনি তার কষ্টার্জিত টাকা থেকে মাঝেমধ্যে দুই-একটি বই কিনে পড়েন। এটা নিয়েও চারপাশের 'শিক্ষিত' সমাজের লোকজন তাকে খুবই উপহাস করে। নানান ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা তাকে হজম করতে হয় শুধুমাত্র বইপড়ার অপরাধে।


আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে যতটুকু বুঝি— শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জন। আর জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষের ভেতরকার মূল্যবোধের বিকাশ কিংবা তার চেতনাগত উন্নয়ন। নিজের অন্তর্নিহিত বোধের পরিধির বিস্তৃতিই যদি না ঘটে, সেক্ষেত্রে এতো এতো লেখাপড়া করে এবং অনেক গুলো ডিগ্রী নিয়ে আদৌ লাভ টা কোথায়? সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের একটা পিএইচডি ডিগ্রী আছে, অথচ তিনি বিরাট বড় চোর। তাহলে এই ডক্টরেট ডিগ্রীর কতটুকু মূল্য থাকলো, যেখানে তার আত্মিক উন্নয়ন হয়নি, যেখানে তার মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ হয়নি! আজকাল চারপাশে এরকম অসংখ্য অসংখ্য নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত 'উচ্চ শিক্ষিত' লোকজন দেখা যাচ্ছে। এসবের দায় কার জানেন? সেই পুরনো ভুল শিক্ষাব্যবস্থার। যে পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় তাকে শেখানো হয়েছে— লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্যই গাড়িঘোড়ায় চড়ে বিলাসবহুল জীবন কাটানো। আজকাল অনেক অভিভাবকদের দেখা যায় তাদের কোমলপ্রাণ শিশুটির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো একগাদা বইপত্র চাপিয়ে দিতে। তারা তাদের সন্তানের সাকসেস দেখার জন্য এতটাই বেশি মোহগ্রস্ত হয়ে যান যে, তাদের শিশুটি ঐ বোঝার ভার বহন করতে গিয়ে একটা সময় সমাজের তাবত মানুষের কাছে নিজেকে একজন ভুল মানুষ হিসেবে প্রমাণ করে। আজকাল চারপাশে শুধু ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিক্ষা কিংবা প্রকৃত জ্ঞান তাদের মধ্যে মূল্যবোধের জন্ম দিতে পারেনি।


আমি প্রচুর পরিমাণ বইপত্র পড়ি। এটা নিয়ে আমাকেও অসংখ্য বার অনেকের কাছে কটুকথা শুনতে হয়েছে। তাদের কথা হলো— এই যে আপনি এতো এতো বইপত্র পড়লেন, অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করলেন, অনেক তথ্য জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করলেন, কিন্তু আখেরে গিয়ে আপনি কি পেলেন? আপনার তো টাকাপয়সা নেই। এতো জ্ঞান দিয়ে হবে টা কি, যদি অর্থনৈতিক উন্নতি না করা যায়? আমি তাদের সহজ একটি বিষয় আজও বোঝাতে পারলাম না যে, অর্থনৈতিক উন্নতি করার জন্য আমি বইপত্র পড়ি না। এটা একটা আত্মিক ভালোলাগার জায়গা। আপনি যেমন দশ লাখ টাকা সঞ্চয় করে একধরণের আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, আমিও তেমনি কয়েকটি বই পড়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করি। সবকিছুই টাকাপয়সার সাথে সম্পর্কিত নয়। আপনি এভাবে চিন্তা করুণ— এক প্লেট কাচ্চি-বিরিয়ানি খেয়ে আপনি আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, আপনি চমৎকার একটি মুভি দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন কিংবা আপনার প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। এগুলো যেভাবে আপনার মনের খোরাক জোগায়, ঠিক সেভাবেই আমি নতুন একটি বই পড়ে মানসিক ভাবে তৃপ্তি লাভ করি। এরসাথে টাকাপয়সা উপার্জন করা কিংবা অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বইপড়ার সাথে বস্তুগত মুলধন প্রাপ্তির যে ভুল থিওরী জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন। আমি এভাবে অনেক অ্যাঙ্গেলে উদাহরণ দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তারা বুঝতে চায় না। তাদের মাথায় 'ভুল শিক্ষা' এমনভাবে ফিক্সড হয়ে গেছে যে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। তাই তারা প্রচুর খেটেখুটে পড়াশোনা করে, এরপর কয়েকটি সার্টিফিকেট অর্জন করে আবারও চাকরির জন্য দৌড়ঝাঁপ করে, সেটা মিটে গেলে টাকার পেছনে দৌড়ায়। বোধশক্তিহীন পশুর মতো দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে যখন সে দেখে— একজন লুঙ্গি পরিহিত রিক্সাচালক নিজের রিক্সায় বসে নিমগ্ন হয়ে একটি বই পড়ছে, এই দৃশ্য তখন তার সামগ্রিক বোধ কে অচল করে দেয়। প্রাচীণ কালের ভুল শিক্ষার সেই বিষ তার সারা শরীরে সঞ্চারিত হয়। সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। নির্দোষ পাঠক রিক্সাওয়ালা কে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে সে তখন মানসিক ভাবে তৃপ্তি লাভ করে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

০৯.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'বাংলাদেশের ধর্মীয় বিদ্বেষ'

 বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের স্তর টা যেমন থিতু হয়, তেমনি তার বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সুক্ষ্ম হিসাবনিকাশের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। আজকাল আমি জীবনের সেই শাশ্বত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি— যেখানে দাঁড়িয়ে নির্মোহ ভাবে চারপাশের সবকিছু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। ইদানীং খুব বেশি করে প্রাচীণ ইতিহাস এবং তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর লিখিত বইগুলো খুঁজে বের করে পড়ি। ইতিহাসের পাতা উল্টে প্রাচীণ কালের সেইসব দিনগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে আজকাল তীব্র এক ব্যথায় বুকটা ভীষণ টনটন করে ওঠে। কিসের জন্যে মানুষের সাথে মানুষের এতো বিভেদ? পাশাপাশি একই ভূখণ্ডের একই আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষের মধ্যে কেন এতটা বিজাতীয় ক্ষোভ আর ঘৃণা? অনেক চিন্তাভাবনা করেও এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না।


মাত্র আড়াইশো বছর আগেও আমাদের মধ্যে ভীষণ গভীর এক আত্মিক টান, পারস্পরিক সম্প্রীতি আর চমৎকার সৌহার্দ্য বিরাজমান ছিল। সেই ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে আমরা পরস্পরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহামারীর সময়ে আমরা হাতে-হাত রেখে মোকাবিলা করেছিলাম সেইসব প্রতিকূল পরিস্থিতি। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা সহোদর দুই ভাইয়ের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করেছি। প্রতিটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সমস্ত ধর্মীয় উৎসবে মেতে উঠেছি নির্মল আনন্দে। এরপর হঠাৎ করে কী এমন হলো যে, মুহূর্তের ব্যবধানে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম? দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আমাদের ভেতরকার সেই ঐক্যবদ্ধ মানসিকতা, সেই ভ্রাতৃত্ব, সেই দারুণ সম্প্রীতি, পারস্পরিক সেই গভীর আত্মিক টান কিভাবে রাতারাতি নেই হয়ে গেল? আমরা কেউ-ই তো এটা চাইনি।


১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের অধিবেশনে উপস্থাপিত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রবর্তিত দ্বিজাতিতত্ত্বের থিওরী এই উপমহাদেশ জুড়ে প্রধান দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মারাত্মক ভাবে হিংসার জন্ম দিয়েছিল। এই তত্ত্বের প্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা এবং বিহার রাজ্যে ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল। জিন্নাহর খামখেয়ালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হাজার হাজার নির্দোষ হিন্দু এবং মুসলিম জনগণ নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলিম নিজেদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে ছুটে গিয়েছিল আলাদা আলাদা এলাকায়। ভুল থিওরী নিয়ে ১৯৪৭ সাথে জন্ম হয়েছিল 'পাকিস্তান' নামের রাষ্ট্রের। ধর্মের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন এবং ভারতে অসংখ্য মুসলিম ধর্মাবলম্বী লোকজন ঠিকই থেকে গিয়েছিল। জিন্নাহ চেয়েছিলেন শুধুমাত্র তার ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রের সূচনা করবেন। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সেটা আর কখনোই সম্ভব হয়নি, বরং দিন কে দিন পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যাচ্ছে।


দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের গঠন সফল না হলেও ক্ষতি যেটুকু হবার, তা ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। ঐ ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বের কারণে এই উপমহাদেশে দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যে তীব্র বিদ্বেষ এবং পারস্পরিক ঘৃণার সূত্রপাত ঘটেছিল— সেটা বংশপরম্পরায় আজও ভয়াবহ ভাবে চলমান রয়েছে। ১৯৪০ সালে জিন্নাহ যে ঘৃণার বীজ বপন করেছিলেন, তার খেসারত হিসেবে আজও প্রচণ্ড দুঃখে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। দীর্ঘকাল ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শত বিপদে পাশাপাশি চলা একজন মানুষ যখন আজ প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলে— 'মালাউনের বাচ্চার মা'কে....' তখন ভীষণ দুঃখ হয়। কারণ মালাউন একটি কুৎসিত গালি, যা বাংলাদেশে মূলত হিন্দুদের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়। 'মালাউন' শব্দটি আরবী শব্দ "ملعون" থেকে উদ্ভূত— যার অর্থ অভিশপ্ত বা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। অথবা আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভেদের ফলশ্রুতিতে ঘৃণা প্রকাশের এই নোংরা রীতি এখন বহুল-চর্চিত। এখনকার দিনে নিতান্ত তুচ্ছতম কারণে ধর্মীয় পরিচয় কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। অথচ আমরা দীর্ঘকাল ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে, হাতে হাত ধরে অসংখ্য অসংখ্য প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে থেকেছি। আমাদের মধ্যে বিভেদ কিংবা বিভাজন ছিল না। পারস্পরিক সম্প্রীতি আর আত্মিক টান নিয়ে আমরা একটি সময় সুখে-দুঃখে মিলেমিশে ছিলাম। তাই আজ যখন এই বিভেদ আর ঘৃণার সংস্কৃতি কে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখি, তখন খুব দুঃখ হয়। হয়তো জিন্নাহ সাহেবের মতো গুটিকয়েক মানুষ এই ঘৃণার রাজনীতি চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাস্ট মি— আমরা বৃহৎ সংখ্যক মানুষেরা কেউ-ই এটা চাইনি।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১১.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'ধ্যানের অভিজ্ঞতা'

 আনুমানিক প্রায় তিনটি বছর ধরে আমি খুব একাগ্রতা নিয়ে একটি বিশেষ চর্চার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। বইপত্র পড়ে এবং ইউটিউবে টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে দেখে নানান ভাবে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। বিষয়টা হলো ধ্যানস্থ হওয়া। এটা এতটাই কঠিন একটি প্রক্রিয়া— যা বলে বোঝানো যাবে না। মস্তিষ্ক পুরোপুরি ভাবে চিন্তাশূন্য করে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের চেতনে এবং অবচেতনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সবসময়ই কিছু না কিছু ভাবনা চলমান থাকে। এই ভাবনাগুলো কে কোনোভাবে বন্ধ করে রাখা যায় না। আমি অসংখ্য বার চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলেছি যে, আমি এখন আর কিছুই ভাবতে চাই না। আমার মন এই মুহূর্তে পুরোপুরি স্তব্ধ থাকবে। জোরের ওপর দুই-চার মিনিট এভাবে ঠিক থাকে, এরপর কোন ফাঁকে হঠাৎ একটা ভাবনা চুপচাপ ঢুকে পড়ে এবং সেটার লেজ ধরে আরও অনেকগুলো ভাবনা ঢুকে পড়ে। সেগুলো কে তাড়িয়ে দিয়ে মনের ঘরে কপাট লাগিয়ে আবারও যখন একটু স্তব্ধ হই— তখন আবারও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ। একপর্যায়ে 'ধুত্তেরি' বলে উঠে যেতে বাধ্য হই। যদিও বছর দুয়েক ধরে 'প্রাণায়াম' নামের যোগ টা ঠিকঠাক ভাবে করে যাচ্ছি। তবে শিথিলায়নের একটি পর্যায়ে গিয়ে জগৎ-সংসারের সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর কনসেন্ট্রেশন দেওয়া কিছুতেই আর সম্ভব হচ্ছিল না।


বর্তমান সময়ের আরও অসংখ্য মানুষের মতো আমার মধ্যেও একটি অভ্যাস ভয়াবহ ভাবে ঢুকে গিয়েছিল। সেটা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সার্বক্ষণিক ভাবে যুক্ত থাকার প্রবনতা। তবে গত দুই মাসের মধ্যে অবিশ্বাস্য ভাবে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মানুষের সাথে হঠাৎ করে দূরত্ব তৈরি হবার কারণে আজকাল আমি সেভাবে অনলাইনে অ্যাক্টিভ থাকি না। কেউ যে আমাকে এখন আর খুঁজবে না, এটা পুরোপুরি মন থেকে মেনে নেবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কিছুটা দূরত্ব ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছিল। এরমধ্যেই হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে টালমাটাল অবস্থা, চলমান সহিংসতা এবং নৈরাজ্যের জের ধরে ইন্টারনেট সিস্টেম বন্ধ হয়ে গেল। এটা আমার জন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল, কারণ ইন্টারনেট পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আমি মানসিক ভাবে একটি নিশ্চিত স্থিরাবস্থায় পৌঁছে গেলাম যে— আমার এই মুহূর্তে আসলে কোনো দিকে ফোকাস দেবার প্রয়োজন নেই। মোবাইল ফোনের সাথে আমার সংযোগ যেহেতু তখন পুরোপুরি ঘুচে গেছে, তাই আবারও একবার ধ্যানের গভীরে যাবার চেষ্টা করলাম। 


সময়টা ছিল ২১ জুলাই ২০২৪, দিবাগত রাত। সেদিন প্রায় সারাদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে, এমনকি রাতেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। আনুমানিক রাত একটার পর বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেল। মেঘমুক্ত আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার অপূর্ব চাঁদ। চারপাশে ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙের একটানা ডেকে যাওয়ার শব্দ, এরপর মাঝেমধ্যে ওদের কোলাহল থেমে যাওয়া। সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে এক অপার্থিব শিথিলতা। আমার কোনো তাড়া নেই, কারো জন্যে প্রতীক্ষা নেই। দেশের সামগ্রিক এই সংঘাতময় পরিস্থিতি কিংবা দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুটিনাটি হিসাবনিকাশ ভুলে আমি যেন একটা আদিমতম পরাবাস্তবতার মুখোমুখি সেই মুহূর্তে। আমি বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নিলাম এবং চোখ বন্ধ করে নিজের মধ্যে নিমগ্ন হলাম। এর আগে আমি যতবারই ধ্যানস্থ হবার চেষ্টা করেছি, সব সময়ই মনের মধ্যে একটা বাড়তি তাড়না ছিল যে— বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলো কে দ্রুত তাড়িয়ে দিতে হবে। এদিন আর সেই বাড়তি চাপ টুকুও মনের ওপর প্রভাব ফেলেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি কোথায় যেন তলিয়ে যেতে শুরু করলাম। এখন সচেতন অবস্থায় আমি সেই মুহূর্তের বিচিত্র অনুভূতি লিখে প্রকাশ করতে পারবো না, কিন্তু সেটা ছিল আমার এযাবৎকালে জন্মানো বোধের বাইরের এক অনুভব। পুরোপুরি ভাবে চিন্তাশূন্য এক অবিশ্বাস্য জীবন্ত অনুভূতি। ঠিক কতক্ষণ এভাবে মোহাবিষ্ট হয়ে ছিলাম জানি না, তবে যখন আবারও আমার মাথায় ভাবনা অনুপ্রবেশ করলো— আমি লক্ষ্য করলাম বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে এবং আমার পোষা বিড়াল টা চিৎকার করে ডাকছে। দরজা খুলে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া বিড়ালটিকে ঘরে এনে এক কাপ চা বানিয়ে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া বিষয়টি ভাবতে বসলাম। এটা ছিল আমার জীবনের চল্লিশ বছর পার করার পরের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি, যখন আমি জীবনে প্রথম বারের মতো সত্যিকার অর্থে চিন্তাশূন্য স্থিরাবস্থায় প্রবেশ করে ধ্যানস্থ হলাম। প্রত্যাশা করি— প্রক্রিয়াটির আরও উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবো।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

'সার্কেল অফ লাইফ'

 সবকিছুই সেই পূর্বের অবস্থানে বারবার করে ফিরে ফিরে আসে, এভাবেই একটি চক্র পূর্ণ হয়। জীবনের চক্র কিংবা সময়ের চক্র। সুপ্রাচীণ এক মহাজাগতিক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়ে চতুর্পাশে ছড়িয়ে পড়েছিল যে অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড— কালের আবর্তে একদিন সেটাও মহা সংকোচনের মাধ্যমে পরিনত হবে ক্ষুদ্রতম একটি বিন্দুতে, এক সময় সেই বিন্দুটিও অদৃশ্য হয়ে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে না কিছুই, শুরু হবার সেই আগেকার অবস্থার মতো। এভাবেই পূর্ণ হবে সময়ের চক্র। বায়োলজিক্যাল প্রাণী হিসেবে প্রাচীনকালে এই গ্রহেও শুরু হয়েছিল আমাদের লাইফের জার্নি। একটু একটু করে মেরুদণ্ড সোজা করে আমাদের চলতে শেখা, হাত-পায়ের সুষম ব্যবহার করতে শেখা, এরপর আগুন আবিষ্কার, গুহা থেকে বেরিয়ে মুক্ত স্থানে বসতি স্থাপন, চাকা আবিষ্কার এবং বহুদূর পর্যন্ত নিজেদের কে চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া।


বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সেই প্রাচীনতম নিয়ম মেনে আমরাও ক্রমাগত ভাবে নিজেদের ছড়িয়ে দিতে শিখলাম চতুর্পাশে। নিজেকে জানা এবং নিজের গ্রহটিকে এক্সপ্লোর করার সেই বুনো উল্লাসে ভেসে আমরা জন্ম দিলাম আধুনিকতা নামের একটি পারিপার্শ্বিক আচ্ছাদন। এরপর থেকে শুধুই ছুটে চলা। এভাবে সভ্যতার পথে ছুটতে ছুটতে একটি পর্যায়ে গিয়ে আমরা, অর্থাৎ মানুষেরা লক্ষ্য করলাম যে— সবকিছুই কেমন জানি একঘেয়ে হয়ে গেছে। কোনকিছুর মধ্যে আর সেভাবে আগ্রহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই শুরু হলো পুরনো দিনের জীবনের স্পর্শ নিয়ে নতুনত্ব সৃষ্টির এক অদ্ভুত ফর্মুলা। ওল্ড লাইফস্টাইলের বৈচিত্র্যে মোড় নিল জীবনের নতুন গতিপথ। জংধরা পুরনো আমলের ফ্যাশন নতুন ভাবে বিক্রি করে কিছুদিন কেটে গেল ঠিকই, কিন্তু এরপর আবারও সেই একঘেয়ে জীবন। অতীত-বর্তমান এবং বর্তমান-অতীত কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আর কতকাল চলে! জীবনচর্চার মধ্যে অভিনব কিছুই তো আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যা কিছুই নতুন হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, তার পুরোটাই যান্ত্রিকতার অবয়বে মোড়া। 


আজ থেকে একশো কিংবা দেড়শো বছর আগেও মানুষের প্রতি মানুষের এক নিবিড় আত্মিক টান লক্ষ্য করা গেছে। পরিচিত কেউ মারা গেলে আশেপাশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে গভীর বিষাদ নেমে আসতো। হারিয়ে যাওয়া মানুষটির অভাব ভুলতে বাকি মানুষদের কয়েক বছর লেগে যেতো। আর আজকাল খুব ঘনিষ্ঠ আপনজন মারা গেলেও মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটেনা। মৃত মানুষটিকে ভুলে যেতেও সময় লাগে না এখন। আবেগ-অনুভূতির জায়গায় সবাই খুব বেশি নির্লিপ্ত। আগেকার দিনের মানুষের প্রতিটি পরিবারে একগাদা সন্তান থাকার নেপথ্যেও ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তখনকার সময়ে ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি নিয়ে মানুষের মধ্যে তুমুল আগ্রহ এবং এই বিষয়টিকে উপভোগ করার বিষয় ছিল। সত্যিই তারা এটা থেকে দুর্দান্ত ফিজিক্যাল প্লেজার লাভ করতেন। আর এখনকার সময়ের মানুষের মধ্যে থেকে সেই প্রাকৃতিক বুনো আনন্দ হারিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ের অর্গাজমে সম্ভবত সেই পুরনো দিনের মতো শিহরণ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন ধরে বলতে হয়— 'কাঁচা লঙ্কায় এখন আর তেমন ঝাল নেই!' আজকাল সবকিছুর মধ্যে একটা কৃত্রিমতার ছোঁয়া। প্রকৃতি এখন মানুষের মধ্যে থেকে অনেক জৈবিক অনুভূতি লুপ্ত করে দিচ্ছে। মানুষ আজকাল এক মুহূর্তের নোটিশে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়। কেউ আজকাল বাড়তি পেইন নিতে পছন্দ করে না।  


কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার রেশ ধরে সারাদেশের ইন্টারনেট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হলো। এবারই প্রথম অসংখ্য মানুষ একটি বিষয় বুঝতে পেরেছে যে— কোনো কিছুর সাথে অতিরিক্ত রকম অভ্যস্ততা তৈরির পর সেই বিষয়টির অনুপস্থিতির প্রতিক্রিয়া কতখানি মারাত্মক হতে পারে। যুগের হাল-হকিকত মেনে নিয়ে আমরা সবাই এখন খুব বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। তবে এটাও আমাদের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা দরকার যে, হঠাৎ করেই প্রযুক্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর বর্তমান যে পরিস্থিতি, সবখানেই যেরকম যুদ্ধংদেহী মনোভাব, তাতে অদূর ভবিষ্যতে গোটা পৃথিবীতে ভয়ংকর কোনো সংঘাত ঘটে গিয়ে সমস্ত পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে, তাতে আমি খুব বেশি অবাক হবো না। হয়তো একটা সময় আবারও আমাদের পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে আর একজন মানুষের খোঁজে, হয়তো আবারও আমাদের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠি লিখে পাঠাতে হবে দূরের একজন প্রিয় মানুষের কাছে। হয়তো সুসজ্জিত দালান-কোঠা ছেড়ে আমাদের আবারও গুহাবাসী হতে হবে। ভবিষ্যতের কথা যদিও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না, তবে— সবকিছুই সেই পূর্বের অবস্থানে বারবার করে ফিরে ফিরে আসে, এভাবেই একটি চক্র পূর্ণ হয়। জীবনের চক্র কিংবা সময়ের চক্র।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

২৯.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০২৪

"স্বপ্নহীন জীবন"

 জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে আজকাল নিজের মধ্যে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো— কোনো কিছুর প্রতি বিশেষ ভাবে আগ্রহ কিংবা উদ্দীপনা হ্রাস পাওয়া। একটি চুইংগামের প্যাকেট খুলে ওটা মুখে নিয়ে তিন-চার মিনিট রাখার পর মিষ্টি স্বাদটা হারিয়ে গেলেও সেটাকে বহুক্ষণ ধরে মুখে নিয়ে চিবানোর মতো একটি অর্থহীন জাবরকাটা টাইপের বিষয় মনে হচ্ছে ইদানীংকালের যাপিত জীবনটাকে। কী এমন সুমহান উদ্দেশ্য কে চরিতার্থ করার জন্য এতটা উৎসাহ-উদ্দীপনার সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনকে টেনেটুনে আরও লম্বা বানাচ্ছি? যে দু-চারটে ছোট ছোট লোভ আর মোহ কে পুঁজি করে পিঁপড়ের সারির মতন সামনে এগিয়ে চলেছে এই মানবসম্প্রদায়, সেটাকে নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করে কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। বিশাল কিছু প্রাপ্তি অথবা বড়সড় একটা ব্যর্থতার যে মানসিক অনুভূতি, অর্থাৎ তীব্র সুখে উথলে ওঠা কিংবা প্রচণ্ড বেদনায় ভেঙে যাওয়ার মতো এইসব ক্ষণিকের বিষয় গুলোকে একেবারে ঠুনকো মনে হচ্ছে। সেই কবেকার কোন প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষকে কিছু ছোটখাটো বুঝ দেওয়া হয়েছিল— সেগুলো নিয়ে এখনও পর্যন্ত মানুষেরা ঘানিটানা গরুর মতো একই চক্রের মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। চক্রের বাইরে গিয়ে ভাবার মতো ফুরসত কোথায় মানুষের? ঐ যে প্রচলিত দু-চারটে ছোট ছোট লোভ আর মোহ মানুষের মস্তিষ্কে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে, ওগুলোই মগজের মধ্যে ক্রমাগত ভাবে একই সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে। আহারে আমার একরত্তি জীবন! 


আজকাল সকালে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার পরেও বেশ কিছুক্ষণ ধরে শরীর এবং মন ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে থাকে। এটা তো মোটেই বার্ধক্যজনিত কারণে হচ্ছে না, কারণ সেই পর্যায়ের বার্ধক্যে এখনো পর্যন্ত যাইনি। তাহলে উৎসাহ-উদ্দীপনা হঠাৎ করে এতটা তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে কেন? এই বিষয়ে একটা যুৎসই উদাহরণ দিচ্ছি। সপ্তাহ দেড়েক আগে আমার একজন পুরনো দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হঠাৎ ফোন করে বললেন— বিকেলে যেন তার সাথে দেখা করি। বন্ধুটি সদ্য কোলকাতা থেকে ফিরেছেন এবং তার কাছে একটি উন্নত মানের ওয়াইনের বোতল রয়েছে। অর্থাৎ বহুদিন পর দুই বন্ধু মিলে চুটিয়ে একটা আড্ডা হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমি তার সাথে দেখা করতে গেলাম না। অযুহাত হিসেবে মিথ্যা কথা বললাম যে, আমার শরীর টা বেশ অসুস্থ। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডার মোহ কিংবা অ্যালকোহলের লোভ আমাকে আমার অবস্থান থেকে নাড়াতে পারেনি। এভাবে জাগতিক বিষয় থেকে নির্মোহ হয়ে যাওয়া আমার কাছে স্বাভাবিক বিষয় মনে হচ্ছে না। যদিও স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিকতার নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই। আমি এটা বললাম বেশিরভাগ মানুষ যে ফর্মুলায় বেঁচে আছে, সেটাকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে। খুব তীব্রতর একধরণের ঈর্ষা বোধ হচ্ছে বৃহৎ সংখ্যক মানুষের ওপর— যারা তীব্র দাবদাহে বৃষ্টির জন্যে চাতকের মতো হাপিত্যেশ করছে এবং বৃষ্টি নামার পর ভিজতে ভিজতে উদ্বাহু নৃত্য করছে, যারা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভিজে ভিজে তাদের প্রিয় নেতার জন্যে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট ভিক্ষা করছে, যারা লোন তুলে হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলছে, যারা সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্নে নিজের সবটুকু মেধা উজাড় করে অপরিচিত একটি মেয়েকে পটাচ্ছে, যারা অসংখ্য মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজের ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াচ্ছে, যারা সারাদিন রোদে পুড়ে ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফেরার আগে বউয়ের জন্য ট্যালকম পাউডার কিনছে, যারা গাঁজা টেনে পথচারীদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নির্বিকার ভাবে স্টিয়ারিং ধরে ঝিমাচ্ছে, যারা বিয়েবাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে একটা পান চিবাতে চিবাতে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, যারা আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান হিসেবে নানান রাষ্ট্রের পন্য বয়কট করে বেড়াচ্ছে, যারা গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে বাঁচার জন্যে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করছে, যারা সাধারণ একটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েও নিত্যনতুন স্বপ্নে বিভোর হচ্ছে। এইসব মানুষের ভীড়ে মিশে গিয়ে তাদের স্রোতে ভেসে গিয়ে আজকাল বাঁচতে ইচ্ছে করে। দু-চারটি ছোট ছোট লোভ আর মোহ কে পুঁজি করে ক্ষুদ্র একটি বৃত্তের মধ্যে বারংবার ঘুরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভেতরকার সমস্ত অনবদমিত আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার কারণে সেটা কোনোভাবেই আর হচ্ছে না। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে ভেবে খুবই অস্বস্তির মধ্যে আছি। আরিব্বাস, আজকের তারিখটাও দেখতে পাচ্ছি সেই সাত-পাঁচ! 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

০৭.০৫.২০২৪

সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

"হাইলাইট অফ হিরোইজম"

বহুদিন ধরে দেখে আসছি একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষ নিজেদের সম্পর্কে বিশাল বিশাল পজিটিভ কথাবার্তা চারপাশের মানুষের মধ্যে চাউর করে দিয়ে সোসাইটির সকল মানুষের কাছে নিজেদেরকে হিরো হিসেবে প্রমাণ করে। তাদের এই হিরো হয়ে ওঠার নেপথ্যে থাকে একটা চাটুকার গোষ্ঠী। তেলবাজ এইসব চামচাগণ চতুর্পাশে ঘুরে ঘুরে তাদের হিরোর গুণাগুণ এবং অসাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে থাকে। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো— বাংলাদেশি সমাজব্যবস্থায় খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষেরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং সরল। তারা খুব সহজেই মুখরোচক কথাবার্তা শুনে সেটাকে সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলে। তারা একটা বারের জন্যেও বিষয়টির উদ্দেশ্য কিংবা ভিত্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে যায় না। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি রমরমা ব্যবসা চালু রয়েছে, যার নাম 'চ্যারিটি ফাউন্ডেশন' বা দাতব্য সংস্থা। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে নিঃসন্দেহে এটি একটি অলাভজনক কিংবা সেবামূলক কার্যক্রম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কি আদৌ তেমন?


মনে করুণ, আমার কাছে কিছু নগদ অর্থ আছে। আমি সেই টাকা ইনভেস্ট করে কয়েক বালতি ঠান্ডা শরবত তৈরি করে কাঠফাটা রোদের মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিনামূল্যে অসংখ্য তৃষ্ণার্ত মানুষকে সেটা খেতে দিলাম। আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি সাথে সাথে আমার মহান পরোপকারী মানসিকতা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলতে শুরু করবে। প্রাথমিক ভাবে আমি মানুষের থেকে একটা পজিটিভ অ্যাটেনশন পেয়ে যাবো। এভাবে আরও দুই দিন এই একই কাজ আমি পার্শ্ববর্তী এলাকায় করবো, ততক্ষণে আমার সাথে আরও দুই-একজনকে জুটিয়ে নেবো, যারা আমার এই মহৎ উদ্যোগ মানুষের কাছে প্রচার করবে। এরপর আমি সমাজের কিছু বিত্তবান মানুষের সাথে আমার এই 'মহৎ' চিন্তা টা শেয়ার করে তাদের কাছে অর্থনৈতিক হেল্প চাইবো। দশজন বিত্তবানের কাছে গেলে তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন আমার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে আমার জন্য ছোট একটা ফান্ড বরাদ্দ দেবে। এরপর আমি কিছু টাকা খরচ করে দুই-একজন সাংবাদিক দিয়ে আমার কাজটিকে নিয়ে কয়েকটি ফিচার করাবো, এর সাথে সাথে আমার নিজস্ব চাটুকার বাহিনী তো নিয়মিত ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি সহ আমার গুণগান করতে থাকবে। পরবর্তী সময়ে আমার জন্য ডোনেশন পাওয়া খুব বেশি কঠিন হবে না। এভাবেই গ্রীষ্মে মানুষের পাশে দাঁড়াবো, তীব্র শীতে পাশে দাঁড়াবো, বন্যায় পাশে দাঁড়াবো, ধর্মীয় উৎসবের দিনে পাশে দাঁড়াবো। আমার এই পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া বারোমাস ধরে চলতেই থাকবে। ততদিনে আমার একাউন্টের স্বাস্থ্যও অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। দুই লাখ টাকা ডোনেশন পেলে পঁচিশ হাজার প্রচারের জন্য, পঁচিশ হাজার চাটুকার গোষ্ঠীকে দিয়ে এরপর পঞ্চাশ হাজার রাস্তার ছিন্নমূল মানুষের জন্য ব্যায় করলেও আমার পকেটে এক লাখ থেকে যাচ্ছে। এই হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়ার সাদামাটা বিষয়। কিন্তু আমি সর্বোচ্চ লাভবান হবো কিভাবে জানেন? সেটার নাম 'পাবলিক সিম্প্যাথি'। আমি রাতারাতি গণমানুষের চোখে একজন জনদরদী মহান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবো।


এবারে বাস্তব সত্যি টা নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করা যাক। আমরা যে আমাদের চারপাশে এতো এতো মহানুভব তথাকথিত মহাপুরুষদের দেখতে পাই, এরা কেউ কি সত্যিকার অর্থে তাই? স্বতন্ত্র একটি সত্তা হিসেবে হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির মধ্যে অসংখ্য অসংখ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পৃথিবীতে কেউ-ই বাস্তবতার ভিত্তিতে মহাপুরুষ নয়। 'মহাপুরুষ' ব্যাপারটির কনসেপ্ট মূলত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে এসেছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। একটি বায়োলজিক্যাল প্রাণী হিসেবে মানুষ খুবই ত্রুটিযুক্ত। মানুষের মধ্যে লোভ, আকাঙ্খা, স্বার্থ, জাগতিক চাহিদা থাকাটাই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কেউ যদি আপনাকে নিজের থেকে ঘোষণা দিয়ে বলে যে— সে এইসব জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত কিংবা তার মধ্যে এইসব প্রথাগত লোভ-লালসা কিংবা আকাঙ্ক্ষা কাজ করে না, তাহলে ধরে নেবেন লোকটি মিথ্যে বলছে অথবা তার সিরিয়াস ধরনের মানসিক সমস্যা আছে। একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণী হিসেবে একজন মানুষের পক্ষে তার শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড কে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। আর তার শরীরবৃত্তীয় সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অংশই হলো তার ক্ষুধাতৃষ্ণা, ঘুম, বিশ্রাম, যৌনতা, মানবিক আবেগ, লোভ, মোহ, জাগতিক চাহিদা ইত্যাদি। এই থার্ড ডাইমেনশনাল প্ল্যানেটে বেঁচে থেকে মোহমুক্ত হয়ে বাঁচা কিংবা গণমানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেবার বিষয়টি নিছক হিপোক্রেসি। যারা এই সিম্পল বিষয়টি বুঝতে পারে না, তারাই কথিত এইসব হিরোদের হিরোগিরি নিয়ে অষ্টপ্রহর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকে, আর চারপাশে এদেরকে নিয়ে জয়গান করতে করতে নিজেদের ধন্য মনে করে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

"নিত্যানন্দ: এক প্রাচীণ বাটপারের ইতিকথা"



আমরা বাঙালিরা যে পৃথিবীর নিকৃষ্টতর একটি জাতি, এটা সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমাণিত। বাঙালি মানে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের কথা বলছি। বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো— এরা নিজেরা তেমন একটা পড়াশোনা করে না, ঐতিহাসিক বিষয়াবলী সম্পর্কেও এরা ন্যূনতম খোঁজখবর রাখে না। এরা কি পারে জানেন? কেউ একটা কথা চালু করে দিলে এরা চোখকান বুঁজে সেই কথাটিকে ধরে অন্ধের মতো এগিয়ে যায়, তাদের দেখাদেখি আরও অনেক মানুষ 'ঝাঁকের কৈ' হয়ে হুজুগে মেতে গিয়ে বিষয়টিকে নিয়ে একেবারে হুলস্থুল করে ফেলে। দুঃখজনক বিষয় হলো— এরা কেউ-ই একটা বারের জন্যেও যাচাই করতে যায় না বিষয়টির সত্যতা কতটুকু! এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি ভুল মতবাদ বাঙালি সমাজে সত্যের মতো প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমি শৈশবে বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির পাশে এক্সট্রা দুটি মূর্তি লক্ষ্য করতাম, যারা দুইপাশে দাঁড়িয়ে থেকে  নিজেদের দুই বাহু তুলে রেখেছেন। এদের নাম একত্রে গৌর-নিতাই। এদের মধ্যে গৌর কিংবা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু কিংবা শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। ১৫০০ শতকের প্রথমার্ধে তিনি 'বৈষ্ণব আন্দোলন' গড়ে তুলেছিলেন। এটা ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও পরিচিত। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। চৈতন্য দেবের সঙ্গে অদ্বৈতাচার্য নামের একজন বৈষ্ণব দার্শনিক সেই সময়ে মানবতাবাদী এই আন্দোলন কে বেগবান করেছিলেন। গৌরাঙ্গ কিংবা শ্রীচৈতন্য এরপর সন্ন্যাস গ্রহণ করে নবদ্বীপ থেকে উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত পুরী নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করেন। আমি শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অথেনটিক ইতিহাস এবং নানান ধরনের সোর্স অনুসন্ধান করে যে বিষয় টা দেখে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছি, সেটা ছিল— শ্রীচৈতন্য দেবের বিখ্যাত এই বৈষ্ণব আন্দোলনে নিতাই কিংবা নিত্যানন্দ নামের মানুষটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কম, অথচ পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে এই মানুষটিকে শ্রীচৈতন্যের প্রধান পার্শ্বনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে।


শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপে থাকাকালীন সময়ে অদ্বৈতাচার্যের সঙ্গে বৈষ্ণব ভক্তি মতবাদ সংক্রান্ত বিশদ দার্শনিক চিন্তাভাবনা শেয়ার করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি এককভাবে সেই আন্দোলন কে উড়িষ্যা রাজ্য পর্যন্ত বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। নবদ্বীপ এবং উড়িষ্যার পুরীধামে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন যে বিশেষ মানুষটি— তার নাম ছিল স্বরূপ দামোদর। শ্রীচৈতন্য দেব কে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা যখন হত্যা করেছিল, তখনও শ্রীচৈতন্যের কাছাকাছি স্বরূপ দামোদর উপস্থিত ছিলেন। স্বরূপ দামোদর নিজেও নিহত হয়েছিলেন জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের হাতে। আমার ভীষণ ভাবে জানার আগ্রহ ছিল যে, নিতাই কিভাবে শ্রীচৈতন্যের প্রধান পার্ষদ হলেন? কোন জাদুমন্ত্র বলে অদ্বৈতাচার্য এবং স্বরূপ দামোদর কে টপকে গিয়ে নিত্যানন্দ শীর্ষে চলে গেলেন? এর উত্তর খুঁজে পেলাম সহজেই। নিত্যানন্দের জন্ম হয়েছিল বীরভূম জেলার একচক্রা গ্রামে। তিনি যৌবনকালে নানান জায়গা ঘুরে নবদ্বীপে গেলে, সেখানে শ্রীচৈতন্যের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এরপর তিনি কিছুদিন সেখানে চৈতন্য দেবের সঙ্গে নগর কীর্তণ করেন। হরিনাম সংকীর্তন করার সময়ে একবার নবদ্বীপের দুইজন নগরকোটাল জগন্নাথ এবং মাধব দাস (জগাই-মাধাই) মদ্যপ অবস্থায় নিত্যানন্দ কে প্রহার করেছিল। মূলত এই মার খেয়ে নিতাই পরিচিতি লাভ করেন। এরপর শ্রীচৈতন্য দেব নবদ্বীপ ছেড়ে পুরী চলে গেলে নিতাই কুঞ্জবাটীতে গিয়ে অবস্থান করেন। নিত্যানন্দ বর্ধমান জেলার সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবী কে বিয়ে করেছিলেন। এই পত্নী দ্বয়ের সন্তানেরা পরবর্তীকালে সবখানে ঘুরে ঘুরে নিতাইয়ের মাহাত্ম্য প্রচার করেছে এবং নির্বোধ বাঙালিরা সেটাই ভক্তিভরে বিশ্বাস করেছে। আমি বলছিনা যে— বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনে নিত্যানন্দের কোন ভূমিকা নেই, নিশ্চয়ই ভূমিকা আছে, তবে সেটা ক্ষীণ। তাকে যেভাবে শ্রীচৈতন্য দেবের প্রধান পার্ষদ হিসেবে সবখানে দেখানো হয়, এটা একটা জোচ্চুরি। কয়েকদিন আগে আমি একটি পদাবলী কীর্তণ গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে কীর্তনগায়ক কিছুক্ষণ পরপর 'জয় নিতাই' 'জয় নিতাই' বলে আওয়াজ করছিলেন। তার গান শেষ হবার পর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— 'আপনি কি স্বরূপ দামোদর সম্পর্কে জানেন?' তিনি বিনীতভাবে আমাকে জানালেন যে, তিনি স্বরূপ দামোদর সম্পর্কে কিছু জানেন না। আমার তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিষয় মনে হয়েছিল তখন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পাননি, কিন্তু চারপাশে বিরাট সংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পাওয়া যায়— যারা ক্ষমতাসীন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সাথে লবিং করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন। শ্রী নিত্যানন্দ হলেন তেমনই একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, আর স্বরূপ দামোদর হলেন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া শ্রীচৈতন্য দেবের সেই বিশ্বস্ত, হতভাগ্য সার্বক্ষণিক সঙ্গী।


— কৃষ্ণেন্দু দাস ||

শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪

'সাদি মহম্মদ এবং একটি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা'

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের আরও একটু ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। সত্যিকার অর্থেই এটা ভীষণ জরুরী। আজকাল আমরা নিজেদের কিছু মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সম্পর্কে অনেক কিছুই না বুঝে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিই এবং এর কারণে আমরা নিজেরা তো অতি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হই, সেই সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অসংখ্য মানুষ। ধরা যাক— আমি একজন প্রচণ্ড রকম অভিমানী এবং ভীষণভাবে অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। নিজেকে আমি সবসময় গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করি। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই আমি আমার চারপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হবো, তাই না? এর জন্যে আমি যদি দুঃখ নিয়ে চারপাশের মানুষদের দায়ী করে বলি, 'কেউ আমাকে পছন্দ করে না কিংবা আমার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ নেই!' তাহলে এটা কি আদৌ ঠিক হবে?


ধরা যাক— আমার কয়েকজন স্কুল জীবনের সহপাঠী এখন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অত্যন্ত চমৎকার। পক্ষান্তরে আমি একটি নিরেট ছাপোষা ধরনের নিম্নমানের জীবনযাপন করি। এক্ষেত্রে আমার নিম্নমানের জীবনযাপনের দায় কি আমার এই সমাজব্যবস্থার, আশেপাশের মানুষের, এই রাষ্ট্রের নাকি একান্তই আমার নিজের? এর দায়টা পুরোপুরিভাবেই আমার নিজের। কারণ আমি জোরালো ভাবে সেইসব চেষ্টাগুলো করিনি, যেটা আমার সফল বন্ধুটি করেছে। নিজেকে আমি সাহসী ভাবে সবক্ষেত্রে সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায় উপস্থাপন করতে পারিনি বলেই আজকে আমি ব্যর্থ। অধিকাংশ মানুষের মস্তবড় এক মনস্তাত্ত্বিক ঝামেলার জায়গা হলো— তারা নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতার দায়ভার এড়াবার কৌশল হিসেবে পারিপার্শ্বিকতা কে দায়ী করে এবং নিজের মনের কাছে নিজেকে স্বচ্ছ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ভ্রম তাদের অজ্ঞাতেই তাদের অবচেতনে তৈরি হয় নিজের কাছে নিজেকে ত্রুটিহীণ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু এটা ভীষণ ভুল একটি বিষয়, যা খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষ বুঝতেই পারে না।


ধরা যাক— আমার শিক্ষা জীবনের একজন সহপাঠীর নাম 'বন্যা'। ছাত্রজীবনে মেধার দিক থেকে আমি সবসময়ই বন্যার চেয়ে এগিয়ে ছিলাম। এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে বন্যা আমাকে টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল আমি সর্বক্ষেত্রে তার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছি। বন্যা একাগ্রতা নিয়ে প্রচুর চেষ্টা করে একটি ভালো চাকরি জোগাড় করেছে, নানান ধরনের সামাজিক কার্যক্রমের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছে, নিজের যতটুকু প্রতিভা আর যোগ্যতা ছিল— তার পুরোটাই সে ব্যবহার করেছে। ফলাফল হিসেবে সে তার চারপাশে নিজেকে চমৎকার ভাবে প্রকাশিত করতে সক্ষম হয়েছে। সবাই তাকে নিয়েই মেতে থাকে, তার প্রশংসা করে। নিজের সংসারেও বন্যা স্বামী-সন্তান নিয়ে একটি পরিপূর্ণ জীবনকে যাপন করে যাচ্ছে। আর অপরদিকে আমি পেশাগত জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ছোটাছুটি করিনি, আমি ভেবেছি আমার যোগ্যতা দেখে মানুষ আমাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যখন ডাকেনি, আমি নিজেও আর যাইনি। আমি সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে থেকেছি, বিয়েথা করিনি, সংসারে নিজেকে জড়াইনি। নিজের প্রতিভা আর যোগ্যতা নিজের মধ্যে আটকে রেখেছি। সবসময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থেকে সর্বক্ষণ প্রাণপণে ভেবেছি— 'আমার যোগ্যতা আছে, নিশ্চয়ই মানুষ আমাকে ডেকে নিয়ে যাবে।' কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ বাণীটি ভুলে গিয়েছিলাম— 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।' আমি সামনের দিকে একলা এগিয়ে যাইনি, আমি ভুল করে রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি কথা আঁকড়ে ধরে ছিলাম— 'আমার জনম গেল বৃথা কাজে, আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে।' সত্যিই আমি ঘরের মাঝে বসে থেকে চিন্তা করেছি— আমার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন টা করা হয়নি। আমাকে ঠকানো হয়েছে, আমার সাথে অবিচার করা হয়েছে। অতএব, আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি— এই জীবন আমি রাখবো না, আমি এবার গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করবো! কারণ আমি যে ভীষণ অভিমানী এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। ব্যাস— মিটে গেল সব!


তাহলে বিষয় টা কি দাঁড়াচ্ছে? একজন মানুষ যদি এভাবে নিজের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং তারপর একটি হঠকারী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তার ফলাফল কি তার জন্য সুন্দর হয়? তার এই কার্যক্রম তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরও অসংখ্য মানুষ, এমন কি গোটা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করতে পারে— এটা কি ঘুণাক্ষরেও তার ভাবনায় আসে? আমরা মানুষেরা জন্মগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। প্রবাদে বলা হয়, 'মানুষ মাত্রই ভুল আছে।' কিন্তু সেই ভুলটা যতটুকু সম্ভব কম করার দায়িত্ব তো আমাদের নিজেদেরই, কারণ চিন্তাভাবনা করে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো বোধবুদ্ধি তো আমাদের আছে। তাহলে কেন আমাদের নিজস্ব বোধের সঠিক প্রয়োগ টা ঘটবে না? কেন শুধুমাত্র আমার নিজস্ব আত্মনিমগ্নতার দায় সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের এবং আশেপাশের সমস্ত মানুষের কাছে নিজেকে আরও ভুলভাবে রিপ্রেজেন্ট করবো? আমরা বরাবরই একটি কমন ব্যাপার ভুলে যাই, তা হলো— আমাদের যার যার নিজস্ব ব্যর্থতার দায়ভার কিন্তু অন্য সব মানুষের নয়। তারাও এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ, তাদের নিজেদেরও আলাদা আলাদা জীবন আছে। তাদের জীবনেও কিন্তু সফলতা কিংবা ব্যর্থতা জড়িত আছে। তাদের ব্যর্থতার দায়ভার যদি আমি না গ্রহণ করি, তাহলে আমিও কিন্তু আমার নিজস্ব ব্যর্থতার জন্যে অন্যকে দায়ী করতে পারি না। কোনভাবেই এটা পারি না। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১৬.০৩.২০২৪ খ্রিঃ

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

'আত্মতত্ত্ব'

 সৌরজগতের এই তৃতীয় গ্রহটিতে যেদিন সর্বপ্রথম প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়েছিল, সেই প্রাচীণ সময় থেকে শুরু করে আজকের এই দিন পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের অনেক কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। জলবায়ুগত কারণ এবং অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার স্বার্থে অসংখ্য প্রাণী নিজেদের নানান ভাবে বিবর্তিত করে তাদের অস্তিত্ব দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, আবার বিশাল সংখ্যক প্রাণী এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে প্রাণীদের জন্যে আদি ও অকৃত্রিম নিয়ম-ই হলো সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।


'সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' কথাটি দিয়ে বোঝানো হয়েছিল— যোগ্যতম দলই তাদের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারে। মূল বিষয় হলো টিকে থাকাটা ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া টাইপের বিষয়গুলো অনেকটা হেরে যাবার নামান্তর। হেরে গেলে বেশিদিন কেউ আর মনে রাখে না। জিতে যাওয়া কিংবা টিকে থাকাটাই হচ্ছে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে নিজেকে জানান দেবার আদিমতম সত্য। পোস্টমডার্নিজমের এই মুহূর্তে এসে ভীষণ প্রকটভাবে একটি বিষয় চোখে পড়ে। বিষয়টি হলো— এখনকার দিনে মানুষ খুব অল্পতেই মারাত্মক রকম হতাশ। খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, একেবারে সামান্য বিষয় নিয়েই মানুষ আজকাল নিজেকে শেষ করে দিতেও দ্বিধা করছে না। তারচেয়ে অবাক বিষয় হলো এই স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষেও কেউ কেউ আজকাল যুক্তি দাঁড় করিয়ে বিষয়টিকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করে। কাউকে কাউকে এখন জোরেশোরে বলতে শুনি— নিজেকে নিজে ধ্বংস করে দেওয়া যার যার নিজস্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা। এসব কুযুক্তির ওপরে দাঁড়িয়ে লাগামহীন ভাবে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে স্বেচ্ছামৃত্যুর মিছিল। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আসেনি, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। ভালো ইন্সটিটিউশনে চান্স হয়নি, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। ভালোবাসার মানুষটি ছেড়ে চলে গেছে, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। দাম্পত্য জীবনে অশান্তি হচ্ছে, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। কেন রে ভাই, জীবন টা কি এতটাই বেশি ঠুনকো! অন্য রকম কিছু কি ভাবা যায় না? আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে না গিয়ে বরং নিজের ক্ষমতার ওপর আস্থা রেখে নতুন কিছু বের করার চেষ্টা করা যায় না?


আমরা মানুষেরা অত্যন্ত চিন্তাশীল প্রাণী। উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্যেই আমাদের আজকের বিকাশ। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর সেই আদিম যুগ থেকে আস্তে আস্তে নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আজ আমরা মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছি নতুন নতুন গ্রহের সন্ধানে। তাহলে সেই চমৎকার উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ হয়ে এই ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্তের পেছনে কেন দৌড়াচ্ছি আমরা? আমাদের আবারও সেই পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হবে। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে নিজেদের মস্তিষ্কের ক্ষমতার ওপর। ছোটখাটো আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। পৃথিবীতে একটি স্বতন্ত্র প্রাণী হিসেবে সেই আদিমতম সত্যটি মাথায় রাখতে হবে। তা হলো— সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করে নিজেকে টিকিয়ে রাখা। কারণ একটি প্রাণী হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করার চেয়ে শ্রেষ্ঠতম বিষয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪

'জেমস বোয়েন এবং তার বব'

দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডের 'সারে' নামক কাউন্টি শহরে জেমস বোয়েন নামে একজন গৃহহীন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বাস করতেন। তার সম্পূর্ণ নাম জেমস অ্যান্থনি বোয়েন। শৈশবে তার বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং সেই সময়ে তিনি তার মায়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ব্যায়বহুল শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিজের মনঃসংযোগের ঘাটতির কারণে মাঝপথে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর মাত্র সতেরো বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষনে তিনি আবারও তার জন্মভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডের সারে রাজ্যে ফিরে তিনি নানান পেশায় যুক্ত হবার চেষ্টা করার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা শুরু করেছিলেন। চলমান জীবনের নানান খুটিনাটি অসংগতি এবং জটিলতা তার মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে দিয়েছিল সেই সময়। ফলশ্রুতিতে তিনি অসৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হেরোইনে আসক্ত হয়ে যান। মাদকাসক্ত হবার কারণে তার সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ ছিল না। তিনি মাঝেমধ্যে রাতের বেলা কোন নির্জন পার্কে কিংবা রাস্তার পাশের যাত্রীছাউনিতে ঘুমিয়ে থাকতেন। নানান ধরনের ছোটখাটো কাজ করে এভাবেই একটি মানবেতর জীবন কেটে যাচ্ছিল জেমস বোয়েনের।


২০০৭ সালের এক সন্ধ্যা বেলায় নির্জন একটি রাস্তা দিয়ে আপনমনে গানের সুর ভাজতে ভাজতে জেমস বোয়েন তার বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিনি রাস্তার পাশে একটি বিড়াল কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেন। তিনি স্বাভাবিক ভাবে বিড়ালটির পাশ কাটিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। পরদিন যথারীতি তিনি তার নানাবিধ ছোটখাটো কাজ করে সন্ধ্যা বেলায় হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন। আর্থিক অনটনের জন্যে ট্যাক্সি ধরার সুযোগ তার ছিল না। তখনও তার ডিনার হয়নি, অথচ পকেটে পড়ে আছে সর্বসাকুল্যে মাত্র কুড়ি পাউন্ড! আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি রাস্তার পাশে তাকালেন এবং গতকালের সেই বিড়ালটিকে আবারও একই জায়গায় বসে থাকতে দেখলেন। এবার তিনি খানিকটা কৌতূহলী হয়ে বিড়ালটির কাছে গিয়ে দেখলেন— ওটার গলায় কোন বেল্ট কিংবা ট্যাগ নেই, বিড়ালটি কিছুটা রুগ্ন এবং ওর মুখে আঁচড়ের দাগ। এসব দেখে জেমস বোয়েনের মন খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি নিজেও একজন গৃহহীন ধরনের রাস্তার মানুষ। তিনি বিড়ালটিকে তুলে নিয়ে আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে বিড়ালটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— এটা কারো হারিয়ে যাওয়া বিড়াল কিনা, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিড়ালটির কোন মালিক খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি তখন অসুস্থ বিড়ালটিকে নিয়ে একজন পশু চিকিৎসকের দারস্থ হলেন। চিকিৎসার খরচ বাবদ তিনি তার কাছে থাকা বিশ পাউন্ডের পুরোটাই দিয়ে দিলেন। এরপর বিড়ালটি কিছুটা সুস্থ হলে তিনি বিড়ালটিকে নিয়ে ঠিক সেই জায়গায় হাজির হলেন— যেখানে তিনি বিড়ালটিকে পেয়েছিলেন। তিনি ওটাকে ওখানে ছেড়ে দিলেন, যাতে বিড়ালটি তার ঠিকানায় নিজে নিজে ফিরে যেতে পারে। জেমস বোয়েন ওটাকে রেখে নিজের ঘরের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন এবং একটা সময় হঠাৎ খেয়াল করলেন যে, বিড়ালটি তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তিনি তখন বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। তিনি বিড়ালটির নাম রাখলেন 'বব'।


জেমস বোয়েন অনেকদিন ধরে মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কেন জানি কোনভাবেই এটা সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ করে এই বিড়ালটিকে নিজের কাছে এনে রাখার পর তার মনে আবারও সুস্থভাবে বাঁচার ইচ্ছে জাগ্রত হলো। তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নেওয়া শুরু করলেন এবং আবারও নিজের মতো করে পুনরায় সঙ্গীতচর্চা শুরু করলেন। দৃঢ়ভাবে মনঃসংযোগ ঘটিয়ে এরপর একটা সময়ে তিনি মাদকদ্রব্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। এরপর তিনি একটা গীটার নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইতেন এবং বব নামের বিড়ালটি তার পাশে চুপচাপ বসে থাকতো। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন, তাতে তার এবং ববের জীবন মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল। প্রায়ই জেমস বোয়েন কে হাতে গীটার এবং কাঁধে পোষা বিড়াল নিয়ে রাস্তায় চলতে দেখা যেতো। স্থানীয় মানুষদের কাছে আস্তে আস্তে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এভাবেই একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার গান শুনতে আসা একজন শ্রোতা তাকে একটি বই লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন— যিনি ছিলেন একজন প্রকাশক। জেমস বোয়েন সেই প্রকাশকের কথা বিবেচনা করে নিজের জীবন এবং বব নামের বিড়ালটির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে 'এ স্ট্রিট ক্যাট নেমড বব' নামে একটি বই লিখলেন। বইটি ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বইটি 'বেস্টসেলার বুক' হবার কৃতিত্ব অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে এই বইটি নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি হয়, যেটা ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে একসাথে থাকার পর ২০২০ সালে বব নামের এই বিড়ালটি রাস্তায় একটি গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। তখন বিড়ালটির বয়স হয়েছিল আনুমানিক পনের বছর।


আমি কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি বিচ্ছিন্ন ছবি দেখে সেটাকে নিজের প্রোফাইলের স্টোরি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম— যেখানে একজন লোক রাস্তার পাশে গলায় গীটার ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং তার পায়ের কাছে একটি বিড়াল চুপচাপ বসে ছিল। গতকাল রাতে হঠাৎ কি মনে করে 'স্ট্রিট মিউজিশিয়ান উইথ ক্যাট' লিখে গুগলে সার্চ দেবার পর জেমস বোয়েন সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানতে পারলাম। অনেক সময় একটি চতুষ্পদ প্রাণীও যে একজন মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং ভীষণ আপনজন হয়ে উঠতে পারে, তার জলন্ত উদাহরণ হলেন জেমস বোয়েন।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

 ১০.০৩.২০২৪ খ্রিঃ

বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

'যাপিত এইসব দিন'


কুয়াশাচ্ছন্ন শীতার্ত দিনগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু দেরি করেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে। শরীরের মাঝে কিংবা অবচেতনে কোথায় যেন একটা আড়ষ্টতা বেশ ভালোভাবেই থাবা গেড়ে বসে থাকে। কম্বল টা আরও খানিকটা টেনে কান এবং গলা ঢেকেঢুকে দিব্যি বেলা এগারোটা পর্যন্ত পড়ে থাকতে ভালোই লাগে আমার। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই বিচিত্র অভ্যাস টা যদিও আমার আগে কখনও ছিল না, বছর দুয়েক ধরে এভাবে থেকে আরাম বোধ করি। এটাই বয়স হয়ে যাবার সেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। বুড়ো হচ্ছি আমি। ইদানীং চিন্তাভাবনার মধ্যেও আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে নিজেই কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে থাকি। শরীরের মধ্যেও এসেছে শ্লথ হয়ে যাবার সুক্ষ্ম অনুভূতি। একটি বিষয় খুব নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতে পারি আজকাল। মানুষের পুরোটা জীবনকালে দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় আসে। একটি হলো তার বাল্য থেকে যৌবনে পদার্পণের সেই বিশেষ সন্ধিক্ষণ, যাকে বলে বয়ঃসন্ধিকাল, আর দ্বিতীয়টি হলো তার যৌবন থেকে বার্ধক্যে পদার্পণের বিশেষ সন্ধিক্ষণ। আমরা আমাদের প্রচলিত জীবনে শুধুমাত্র বাল্য থেকে যৌবনে যাবার সময়টা নিয়েই বেশি আলোচনা করি। এই স্টেজে থাকা কিশোর-কিশোরীদের মনো-দৈহিক অবস্থার বিবিধ বর্ণনা করে থাকি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পে লেখক লিখেছিলেন, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।' রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সমাপ্তি' গল্পে লিখেছিলেন, 'কখন বিধাতা তাঁর নিপুণ অস্ত্র দ্বারা মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই।'


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র কৈশোরের এই বয়ঃসন্ধিকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিধ বর্ণনা করে গেছেন। অথচ একজন মানুষ যখন তার যৌবনকাল অতিক্রান্ত করে বার্ধক্যের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে, সেই সময়কার একজন মানুষের মনো-দৈহিক পরিবর্তন কিংবা সেই মুহূর্তে দাঁড়ানো একজন মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেভাবে আলোচনা করতে তেমন কেউ আগ্রহী হননি। ঠিক যেভাবে তোরো-চৌদ্দ বছরের একজন মানুষ তার আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন দেখে চমকে যায়, সেটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে না পেরে একধরণের হীনমন্যতায় ভোগে, একইভাবে চল্লিশ বা একচল্লিশ বছর পার করা একজন মানুষের জন্যেও তার ব্যক্তিগত জীবনের আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন দেখে বিষ্মিত হওয়া এবং এটার সঠিক কোন ব্যাখ্যা না পেয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার কষ্টকর অনুভূতি হয়। এই বিশেষ স্টেজ টা অনেকেই পার করে গেছেন এবং আরও অনেকেই পার করে যাবেন। যারা এটা পার হয়ে গেছেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন এই সময়টিতে তাদের কেমন আকষ্মিক অনুভূতি হয়েছিল। আমি এখন এই স্টেজে দাঁড়িয়ে এটাকে বুঝতে চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তের সবচেয়ে খারাপ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হলো কোনকিছুতে আগ্রহ না পাওয়া এবং মাঝেমধ্যে সবকিছুকেই অর্থহীন মনে হওয়া। এই সময়েই সম্ভবত একজন মানুষ তার জীবনে 'কি পেলাম আর কি হারালাম' টাইপের বিষয় টা প্রথম ভাবতে শুরু করে, আস্তে আস্তে এই ভাবনা টা আরও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায়। এই স্টেজে দাঁড়িয়েই মানুষের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতির প্রথম জন্ম হয়, সেটা হলো চারপাশে অনেক মানুষজন থাকার পরেও অকারণে নিঃসঙ্গতার এক অদ্ভুত অনুভূতি। আমি অসংখ্য অসংখ্য পুরোদস্তুর সংসারী মানুষের সাথে কথা বলে দেখেছি, তাদের এই সময়ে এসে এই বিশেষ অনুভূতি তৈরি হয়েছে। এই স্টেজে এসেই একজন মানুষ হঠাৎ করে শারীরিক ক্লান্তিকে প্রথম বার প্রচ্ছন্ন ভাবে অনুভব করতে শুরু করে, যেটা দুই-এক বছর আগেও তার ছিল না। এই সময়ে এসে একজন মানুষ হঠাৎ করেই অকারণে কিছুটা খিটখিটে আচরণ শুরু করে, অল্পতেই তার মেজাজ হারাতে শুরু করে। এটা যদিও পরে ব্যালান্স করে নেয়, কিন্তু এই সময়ের এই হঠাৎ ক্ষিপ্ততা তার নিজের জন্যেও অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এই বয়সে এসে একজন মানুষের মধ্যে ধৈর্যের আকষ্মিক একটা অভাব এসে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিনের যাপিত জীবনে তার সেই ধারণ করা মনোযোগে ঘাটতি এসে যায়। দীর্ঘদিনের একজন বাচাল মানুষও এই সময়ে খানিকটা চুপচাপ হয়ে যায়। তোরো-চৌদ্দ বছর বয়সে একজন মানুষ একটু একটু করে নিজেকে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত হয়, কিন্তু এই চল্লিশ-একচল্লিশ বছর বয়সে এসে মানুষ হঠাৎ করে খানিকটা গুটিয়ে যেতে শুরু করে। সহজে বলতে গেলে বাহুল্যটুকু ঝেড়ে ফেলে নিজের নিরেট টুকুকে আশ্রয় করে সে আগামীর জন্য প্রস্তুত হয়। এই সময়ে এসে একজন মানুষ হঠাৎ করে অনেক অপ্রকাশিত বিষয় বুঝে ফেলতে শুরু করে। তার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন টা হয় তার বোধের।


শ্লথ হয়ে যাওয়া চেতনার সাথে নিজের এই আলাপনের মাঝে কখন জানি দুপুর গড়িয়ে গেছে। আজকেও রোদের দেখা মেলেনি। চারপাশে কেমন একটা কুয়াশায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, অকারণে মনটা খানিকটা ডাউন করে দেয়। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু শরীরে কোথায় যেন চিরাচরিত সেই উৎসাহ টা খুঁজে পাচ্ছি না। বিড়ালগুলো গতকাল রাত থেকে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের নিজস্ব প্রাকৃতিক চাহিদার কাছে আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া ওদের কাছে গৌন। সবাই আছে যার যার নিজস্ব প্রয়োজন আর মানিয়ে চলার প্রথাগত অভ্যাসের টানে। পৃথিবীও ঘুরে বেড়াচ্ছে অচিন সেই মহাকর্ষ সূত্র ধরে। দিন ফুরিয়ে রাত আসছে, আবারও রাত ফুরিয়ে দিন। এই কুয়াশায় মোড়া শীতের সময় বিদায় নিয়ে সামনেই আসবে মাঠঘাট চৌচির হওয়া চৈত্রের দাবদাহ। নানান আয়োজনে পূর্ণ হবে সবার জীবন কিংবা উজাড় হবে কেউ কেউ। আহা! কতটাই না তুচ্ছ এই জীবন! অথচ আমরা টেনেটুনে, ফুলিয়ে-ফালিয়ে এটাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করি। এখন কষ্টেসৃষ্টে চারটে মুখে দিতে হবে, মহিমান্বিত না হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কী আর করবো, আমার সময়টাই যে এখন গোলমেলে! ঠাকুরদা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে বলতাম, শুধু তোরো-চৌদ্দ বছর-ই বালাই নয় ঠাকুর মশাই, চল্লিশ-একচল্লিশ বছরও খুব বড় একটা বালাই। যে বালাইনাশক খুঁজতে গিয়ে আজকাল নিজেকে নিয়ে খুব বেশি বিপত্তির মধ্যে আছি। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস/ 🍂

২১.০১.২০২৪ খ্রিঃ

মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

'প্রিয় চল্লিশ বছর'

 

সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে এই প্ল্যানেটে জন্ম নেবার পরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখা এবং অনেক অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ধীরেসুস্থে জীবনটাকে টেনেটুনে আরও খানিকটা দীর্ঘায়িত করা। একটি বহুকোষী প্রাণী হিসেবে আমাদের লাইফের জার্নি টা সত্যিই ভীষণ কঠিন। জন্ম প্রক্রিয়ার শুরুতেই মিলিয়ন মিলিয়ন স্পার্মের সাথে প্রাণপণে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে নিষিক্ত হবার পুরষ্কার প্রাপ্তি শেষে নিজেকে ভ্রূণের রূপে কনভার্ট করা, এরপর একটি ফিটাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ, তারপর... আস্তে আস্তে মাতৃগর্ভে প্রবল ধৈর্য্য সহকারে নিজের পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে একটি বিশেষ দিনে প্রকৃতির অপার মায়ায় ঘেরা এই পৃথিবীতে প্রথম বারের মতো বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া কিংবা প্রথম বারের জন্যে ঠিকরে ওঠা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণে চোখ মেলে বিস্মিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে পরম সৌভাগ্যের বিষয়। জন্ম নেবার আগেই অসংখ্য শিশু মাতৃগর্ভে তার লাইফের জার্নি শেষ করে, অপূর্ব সুন্দর এই পৃথিবীকে আর তাদের দেখার সৌভাগ্য হয় না!
একজন মানব শিশুর জন্ম নেবার পর থেকে তার বেড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। শিশুকালেই তার চারপাশে মারাত্মক কিছু রোগব্যাধি হুমকি হয়ে বিচরণ করে, সেসব রোগের সাথে মোকাবিলা করতে হয়, শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে হয়। এছাড়া খাবারের বিষক্রিয়া, মায়ের অসচেতনতার কারণে হঠাৎ দূর্ঘটনার শিকার হওয়া, ক্ষতিকর প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, জলাশয়ে পড়ে ডুবে যাওয়া, ছেলেধরা কর্তৃক ধৃত হওয়া, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সহ আরও অনেক ধরনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শৈশব থেকে একজন মানুষ কে বেড়ে উঠতে হয়। পরবর্তী সময়ে তার জীবনের দুর্গম পথে প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে খুব বেশি সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলতে হয়। এই যাত্রা বড়ই দুরূহ। কারণ তার চলার পথে ওঁৎ পেতে থাকে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগ, প্রতিটি দিনে থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় নেই হয়ে যাবার সংশয়, থাকে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, থাকে শত্রু দ্বারা নিহত হবার সম্ভাবনা, এছাড়াও থাকে নিজের মধ্যে জেঁকে বসা তীব্র হতাশার কারণে আত্মঘাতী হবার সম্ভাবনা। এতো এতো বৈপরীত্য অতিক্রম করে একজন মানুষ যখন নিজেকে গভীর যত্নে দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়, এর চেয়ে চমৎকার ব্যাপার আর কী-ই বা থাকতে পারে!

আজ ২৯ শে আগষ্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। এই প্রতিকূলতার পৃথিবীতে আজ আমি আমার জীবনের চল্লিশটি বছর পূর্ণ করলাম। একজন মানুষের জীবনে চল্লিশ বছর যথেষ্ট দীর্ঘ একটি সময়। এতো লম্বা একটি সময় ধরে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখতে পেরে আজ আমি ভীষণ আনন্দিত। এই দীর্ঘ চল্লিশটি বছরের হিসেব মেলাতে গিয়ে আজ মনেহলো, আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে পূর্ণতার তেমন কমতি নেই। কারণ পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোটি কোটি প্রাণীর ভীড়ে বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন, সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে পারা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্বীয় বোধের দ্বারা এর উদ্দেশ্য সমূহের কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারা'টা কি কম সৌভাগ্যের বিষয়! প্রতিটি দিনের কাকডাকা ভোরের সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ঝিঁঝিঁডাকা নীরব রাতের মধ্যপ্রহর পর্যন্ত প্রত্যেকটি মুহূর্ত কে নিজের মতো করে উপলব্ধি করেছি, জীবন কে বুঝতে চেয়েছি একান্তই ব্যক্তিগত দর্শনের আলোকে। গিনিপিগের মতো নিজেকে অসংখ্য বার ছিঁড়েখুঁড়ে বুঝতে চেয়েছি এই জীবনের অর্থ কি, কেন বেঁচে থাকে মানুষ? কোন তীব্র স্বপ্ন কে সাকার করার জন্য চারিদিকে এতো এতো দাঙ্গা হাঙ্গামা? মোহগ্রস্তের মতন এতো এতো মানুষ প্রতিনিয়ত কোথায় ছুটে যাচ্ছে? এইসব প্রশ্নের ভীড়ে আমার আজও জানা হয়নি অনেক কিছুই, খোঁজা হয়নি নিজেকে একান্ত নিজের সত্তার গভীরে। তবুও নিত্যকার যাপিত জীবনের খুটিনাটি নিয়ে আরও খানিকটা ভাবালুতা পেয়ে বসবে আমাকে, বেলা শেষে প্রতিটি দিন ফুরাবে নীরব রাতের জঠরে। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে বয়ে যাবে সময়, আর এর রেশ ধরেই একদিন বাজবে চীর বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি। এইতো সব! তবুও সর্বসাকুল্যে ক্ষুদ্র এই জীবনের কাছ থেকে যতটুকু যা পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। এই পর্যন্ত যাপন করা জীবনে কি পাইনি বা কতটুকু হারিয়েছি, সেইসব নিয়ে অযথা আক্ষেপের চেয়ে এটা ভাবতেই এখন ঢের আনন্দ হচ্ছে যে, আজ থেকে উনচল্লিশ বছর আগে ঠিক এমনই একটি দিনে এই নীল-সবুজের গ্রহে জন্মেছিলাম আমি!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
২৯.০৮.২০২৩ খ্রিঃ

বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩

'নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণ'

 

কেন জানি আজ খুব করে মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব দিনগুলোর কথা। তখন সবেমাত্র এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি, সেটা ছিল ২০০০ সালের কথা। পড়াশোনার সমস্ত চাপ হঠাৎ করে শেষ হবার পর নির্লিপ্ত সময় কিছুতেই কাটছিল না। একে তো কিশোর বয়স, তার ওপর অদেখা আগামীর বর্নিল হাতছানি। সবকিছু মিলিয়ে খানিকটা দিশেহারা আমি তখন। ঠিক সেই সময় তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা। আসলে ওই সময় গুলোকে এখন ব্যাখ্যা করতে পারবনা। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় যদিও স্কুলে। আমরা দুজনেই সহপাঠী ছিলাম। খুবই চুপচাপ ধরনের ছেলে ছিল সে। স্কুল জীবনে কখনও তার সাথে কথা বলেছি বলে তো মনে পড়েনা। তবে এস.এস.সি পরীক্ষার আগে তিন মাস আমাদের স্কুল টিচার অরুন স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়েছিলাম। অরুন স্যারের ব্যাচে গিয়েই ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ। কে জানত, এই সাদামাটা নিতান্ত অমিশুক ছেলেটাকে আমি এতটা পছন্দ করে ফেলব!

ওর নাম শিমুল। সম্পূর্ন নাম মোঃ আখিরুজ্জামান। যাইহোক, পরীক্ষার পরের সময়গুলো আমাদের যে কতটা আনন্দে কেটেছে তা ব্যাখ্যাতীত। আমরা তখন রেগুলার নিয়ম করে যেটা করতাম তা হল, সাইকেল নিয়ে পুরোটা বাগেরহাট চক্কর দেওয়া। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। এরপর আমরা লঞ্চ টার্মিনালের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে বসে স্ন্যাকস্ আর কফি খেতাম। জীবনে অনেক ভালো ভালো খাবার হয়তো খেয়েছি, কিন্তু সেই সময়ের মতো মজা কখনও উপভোগ করতে পারিনি। আর এই সবকিছুই শিমুলের জন্য। আমাদের প্রতিদিনকার ভ্রমনের জায়গা ছিল সাধারনত ষাটগম্বুজ স্টেশন, সাবেকডাংগা, হাঁড়িখালির কাঠের পুল, ভৈরব নদীর পাড়, দশানী প্রভৃতি। কিছুদিন পর আমাদের সাথে যুক্ত হয় আমাদের স্কুল জীবনের আর এক সহপাঠী রিফাত আদনান রাজন। তবে সেইসময়ে রাজন আমদের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ট না হলেও তার মাধ্যমে আমরা অসাধারন একটা বন্ধু পেয়েছিলাম। তার নাম আল ওয়াসিম রনি। এরপরের দিনগুলোতে প্রধানত আমরা তিনজনেই বেশি আড্ডা দিয়েছি। শিমুল, রনি এবং আমি। কিছুদিন পরে শিমুল খুলনা চলে যায়। সেই সময়ে ভীষণ ভাবে মিস করতাম ওকে। সত্যি বলতে কি, শিমুল কে ছাড়া কোন আড্ডাই কখনও জমত না। তবে পড়াশোনার ফাঁকে কখনও ছুটিছাটা পেলেই শিমুল চলে আসত। ততদিনে আমাদের আড্ডাস্থল পরিবর্তিত হয়ে দশানী পচাঁদীঘির পাইপের ওপর এসেছে।

তখন ২০০৩ সাল। হঠাৎ ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা দিনাজপুর বেড়াতে যাব। যেই কথা সেই কাজ, কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই আমি আর শিমুল ডিসেম্বরের সেই কনকনে ঠান্ডায় ট্রেনে চড়লাম। গভীর রাতে অন্ধকার ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে সীমান্ত এক্সপ্রেস, আমরা দুই বন্ধু বিস্মিত চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি। এরপর কত অসংখ্য বার যে ট্যুর করেছি, কিন্তু সেই ট্যুরের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। আসলে শিমুল ছিল অন্য রকম একটা ছেলে। প্রেম করা তো বহুদূরের বিষয়, কখনও কোন মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আসলে চরিত্রগত কারনে নাকি অন্য কোন কারনে ওর প্রতি আমার আলাদা ধরনের এক অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল, যা আজও অবিচল।

এরপর জীবনে এসেছে হাজার রকম চড়াই-উৎরাই, অনেক রকম অভিজ্ঞতায় হয়েছি পরিপূর্ন। পরিচিত হয়েছি অসংখ্য মানুষের সাথে। অনেক বন্ধু এসেছে, অনেক বন্ধু হরিয়েও গেছে। আমি জানিনা, হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন, সেই সব প্রিয় বন্ধু আজ কোথায়! অনেকে আজ কাজের সন্ধানে হয়েছে প্রবাসী, অনেকে সম্পূর্ন ভাবে জড়িয়ে গেছে সংসার জীবনে। জীবন থেকে একটু একটু করে হারিয়ে গেছে দিন, মাস, বছর, যুগ। পৃথিবীও একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছে অবিরত তার নিজের অক্ষে। শুধু অমিই হয়তো এখনও দাঁড়িয়ে আছি একই জায়গায় পুরোনো কিছু স্মৃতিকে আকড়ে নিয়ে। তবে সবকিছু বদলে গেলেও শিমুল কিন্তু এখনও হারিয়ে যায়নি। আজও কর্মব্যাস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই সে আমার কাছে আসে। আমরা আবারো ফিরে চলে যাই ফেলে আসা সেইসব দিনে, হয়তো পুরনো সেইখানে, ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলাম বহু বছর আগের কোন একদিন!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
🍂

'ব্যক্তিগত দর্শন'


খুব সম্ভবত নবম কিংবা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আমি মোতাহের হোসেন চৌধুরী'র লেখা 'শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব' নামক গদ্যটি পড়ে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখনকার বয়সে যদিও সেইসব দার্শনিক কথার তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু বিষয়টি মাথায় ঠিকই থেকে গিয়েছিল এবং বেড়ে ওঠার সাথে সাথে একসময় বুঝতে পারলাম ঠিক কতখানি গভীরতা রয়েছে ঐ লেখাটির মাঝে। এরপর পরিনত বয়সে এসে একটু একটু করে প্রাচ্য দর্শন, আত্মিকবাদী রচনা, স্পিরিচুয়ালিটি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর পড়েছি এবং নিজে নিজে চিন্তা করে বিষয়গুলোর ব্যাপকতা বুঝতে চেষ্টা করেছি। স্বতন্ত্র একটি প্রাণী হিসেবে এই পৃথিবীতে জন্ম নেবার পর একজন মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত কোথায় ছুটে চলেছি, কি মহান উদ্দেশ্য কে চরিতার্থ করার জন্য আমাদের এই প্রাণপণ প্রচেষ্টা এবং এতো এতো লাফঝাঁপ করে অবশেষে আমাদের প্রাপ্তি ঠিক কতটুকু? এই ভাবনাগুলো আমাকে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। আমি দেখেছি- প্রাচীণকাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা এবং পুরুষানুক্রমিক প্রথা কে আঁকড়ে ধরে অনিশ্চিত পথে ছুটে যাচ্ছে বর্তমানের মানুষ। অনেকে আদৌ জানেই না কেন তারা বাধ্যতামূলক ভাবে এসব করে যাচ্ছে! মুলত একটি সদ্যোজাত শিশুর জন্মের পর যখন সে একটু বড়ো হয়, তখনই তাকে তার পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থায় অনিবার্য ভাবেই কিছু শিক্ষা নিতে হয়। তাকে শেখানো হয়ঃ

'তুমি এখন স্কুলে যাবে তারপর আরও একটু বড়ো হয়ে কলেজে যাবে। তোমার পাঠ্য বইয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী কি লিখেছেন তা শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসবে, তাহলে রেজাল্ট ভালো হবে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সবশেষে তোমাকে একটি সনদপত্র দেওয়া হবে, যেটি দেখিয়ে তুমি একটি মানসম্মত চাকরি পেতে পারো। তারপর তোমার উপার্জন প্রদর্শন করে তুমি বিপরীত লিঙ্গের একজন সঙ্গী বেছে নিয়ে সন্তান উৎপাদন করবে এবং তাদের প্রতিপালন করবে, একটি সময় সমূহ জরা নিয়ে বার্ধক্য এসে তোমাকে ঢেকে দেবে আর তুমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবে। ব্যাস! এটাই তোমার পুরো জীবন। তুমি নিজেকে এভাবেই পরিচালিত করবে কারণ তোমার পূর্বপুরুষেরাও ঠিক এটাই করে এসেছেন!'
কোমলমতি শিশুরাও পারিবারিক কিংবা সামাজিক সেই আদেশ শিরোধার্য করে রণপা হয়ে এগিয়ে চলে অদেখা আগামীর পথে। যদি তাদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন করে বসে, 'আচ্ছা, আমার পূর্বপুরুষগন এই কাজ করে গেছেন বলে আমাকেও কেন একই ট্রেডিশন মেনে চলতে হবে? আমি তো স্বতন্ত্র একটি প্রাণী, আমি তো স্বতঃস্ফূর্ত সত্তা, আমার মগজেও তো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউরন রয়েছে, যেখানে ইউনিক সব ভাবনা কিলবিল করে!' এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পরিবার কিংবা সমাজ একবাক্যে বলবে- তুই দুই লাইন বেশি বুঝিস, তোর মাথায় সমস্যা আছে। হাহাহা... ম্যাক্সিমাম মানুষের চিন্তার সাথে ম্যাচ না করলেই একজন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়, তাই না?! খুবই হাস্যকর থিওরী!

ছোটবেলায় দেখতাম গ্রামাঞ্চলে ধান মাড়াই করার জন্য সারা উঠোনে সদ্য কাটা ফসল ছড়িয়ে রাখা হতো। উঠোনের মাঝখানে একটি খুঁটি পুঁতে সেই খুঁটির সাথে পাঁচ-ছয়টি গরুকে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রাখা হতো। কেন্দ্রে যে গরুটি থাকতো, বাকী গরুগুলো তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকতো। কেন্দ্রের গরুটি দাঁড়িয়ে পড়লে অন্য গরুগুলোও দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হতো। পুরুষানুক্রমিক প্রথা আমার কাছে একই সিস্টেম। এই প্রথার মাধ্যমে আমাকে শেষপ্রান্তে উপস্থিত গরুটির মতো পরপর সারিবাঁধা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের গরু অর্থাৎ আমার পূর্বপুরুষ কিভাবে হাঁটা-চলা করে, আমাকেও সামাজিক ভাবে সেভাবে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এই ধান মাড়াইয়ের গরু হতে রাজি না হলে বলা হয়- তুমি একটু বেশি বোঝো। তোমার মতো দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো, যার মানে তোমার সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়া উচিৎ! মাত্র তিন কি চারদিন আগে আমার এলাকার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, 'বাপ্পী, তুমি সবসময় একটু বেশিই বোঝো। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলেপুলে তোমার চিন্তা ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। তুমি দয়া করে নতুন প্রজন্মের কাউকে কোন ভুলভাল থিওরী দিও না!'
তার কথায় আমি হোহো করে হেসে উঠলাম। তিনি বিব্রত হয়ে বললেন, আমি কি কোন হাসির কথা বলেছি?
আমি বিনীতভাবে তাকে বললাম, 'জানেন, বহুকাল আগে প্রাচীণ গ্রীসে সক্রেটিস নামে একজন মানুষ ছিলেন। তিনিও একটু বেশিই বুঝতেন। তাঁর চিন্তার প্যাটার্ন বুঝতে না পেরে সেই সময়ের মানুষেরা প্রায়ই অভিযোগ করতেন যে, তিনি নতুন প্রজন্মের মানুষকে ভুলভাল শিক্ষা দিচ্ছেন!' আমার কথাটি শুনে ভদ্রলোক ভ্যাবদা মেরে বসে থাকলেন।
যাইহোক, যে নিজস্ব দর্শন শেয়ার করতে চেয়েছিলাম, সেই বিষয়টি নিয়েই বরং কথা বলা যাক। খাঁচায় বন্দী করে রাখা একটি পাখির জীবন লক্ষ্য করেছেন কখনও? বন্দী পাখিটির সর্বক্ষণ চেষ্টা থাকে কিভাবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। সে যখন লোহার খাঁচা থেকে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মনের মধ্যে কি চলে সেটা কি উপলব্ধি করতে পারেন? পাখিটিকে কিন্তু খাঁচার মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ খাবারের লোভ তাকে একবিন্দু আকৃষ্ট করতে পারে না। সে যদি কোনভাবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, তখন নীল আকাশে ডানা মেলে সে যে মুক্তির স্বাদ পায়, তার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় সুস্বাদু খাবার তুচ্ছ। হয়তো অক্লান্ত চিত্তে আকাশে উড়ে বেড়াতে গিয়ে সারাদিনে সে খাবার হিসেবে একটি পোকা পেতেও পারে কিংবা অভুক্ত থাকতেও পারে। তবুও তার মনে কোন খেদ থাকেনা। সে কি কখনো খাবারের লোভে আপনার খাঁচায় বন্দী হবে?!

