বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে মানুষের মন থেকে একটু একটু করে অসংখ্য পূর্বের স্মৃতি হারিয়ে যেতে থাকে। হয়তো কয়েক বছর কেটে যাবার পর হঠাৎ করে সামনে এমন কিছু একটা বিষয় এসে যায়, যেটা দেখে বহুকাল আগের কোনো একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আবার কখনো কখনো স্বপ্নের মধ্যেও বহুকাল আগের কিছু একটা ঘটনা অস্পষ্ট ভাবে দেখা দেয়। উদাহরণ দেই— আজ সারাদিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। দুপুরে প্রবল বৃষ্টির সময়ে আমাদের উঠোন থেকে তীব্রভাবে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সেখান থেকে ছোট ছোট একঝাঁক মাছ সাঁতরে চলেছে। ঠিক তখনই কিভাবে যেন মনে পড়ে গেল খুব ছোটবেলায় বৃষ্টির মধ্যে আমি গামছা দিয়ে উঠোন থেকে সাঁতরে যাওয়া ছোট ছোট মাছ ধরতাম। একবার প্রায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরার সময় একটা জোঁক এসে আমার পায়ে লেগেছিল, এটা দেখেই আমি বিকট চিৎকার করে দৌড়ে ঘরে উঠতে গিয়ে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার কপালের কাছে খানিকটা জায়গা কেটে গিয়েছিল। ব্যাস, এতটুকুই। এর আগে বা পরের আর কোনো স্মৃতি নেই। অনেক চেষ্টা করেও সেই সময় বা তার কাছাকাছি আর কোনো ঘটনা মনে করতে পারলাম না। অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা মনে আসতে চায়, কিন্তু কিছুতেই সেটা আর গুছিয়ে নিতে পারি না।
সপ্তাহ খানিক আগে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলাম— খুব সম্ভবত মায়ের সঙ্গে আমি মামাবাড়ি যাচ্ছি। একটু ভুল বললাম, আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাচ্ছি। মা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন আর বাবার হাতে ভারী কোনো ব্যাগ। আমার পায়ের জুতোজোড়া খুবই টাইট লাগছিল বলে আমি বায়না করে মায়ের কোল থেকে নেমে পড়লাম। এরপর আমি দৌড়াচ্ছি। বাবা-মা আমাকে থামতে বলছেন, কিন্তু আমি দৌড়ে চলেছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একটি স্কুলঘরের সামনে চলে এলাম। স্কুলঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ওটা আসলে কোনো স্কুলঘর না, একটা কালী মন্দির। মন্দিরের ভেতর মানুষজন নেই। চারপাশে অদ্ভুত দর্শন অসংখ্য মূর্তি। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে বাবা-মা কে ডাকছি, কিন্তু তারা আর আমার আশেপাশেই নেই। এই স্বপ্ন দেখার পর গভীর ভাবে চিন্তা করলাম, শৈশবে আমার সাথে কখনো কি এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল? চোখ বন্ধ করে আমি ভীষণ মনযোগী হয়ে চিন্তা করলাম। কিছুটা অস্পষ্ট ভাবে কোনো একটা বিষয় মনে আসতে চায়, কিন্তু কিছুতেই সেটা পরিষ্কার ভাবে গুছিয়ে নিতে পারি না।
প্রায় এক মাস আগে বেশ আটঘাট বেঁধে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম। ভৌতিক ধরনের রহস্যময় একটি গল্প। খুব হিসেব করে গল্পের প্লট নির্ধারণ করে ঝটপট লিখে যাচ্ছি। টানা আটটি পৃষ্ঠা লেখার পর— ওটুকু পড়েই রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর বর্ণনা, এতটা নিখুঁত প্রেজেন্টেশন! তখন আমার চোখে প্রায় জল এসে যাবার যোগাড়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আট পৃষ্ঠার পর গল্প আর একটা লাইনও এগিয়ে নেওয়া গেল না। এরপর যা-ই লিখি না কেন, কেমন জানি খাপছাড়া মনে হয়। কোনোভাবে আর গুছিয়ে নিতে পারলাম না। প্রাণপণে চেষ্টা করেও আজকাল কিছুই আর গোছানো হচ্ছে না। নাকি শুরু থেকে সবকিছু অগোছালো করেই রেখেছিলাম আমি! অগোছালো জীবন, অগোছালো সময়, অগোছালো চিন্তা আর অগোছালো ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে ক্রমাগত ভাবে বার্ধক্যে ঢোকার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে— ইদানীং কেমন জানি এক অর্থহীন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অনুভূতির মধ্যে হারিয়ে যাই। এরপর সম্বিত ফিরে এলে গভীর ভাবে পুরোটা ভেবে দেখার চেষ্টা করি। সমস্ত ভুলত্রুটি আর যাবতীয় হিসাবনিকাশ একটু একটু করে মেলাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সেটা আর গুছিয়ে নিতে পারি না।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
৩০.০৬.২০২৪ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন