সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি এবং আরও অনেক দিন বেঁচে থাকলে নতুন করে বহুকিছু দেখবো। আমার ক্ষুদ্রতম জীবনকালের মধ্যে আমি যদি নিজের জীবনটাকে সংক্ষিপ্ত আকারে মাত্র তিনটি পর্বে আলাদা করি, তাহলে সেখানে চমকপ্রদ একটি ব্যাপার দেখতে পাই যে— আমার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বৈশ্বিক ভাবে এমন একটা অদ্ভুত বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, যার দশ ভাগের একভাগ-ও গত একশো কিংবা এক হাজার বছরের মধ্যে ঘটেনি, তার আগের কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমার ব্যক্তিগত জীবনের প্রথম অংশে পৃথিবীকে আস্তে আস্তে প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত হতে দেখেছি, দ্বিতীয় অংশে গিয়ে খুবই দ্রুত গতিতে চারপাশের সবকিছু পাল্টে যেতে দেখেছি এবং শেষ অংশে এসে একের পর এক ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখা শুরু করলাম। জানি না জীবনের একেবারে শেষ সময়ে গিয়ে আরও কতো বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো! ক্ষুদ্র সেফটিপিন থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট পর্যন্ত আমার দেখা লাইফের এই দীর্ঘ জার্নি টা সম্পন্ন হয়েছে খুবই দ্রুততম সময়ের মধ্যে। ভালোভাবে সবকিছু বুঝে ওঠার আগেই।
কৃষিনির্ভর একটি দরিদ্র দেশে জন্ম নিয়ে জীবনের প্রথম অংশে আমি দেখেছিলাম উৎসবমুখর একটি আটপৌরে জনগোষ্ঠী আমার চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। তখনকার সময়ের প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ছিল আশ্চর্যজনক এক সারল্য এবং পরস্পরের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। ধর্মের ভিত্তিতে কিংবা রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে তখনও মানুষের সাথে মানুষের এতটা বিভেদ সেভাবে সৃষ্টি হয়নি। তখনকার মানুষেরা ছিল ভীষণ পরিশ্রমী এবং আমুদে প্রকৃতির। প্রচণ্ড খেটেখুটে নিজের পরিবারের অন্নের সংস্থান হয়ে গেলেই তারা বিনোদনের উপকরণের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। নিখাঁদ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এই ষড়ঋতুর দেশে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে ভাবার মতন সময় তখনো আসেনি। আমার শৈশবে বাড়িতে একটা টু-ব্যান্ড প্যানাসনিক রেডিও ছিল, ওটা চালু করে আমার কাকা প্রতিদিন সকালে ফুল ভলিউমে সংবাদ শুনতেন। সংবাদ শেষ হবার একটু পর শুরু হতো গানের অনুষ্ঠান। আমার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে আমার প্রয়াত কাকা কল্যাণ কুমার দাস ভারত থেকে একটি টেপরেকর্ডার নিয়ে এসেছিলেন। আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি, তখনই প্রথম আমাদের বাড়িতে 'নিপ্পন' ব্র্যান্ডের একটি সাদাকালো টেলিভিশন কেনা হয়। অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার আগে আমি প্রথমবারের মতো একটি ক্যাসিও ঘড়ি কিনেছিলাম।
জীবনের প্রথম অংশে আমার শৈশব থেকে বেড়ে ওঠার সময়ে প্রতিটি প্রয়োজনীয় উপকরণ এসেছে একটার পর একটা। ঠিক যখন যেটার যতটুকু প্রয়োজন, সেই হিসাব নিখুঁতভাবে মেনে। এরজন্য পুরো বিবর্তন প্রক্রিয়াটি বিশ্লেষণ করা আমার জন্য সহজ। আমার কৈশোরে আমি প্রচুর পরিমাণ চিঠিপত্র লিখে ডাকযোগে প্রিয় মানুষের কাছে পাঠিয়েছি। ভূমিষ্ঠ হয়েই ভার্চ্যুয়াল প্ল্যাটফর্ম পাইনি, তাই অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল হবার প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে অভিযোজিত হবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু জীবনের দ্বিতীয় অংশে এসে আমি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম— সবকিছুই খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পরিবর্তন আস্তে আস্তে সংঘটিত হলে মানুষ এগুলোর সাথে অভিযোজিত হবার সময় পায়। আমরা সেই সময় পাচ্ছিলাম না। রেডিও, টেপরেকর্ডার খুব দ্রুত হারিয়ে গেল। সিডি প্লেয়ার, ডিভিডি, এফএম রেডিও, ডিজিটাল ক্যামেরা, ডিজিটাল ঘড়ি, মাইক্রো এসডি কার্ড ইত্যাদি জিনিসগুলো যতটা দ্রুত এলো— হারিয়ে গেল তারচেয়েও দ্রততায়। শুধুমাত্র মোবাইল ফোনের কয়েকটি বিবর্তন প্রক্রিয়া সংঘটিত হলো মাত্র পনের বছরের মধ্যে। দেশে প্রথম চালু হওয়া মোবাইল ফোনটি দেখতে চাইলে এখন মিউজিয়ামে যেতে হবে। এতটা দ্রুত গতির পরিবর্তন কোনো স্বাভাবিক বিষয় না।
বর্তমান উত্তরাধুনিকতার অসংগতি নিয়ে আমি অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছি। এটা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য এনেছে ঠিকই, কিন্তু পরোক্ষভাবে সুখ কেড়ে নিয়েছে। সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য বিষয় দুটির মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। আগেকার দিনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেক ঝামেলা করে সিনেমা হলের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে একটা মুভি দেখা ঝামেলাপূর্ণ বিষয় হলেও বিষয়টির মধ্যে মানসিক সুখ ছিল। এখন নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করে যেকোনো মুভি ডাউনলোড করার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য আছে, কিন্তু সেই মানসিক সুখ আর নেই। আমার জীবনের তৃতীয় অংশে গিয়ে আমি ক্রমাগত ভাবে মানুষের জীবন থেকে সুখ নামক বিষয়টি হারিয়ে যেতে দেখেছি। দু'মাইল পায়ে হেঁটে কষ্ট করে স্কুলে গিয়ে শিক্ষা লাভের মধ্যে যে প্রশান্তি ছিল, ভার্চ্যুয়াল ক্লাসে সেটা ঘুণাক্ষরেও অনুভব করা সম্ভব না। প্রযুক্তি আমাদের মাঝে দূরত্বের এক অদৃশ্য দেয়াল তুলে দিয়েছে। আমরা মানুষেরা একটু একটু করে হতাশাগ্রস্ত হচ্ছি এবং সেই হতাশার ফলশ্রুতিতে আমরা আক্রমণাত্মক মানসিকতা অর্জন করছি। ঐ যে আমার বর্ণনায় বলেছিলাম— জীবনের দ্বিতীয় অংশে আমাদের সামনে থেকে পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি এতটা দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হয়েছে যে, এখন নতুন কিছুই আমাদের আর সহজে সন্তুষ্ট করতে পারে না। এখনকার দিনে আমরা সবাই কমবেশি অসন্তুষ্ট হয়ে জীবন যাপন করি।
বর্তমান সময়ে আমরা ত্রিমুখী সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমত. বৈশ্বিক রাজনীতি নিয়ে চরম অস্থিরতা এবং সহিংসতা বৃদ্ধি। দ্বিতীয়ত. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরিমাণ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া। তৃতীয়ত. নতুন নতুন বেশকিছু প্রাণঘাতী রোগের বিস্তার। এখন বিপদ আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। আমরা কিভাবে এইসব সংকট মোকাবিলা করে নিজেদের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখবো, সেটা না ভেবে বরং আমরা বেশি বেশি নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছি। সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহের একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণী হিসেবে জীবনের ত্রিমুখী সংকটে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে আমি আজকাল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করি। হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে গিয়ে তেমন কোনো বীভৎসতার সাক্ষী হবো। একটা জীবন ধরে একটানা শুধুই সাফল্যের পর সাফল্য প্রত্যক্ষ করলাম, নিত্যনতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আর মানুষের মুক্তবুদ্ধির চর্চার সুফল ভোগ করলাম, তাহলে বিপর্যয় কেন নয়? প্রকৃতির নিয়মেই রয়েছে— যতটুকু সুফল, ততটুকুই কুফল। এই নিয়ম অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই। প্রকৃতি যদিও তার নিয়মে কিছুটা ঢিমেতালে প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর সমূহ রোগব্যাধি নিয়ে হাজির হবে, কিন্তু তার আগেই আমরা মানুষেরা নিজেদের মধ্যে সেই তিন নাম্বার মহাযুদ্ধ লাগিয়ে দেবো। এভাবেই হ্যাট্রিক পূর্ণ হবে। কথায় আছে না— দানে দানে তিন দান!
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
২২.০৮.২০২৪ খ্রিঃ