ঠিক একইভাবে ব্যক্তিগত জীবনেও একজন মানুষ স্বাধীনভাবে একটি জীবন কাটাতে চাইতেই পারে। তার জীবনে হয়তো অর্থকষ্ট থাকবে, সামাজিক প্রতিকূলতা থাকবে, বিলাসী জীবনের অভাব থাকবে, কিন্তু সে যে কতখানি গভীর আত্মিক প্রশান্তির মাঝে বেঁচে থাকবে- সেটা কি কল্পনা করতে পারেন?
আমি অসংখ্য মানুষ দেখেছি, পরিশ্রম করতে করতে যারা রাতদিন এক করে ফেলে। দিনশেষে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে ঘরে ফিরেও বউ-বাচ্চা এবং পরিবারের সবাইকে সে খুশি করতে পারে না। এই শ্রমক্লান্ত মানুষটি যখন বারান্দায় বসে ফ্যালফ্যাল করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মধ্যে আমি খাঁচায় বন্দী সেই পাখিটিকে খুঁজে পাই, যে চারপাশে প্রচুর খাবার থাকা সত্ত্বেও খাঁচা ভেঙে উড়াল দিতে চায়। একটি বারের জন্য মুক্তির স্বাদ পেতে চায়! কিন্তু সংসার নামক এক জগদ্দল পাথর তার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে থাকে। সে না পারে এই বিতৃষ্ণা থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে। তাহলে এতো এতো কাঠখড় পুড়িয়ে কতটুকু লাভ হলো? এর সদুত্তর দেবার ক্ষমতা কিন্তু আপনার ট্রেডিশনাল সমাজব্যবস্থার নেই।

তাই শৈশবে একটি শিশুর জন্ম দিয়েই আপনি তার কানে কানে প্রতিনিয়ত পরম্পরা মেনে চলার যে গুরুমন্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। আপনার সন্তান কে তার নিজের মতো করে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করুণ। এমন তো নয় যে, আপনার মগজেই শুধুমাত্র ঘিলু আছে আর আপনার সন্তানটির মগজে রয়েছে আলুভর্তা! তাই বলছি কি- যে অজানা ভুল কে বুকে আগলে রেখে জীবন পার করে দিলেন, সামান্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে একটু যৌনতার জন্য ঢ্যাংঢ্যাং করে বিয়ে করে ফেলে ভেবে নিলেন, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! কিন্তু কয়দিন পরেই তো সেই জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়তি। কথায় আছে না, ডাইলের মজা তলে!

যাইহোক, আমি আমার ব্যক্তিগত দর্শনের প্রতি কাউকে প্রলুব্ধ করতে চাই না। যে যার মতো করে ভালো থাকুক। তবে আমার একটাই চাওয়া, তা হলো- ধান মাড়াইয়ের গরুর মতো ট্রেডিশনাল জীবন ছেড়ে সত্যিকারের মানুষ বের হয়ে আসুক। অবশ্য সে যে একজন বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ, এটা যদি কারো বোঝার ক্ষমতা থাকে, তবেই সে তার চিন্তার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
০৭.০৪.২০২২ খ্রিঃ

'সখী, ভালোবাসা কারে কয়'

 

আচ্ছা, বলুন তো ভালোবাসা ব্যাপারটি আসলে কি? প্রচুর পরিমাণ মানুষ প্রায়ই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন। এর উত্তর কিন্তু মোটেই সহজ নয় বরং পরিষ্কার ভাবে চিন্তা করতে গেলে ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। 'ভালোবাসা' নামক বিষয়টি নিয়ে নানান সময়ে অসংখ্য গুণীজন প্রচুর পরিমাণ হিসাবনিকাশ করেছেন, অনেক থিওরীও বের করেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও স্পষ্ট করে কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। অনেকেই বলে থাকেন ভালোবাসা একটি মানসিক অনুভূতির নাম। এটা একান্তই নাকি মনের মধ্যে আবদ্ধ। আচ্ছা, মন বিষয়টি আসলে কি? এর একটাই উত্তরঃ মস্তিষ্ক-ই হচ্ছে মন। মানুষের যাবতীয় আবেগ-অনুভূতির একমাত্র নিয়ন্ত্রক হলো মস্তিষ্ক। মানুষের ব্রেইনের টেম্পোরাল লোবে ভালোবাসা বাস করে। টেম্পোরাল লোবে অসংখ্য নিউরোনের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রিক ইম্পালসের বিশেষ ধরনের আদান-প্রদানই ভালোবাসা। কিন্তু কেউ কেউ আবার অন্য ভাবে বলে থাকেন যে- মানুষের আবেগ-অনুভূতি এবং ভয়ভীতির মুল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পিটুইটারী গ্লান্ড। একটি মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে, তখন ছেলেটিকে দেখামাত্রই তার পিটুইটারী গ্লান্ড থেকে বিশেষ একধরণের এনজাইম নিসৃত হয় এবং সেই এনজাইমের কারনেই ছেলেটি তখন যা করে, তা দেখেই মেয়েটির হৃদয়ে দোলা লাগে।

এবারে আসুন, একেবারে মুল জায়গায় যাওয়া যাক। অসংখ্য বিজ্ঞানীরা একবাক্যে বলেছেন- প্রকৃতির প্রধান ইচ্ছা এই জীবজগৎ যেন টিকে থাকে। জীবজগতের কোন বিশেষ ধারা যেন বিলুপ্ত না হয়। আমাদের এই পার্থিব জীবজগতের একটি প্রধান ধারা হচ্ছে হোমোস্যাপিয়েন্স বা মানবজাতি। এই মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্ত হলো তাদের সন্তান উৎপাদন করা এবং অতি অবশ্যই উৎকৃষ্ট সন্তান উৎপাদন করা। সন্তান সৃষ্টির জন্য একজন মানব এবং একজন মানবীকে পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসতে হয়। এই কাছাকাছি আসার প্রক্রিয়াটির জন্য তাদের একজনের অপরজনের প্রতি একটি তীব্র শারীরিক আকর্ষণ তৈরি হতে হয়। এই শারীরিক আকর্ষণের মুল রূপটির নাম-ই ভালোবাসা। সময় বিশেষে এই ভালোবাসার তীব্রতারও হেরফের হয়। প্রকৃতি যখন বুঝতে পারে দুজন বিশেষ মানব-মানবীর মিলনে উৎকৃষ্ট সন্তান তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে, তখন প্রাকৃতিক ভাবেই উক্ত মানব-মানবীর মধ্যকার ভালোবাসা তীব্রতর হয়। তারা একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এবং কোন বাঁধা-ই তাদের কাছে তখন বাঁধা বলে মনে হয় না। পুরুষেরা রূপবতী মেয়েদের প্রেমে পড়ে, কারণ প্রকৃতি চায় পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুন্দর হয়। যুগে যুগে নারীরা গুণী পুরুষদের প্রেমে পাগল হয়েছে, কারণ প্রকৃতি চেয়েছে পুরুষদের গুণ যেন পরবর্তী প্রজন্মে ডিএনএ-র মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। প্রকৃতি সবসময়ই চেয়েছে মানব সম্প্রদায়ের গুণগুলো যেন প্রবাহিত হতে হতে একটি সময় পূর্ণ মাত্রায় বিকাশ লাভ করে, যেন তৈরি হয় একটি অসাধারণ মানবগোষ্ঠী।
এটাই হচ্ছে মুল বিষয়। অথচ শৈশব থেকেই দেখে এসেছি এই ভালোবাসা নিয়ে মানুষের মধ্যে সে কি সীমাহীন আদিখ্যেতা! ভালোবাসার জন্য কতোই না পাগলামি করা হয়। গল্প-উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রের কাহিনির মধ্যে অতি অবশ্যই একজন নায়ক থাকে, সে যখনই তার নায়িকা কে পেয়ে যায় কাহিনী ওখানেই সমাপ্ত করা হয়। নায়ক নায়িকাকে পেয়ে যাবার পর কি হয়, সেটা তো সবাই বোঝে! অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকে। তারমানে নিজের প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার স্বার্থে বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের সাথে জৈবিক সম্পর্ক স্থাপন করাকেই বাহুল্য করে ভালোবাসা বলা হয়। এই তুচ্ছতম বিষয়টির জন্য মানুষ সীমাহীন উদ্যমে কবিতা-গান লেখে, রাত জেগে কল্পনার আকাশে ডানা মেলে, অনেকে নিজেকে পাল্টে ফেলে, পরিবার কিংবা সমাজ ত্যাগ করে, কখনও নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়। আর ভালোবাসা না পেলে কেঁদেকেটে একাকার করে, হাত-পা কাটে, নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে, কেউ কেউ তো আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। আহারে... ভালোবাসার কি ঠ্যালা! কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমি এখনও পর্যন্ত এই অসাধারণ বিষয়টি ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠতে পারলাম না। তাই মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে, কোন একজন নারীর কাছে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করি-
'সখী, ভালোবাসা কারে কয়?'

কৃষ্ণেন্দু দাস/

'পৌষ পার্বণ'


প্রাচীণ লোকসংস্কৃতি এবং আবহমান বাংলার পুরনো দিনের বেশকিছু ঐতিহ্য এখন আধুনিকায়নের তীব্র স্রোতের তোড়ে ভেসে ভেসে হারিয়ে গেছে অজানায়, এমনই একটি প্রাচীণ সাংস্কৃতিক উৎসবের নাম পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ পার্বণ। এই প্রাচীণ উৎসবটির প্রতিটি পর্যায়ে জড়িয়ে আছে আগেকার দিনের গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের জীবন এবং জীবিকার প্রতিচ্ছবি। সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্ম হয়েছিল আশির দশকের প্রথম ভাগে এবং আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছিল প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। এরজন্য আমি প্রাচীণ সেইসব দিনের প্রথাগত সামাজিক জীবন-জীবিকা এবং ঐতিহ্যবাহী সেইসব লোকসংস্কৃতি কে সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পৌষের সেইসব দিনে বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদের মানুষের বাড়িতে নতুন আমন ধানের চালে গোলা ভর্তি হয়ে যেতো। প্রথমে ধানের জমি থেকে নতুন ফসল কেটে এনে উঠোনে স্তুপ করে রাখা হতো, এরপর উঠোনের মাঝখানে একটি খুঁটি পুঁতে একটা দড়ির সাহায্যে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি গরুকে বেঁধে সেই ধান মাড়াই করা হতো। ধান কাটা থেকে শুরু করে চাল বের করা পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়া ছিল যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনি এই প্রতিটি পর্যায় ছিল দারুণ উৎসবমুখর।

নতুন খাদ্যশস্য ঘরে তোলার পর এই সময়ে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলে যেতো। এরপর পৌষের শেষে জাঁকিয়ে শীত নামা শুরু হলে প্রতিটি বাড়ির বউঝি এবং অন্যান্য নারীরা চালের পাত্র নিয়ে ঢেঁকিতে পিষে চাল গুড়ো করতে যেতেন। আমি শৈশবে বেশ কয়েকবার মায়ের সঙ্গে চাল কুটতে গিয়েছি। গ্রামের নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে ঢেঁকিঘরে আরও অনেক মহিলারা কোলের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হতেন। সেটাও ছিল দারুণ উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। এরপর সন্ধ্যা বেলায় হাত-মুখে চালের গুঁড়ো মেখে সাদা ভূত হয়ে ঘরে ফিরতাম। শুরু হতো পিঠা তৈরির আয়োজন। চুলার আগুনে মাটির ছাঁচ রেখে চালের গুঁড়ো গুলে সেটা ছাঁচে ফেলে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখা হতো। আমি উনুনের আঁচে বসে মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম। মা যথারীতি প্রথম বার পিঠা তুলে আমাকেই দিতেন। তীব্র শীতে সেই ধোঁয়া ছড়ানো গরম পিঠা হাতে নিয়ে যে সুখানুভূতি পেতাম, তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। সেই সময়কার আমার সমবয়সী সকল শিশুর হাতেই থাকতো থালা ভর্তি পিঠা আর নতুন খেজুরের গুড়।

এরপর সময়ের আবর্তে চুরি যাওয়া রোদের মতোই সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে বহুদূরে। গ্রামীণ জনপদের সমাজব্যবস্থায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন আমরা যন্ত্র নির্ভর সময়ে এসে পৌঁছে গিয়েছি। চারপাশে বিনোদনের অসংখ্য উপকরণ। এখন আর কেউ লাঙ্গলে হালচাষ করতে করতে টানা সুরে গান গায় না, এখন উঠোনে গোবর লেপে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হয় না। এখন কেউ আর চাল নিয়ে ঢেঁকিঘরে যায় না। এখন ফসল উৎপাদনের গুরুদায়িত্ব মেশিনের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে। মেশিন হালচাষ করে, আর জমির মালিকেরা সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে। সবকিছুই খুব বেশি শর্টকাট। এখন আর পিঠা বানানোর জন্য উৎসবের প্রয়োজন হয় না, এখনকার শিশুরা উনুনের আঁচে মায়ের পাশে বসে পিঠার জন্য বায়না করে না। শিশুদের হাতে তাদের বাবা-মা স্মার্টফোন তুলে দিয়েছেন। ওদের পিঠা খাওয়াতে গেলেও টিভিতে 'গোপাল ভাঁড়' কিংবা 'মোটু-পাতলু' দেখানো লাগে। নতুন ধানের চালের ঘ্রাণ ওদের কাছে অজানা, ওদের কাছে অজানা খেজুরের গুড়ের সেই আঠালো মিষ্টি স্বাদ। আধুনিকায়ন আর স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্যে এখনকার সময়ের শিশুরা যে স্মার্টনেস বগলদাবা করে বেড়ে উঠছে, তাতে আগামী বিশ কিংবা পঁচিশ বছর পরের প্রজন্মের কাছে 'পৌষ পার্বণ' বিষয়টি হবে নেহাৎ একটি পঠিত বিষয়। এই খটখটে স্মার্টনেসে নেই মাটির ছোঁয়া, নেই নিজের আবহমান সংস্কৃতির প্রভাব। এখনকার দিনের একটাই টার্ম, ঘাড় সোজা রেখে আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও! তবুও শৈশবের যে সোনালী অধ্যায় পার করে এসেছিলাম, যে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের স্মৃতিতে এখনও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই, এখনও কুয়াশায় ঢাকা পৌষ শেষের সন্ধ্যায় নতুন চালের একটা গরম পিঠার স্পর্শ আমাকে যতটা গভীর ভাবে আবেগে আপ্লুত করে- সেই দিন, সেই সময়গুলো, সেইসব স্মৃতিই আমাকে আবারও প্রতিবারের পৌষ সংক্রান্তিতে সেই পুরনো অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, যে দিনের কাছে কোনভাবেই আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সবার প্রতি পৌষ পার্বণের অনেক অনেক শুভকামনা!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১৪.০১.২০২৩ খ্রিঃ

'সমকালীন জীবন ও আমাদের ভবিষ্যৎ'

বেশ কিছুদিন আগে আমার পার্শ্ববর্তী এলাকার শ্রদ্ধেয় দাদা জি.সি. পাইক বলেছিলেন— ২০৪০ সালের পর আশেপাশে কোন থুরথুরে বুড়ো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দাদার এই দূরদর্শী চিন্তা আমার ভালো লেগেছিলো। বিষয় টা নিয়ে আমি নিজেও অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি এবং বইপত্র পড়ে দেখেছি। মানুষের জীবনকাল আস্তে আস্তে সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। আগেকার দিনে একজন মানুষের (হোক সে পুরুষ কিংবা নারী) মধ্যে যতটা উদ্যম, যতটা প্রাণশক্তি ছিলো, এখনকার সময়ে এসে সেটা আশ্চর্যজনক ভাবে লুপ্ত হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়াটি কতটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়েছে এবং ঠিক কিভাবে হয়েছে, সেটা ব্যাখ্যা করতে যাবার আগে আসুন, কিছু তথ্যের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।

আমাদের এই গ্রহে মানুষ কর্তৃক আগুনের আবিষ্কার হয়েছিলো আনুমানিক প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে। আদিম মানুষের আগুন আবিষ্কার করতে যতটা দীর্ঘ সময় লেগেছিলো, তার চেয়ে চাকা আবিষ্কার করতে অস্বাভাবিক রকমের কম সময় লেগেছে। প্রথম চাকা আবিষ্কার হয়েছিলো আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে। চাকা আবিষ্কারের সাথে সাথে সভ্যতাও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করেছিলো। চাকা আবিষ্কারের পর ষ্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার করতে মানুষের আরও কম সময় লেগেছে। ষ্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়েছে মাত্র আড়াইশো বছর আগে। ষ্টীম ইঞ্জিন থেকে সুপার কম্পিউটার আবিষ্কার করতে লেগেছে আরও অল্প সময়। সুপার কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে দেখা যায় আমাদের এই মানব সভ্যতা কতটা দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে। আগুন থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার পর্যন্ত আমাদের এই দীর্ঘ জার্নির স্পীড একটু একটু করে যেভাবে বেড়ে গিয়ে তীব্র গতিতে গিয়ে ঠেকেছে, সেভাবে আমাদের বায়োলজিক্যাল পরিবর্তন-ও হয়েছে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে। সহজে বলি, যান্ত্রিক সভ্যতা যতটা তাড়াতাড়ি বিস্তার লাভ করেছে, আমাদের এই মনুষ্য শরীরও তার সাথে তাল মিলিয়ে ততটাই তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হয়েছে। এটা নিয়ে আরও একটু খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করি। আলোচনার সুবিধার্থে আমি উদাহরণ হিসেবে এখানে নিজেকে এবং নিজের পারিপার্শ্বিকতা কে তুলে ধরছিঃ
আমার পিতামহ ছিলেন একজন মিষ্টি প্রস্ততকারক এবং বিক্রেতা। আমাদের বাড়ি থেকে পনের কিলোমিটার দূরের একটি বাজারে তার মিষ্টির দোকান ছিলো। আমার পিতামহ প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি থেকে পনের কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে তার দোকানে গিয়ে এরপর মিষ্টি তৈরি করে, সারাদিন ধরে সেগুলো বিক্রি করে সন্ধ্যার পর পরিবারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আবারও পনের কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি এসে পৌঁছাতেন। এইযে তার নিত্যকার কায়িক পরিশ্রম, এটা তার শরীর এবং মনকে চমৎকার এক দৃঢ়তায় বেঁধে রেখেছিলো। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তার খাবারের প্রতি অরুচি ছিলো না, ঘুমের কোন ঘাটতি ছিলো না। তার সময়ে পুকুর, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ ছিলো, গাছে ছিলো টাটকা ফল, ক্ষেতে ছিলো সবজি। তার সময়কার মাছ কিংবা তরকারি, ফলমূল, সবজি ইত্যাদি প্রতিটি জিনিস ছিলো ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত। তিনি ভোরবেলা যখন পনের কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতেন, তার চলার পথে ছিলো নির্মল বাতাস। তার আশেপাশে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের দূষণ ছিলো না। এবারে তার স্ত্রী, অর্থাৎ আমার পিতামহী সম্পর্কে বলি। নিতান্তই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া এই মহিলার প্রাত্যহিক জীবনও ছিলো তার স্বামীর মতোই কর্মমুখর। একদম ভোরবেলা যখন তার স্বামী দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করতেন, তিনি তখন ঝাড়ু নিয়ে বাড়ির উঠোনে জমে থাকা ময়লা এবং শুকনো পাতা পরিষ্কার করা শুরু করতেন, এরপর হাঁস-মুরগি কে খেতে দেওয়া, বাগানের গাছে জল দেওয়া, আঙ্গিনায় সবজির পরিচর্যা শেষে স্নান সেরে এসে রান্না শুরু করতেন। তার একগাদা ছেলেপুলে ছিলো, তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখার বিষয় তো ছিলোই। আমি কিশোর বয়সেও আমার ঠাকুরমা কে যথেষ্ট কাজ করতে দেখেছি। এই দৈনন্দিন কাজগুলো তিনি করতেন স্বেচ্ছায় এবং মনের আনন্দে।
আমি যে সময়ের কথা লিখছি, তখনকার দিনে এদেশের মানুষ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে ছিলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মানুষগুলো পরিশ্রম করেছে। জমির চাষ করার জন্য গরু এবং লাঙ্গল ব্যবহার করা হতো, জমিতে সেঁচের জন্যেও কায়িক পরিশ্রম করতে হয়েছে, এরপর ফসল কাটা, ফসল মাড়াই করা, মাড়াইকৃত শষ্য রোদে শুকানো, ঢেঁকিতে ছেঁটে সেই ধান থেকে চাল বের করা, চাল থেকে তুষ আলাদা করা, চাল সেদ্ধ করা, খড় এবং বিচালি গবাদিপশুর জন্য সংরক্ষণ করা থেকে এই পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট শ্রমসাধ্য ব্যাপার ছিলো। তখনকার সময়ে প্রতিটি এলাকায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে সপ্তাহে একদিন হাট বসতো। দূর দূর থেকে মানুষেরা পায়ে হেঁটে সেই হাটে এসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেন, কেউ কেউ নিজস্ব উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসতেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এইসব হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও সেই সময়ের মানুষের মনে অনেক আনন্দ ছিলো। তাদের মধ্যে আশেপাশের মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা ছিলো। তাদের সময়ে বিনোদনের এতো এতো ব্যবস্থা ছিলো না, কিন্তু তারা প্রত্যেকে ছিলেন মানসিক ভাবে সুখী। তাদের এই আত্মতুষ্টি তাদেরকে দীর্ঘায়ু করেছিলো। সেই সময়ের মানুষেরা সুস্থ সবল ভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতেন। তাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ছিলো যথেষ্ট বেশি। আমার ঠাকুরদার আমলে অধিকাংশ মানুষ ৮০-৯০ বছর অবলীলায় বেঁচে থাকতেন।
আমার বাবা যখন স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, তখনও পর্যন্ত আমাদের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়নি। তিনি দশ থেকে বারো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রোজ কলেজে যেতেন এবং ততটা পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। আমার বাবার ছাত্রজীবনে বাগেরহাট থেকে খুলনা পর্যন্ত একটা মিটারগেজ লাইনের ট্রেন চলাচল করতো। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আমাদের এলাকা থেকে বাগেরহাট শহরে তখনকার দিনে সবাই পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন। আমার বাবা যখন শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন তিনি বাড়ি থেকে রোজ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতেন। তার সময়েও খাবারে সেভাবে ভেজাল মেশানোর সংস্কৃতি শুরু হয়নি। কায়িক পরিশ্রম বলতে রোজ দুইবার সাইক্লিং করে এবং খাটি খাবারের গুণে তিনিও মোটামুটি সুস্থ-সবল ভাবে জীবন পার করেছেন। তার সমসাময়িক কালের মানুষের আয়ু ছিল প্রায় ৬৫-৭৫ বছর। এরপর থেকেই মুলত আমাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্র এবং জীবনযাত্রায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে শুরু করলো।
আমার জন্ম হয়েছিলো আশির দশকের শুরুতে। আমার শৈশবে আমিও প্রাকৃতিক ভাবে খাল-বিলের দেশি কইমাছ, শোল, শিং মাগুর, বোয়াল দেখেছি। আমার ছোটবেলায় কৃষকের গরু নিয়ে হালচাষের কালচার ছিলো, ঢেঁকিছাটা চালের গরম ভাতের সাথে খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে খেয়ে সকালে স্কুলে যেতাম। আমার শৈশবে আমি আমার সমবয়সী ছেলেদের সাথে খোলা মাঠে নানান ধরনের খেলাধুলায় মেতে থাকতাম, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার, আর সারাদিনের দৌড়ঝাঁপে শরীর টা সুস্থ এবং মন প্রফুল্ল ছিলো। আমার শৈশবের বিনোদন ছিল মাঠের খেলাধুলা, গ্রামীণ উৎসব, মেলার দোকানপাটে ঘোরাঘুরি, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। ছোটবেলায় রেডিওতে গান শোনা ছিলো বিশুদ্ধ বিনোদনের আর একটি অংশ। তারপর মুহূর্তের মধ্যে আশ্চর্যজনক ভাবে সবকিছু ক্রমান্বয়ে বদলে যেতে শুরু করলো। রেডিও হারিয়ে গেলো, লাঙ্গল, ঢেঁকি অদৃশ্য হলো, আশেপাশে কৃষিজমিতে কলকারখানা বিস্তার লাভ করলো, সেঁচের জন্য এলো চীনের তৈরি শ্যালো ইঞ্জিন, জমিতে এলো পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াইয়ের জন্য মেশিন, চাল ছাড়ানোর জন্য রাইস মিল। যানবাহনের পরিমাণ বাড়তে লাগলো হুহু করে। কোন মানুষ আর দুই পা হেঁটে কোথাও যেতে চাইলো না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার শুরু হলো, ধ্বংস হলো লক্ষ লক্ষ উপকারী কীট-পতঙ্গের জীবন। মানুষ অতিরিক্ত লাভের আশায় খাবারে ভেজাল দেওয়া শুরু করলো। বন উজাড় করে ইটের ভাটা শুরু হলো। নদনদী মরে গেলো, প্রাকৃতিক ভাবে মাছের উৎপাদন কমে গেলো। মানুষ হাইব্রিড ভাবে মাছের চাষ, মুরগির খামারে মনোনিবেশ করলো। চতুর্দিকেই তখন নানান ধরনের পরিবর্তনের ছোঁয়া। একটু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষেরা তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য।

প্রকৃতি তখন ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। স্বভাবতই নতুন নতুন রোগব্যাধির উৎপত্তি হলো, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বাড়তে শুরু করলো। আগেকার দিনের টিকে থাকা বুড়ো মানুষেরা হারিয়ে যেতে শুরু করলো। মানুষের মন থেকে নির্মল আনন্দ লুপ্ত হতে লাগলো। অনেক বিনোদনের মধ্যে থেকেও মানুষ সব সময় চাপা একটা উদ্বেগের মধ্যে বেঁচে থাকার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হলো। এখনকার সময়ের মানুষের বেঁচে থাকার কোন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। সবাই অল্পতেই খুব বেশি হতাশ, সবাই খুব বেশি বিষন্ন। মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং মানুষের আরামপ্রিয় জীবনযাপন পদ্ধতি এখনকার মানুষ কে ঠেলতে ঠেলতে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার বয়স চল্লিশ বছর, অথচ আমার সমবয়সী এবং আমার চেয়ে বয়সে ছোট অসংখ্য মানুষ কে আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে দেখেছি। যে বিষাক্ত পরিবেশে ক্লেদাক্ত জীবন যাপন করে যাচ্ছি, তাতে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবো কিনা, এব্যাপারে আমি সন্দিহান। মানুষ যেভাবে লাগামহীন ভাবে ঊর্ধ্বমুখে প্রতিনিয়ত অজানার দিকে ছুটে চলেছে, তাতে এদের এই জার্নি টা আগামী দুইশো বছর পর্যন্ত টেকে কি-না সন্দেহ আছে। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আমার প্রতিবেশী দাদা জি.সি. পাইক বলেছেন ২০৪০ সালের পর আশেপাশে কোন বৃদ্ধ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিভাবে খুঁজে পাবেন, মানুষ বুড়ো হওয়ার মতো সময় পেলে তো! ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকাই তো দুষ্কর। এখন বেঁচে থাকতে গেলে একটাই সমাধান, অতিরিক্ত লোভ পরিত্যাগ করতে হবে। নিজের খাবার টা নিজেকেই বিশুদ্ধ ভাবে উৎপাদন করতে হবে, প্রচুর পরিমাণ শারীরিক শ্রমের কাজ করতে হবে, প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করতে হবে, টেকনোলজিক্যাল বিনোদনের ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের সাথে মানুষের জীবন্ত যোগাযোগ রাখতে হবে। অন্যের প্রতি সহনশীলতা, সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণী, আমরা মানুষ। এতো সহজে আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি না। আমাদের এই মানবসভ্যতা এই গ্রহে আরও বহু সহস্রাব্দ ধরে টিকে থাকুক। আমাদের পৃথিবীর এই মানবসভ্যতা ছড়িয়ে পড়ুক পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কোনায়। জয় হোক সমগ্র মানবজাতির।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১২.০৭.২০২৩ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...