আনুমানিক প্রায় তিনটি বছর ধরে আমি খুব একাগ্রতা নিয়ে একটি বিশেষ চর্চার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। বইপত্র পড়ে এবং ইউটিউবে টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে দেখে নানান ভাবে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। বিষয়টা হলো ধ্যানস্থ হওয়া। এটা এতটাই কঠিন একটি প্রক্রিয়া— যা বলে বোঝানো যাবে না। মস্তিষ্ক পুরোপুরি ভাবে চিন্তাশূন্য করে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের চেতনে এবং অবচেতনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সবসময়ই কিছু না কিছু ভাবনা চলমান থাকে। এই ভাবনাগুলো কে কোনোভাবে বন্ধ করে রাখা যায় না। আমি অসংখ্য বার চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলেছি যে, আমি এখন আর কিছুই ভাবতে চাই না। আমার মন এই মুহূর্তে পুরোপুরি স্তব্ধ থাকবে। জোরের ওপর দুই-চার মিনিট এভাবে ঠিক থাকে, এরপর কোন ফাঁকে হঠাৎ একটা ভাবনা চুপচাপ ঢুকে পড়ে এবং সেটার লেজ ধরে আরও অনেকগুলো ভাবনা ঢুকে পড়ে। সেগুলো কে তাড়িয়ে দিয়ে মনের ঘরে কপাট লাগিয়ে আবারও যখন একটু স্তব্ধ হই— তখন আবারও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ। একপর্যায়ে 'ধুত্তেরি' বলে উঠে যেতে বাধ্য হই। যদিও বছর দুয়েক ধরে 'প্রাণায়াম' নামের যোগ টা ঠিকঠাক ভাবে করে যাচ্ছি। তবে শিথিলায়নের একটি পর্যায়ে গিয়ে জগৎ-সংসারের সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর কনসেন্ট্রেশন দেওয়া কিছুতেই আর সম্ভব হচ্ছিল না।
বর্তমান সময়ের আরও অসংখ্য মানুষের মতো আমার মধ্যেও একটি অভ্যাস ভয়াবহ ভাবে ঢুকে গিয়েছিল। সেটা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সার্বক্ষণিক ভাবে যুক্ত থাকার প্রবনতা। তবে গত দুই মাসের মধ্যে অবিশ্বাস্য ভাবে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মানুষের সাথে হঠাৎ করে দূরত্ব তৈরি হবার কারণে আজকাল আমি সেভাবে অনলাইনে অ্যাক্টিভ থাকি না। কেউ যে আমাকে এখন আর খুঁজবে না, এটা পুরোপুরি মন থেকে মেনে নেবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কিছুটা দূরত্ব ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছিল। এরমধ্যেই হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে টালমাটাল অবস্থা, চলমান সহিংসতা এবং নৈরাজ্যের জের ধরে ইন্টারনেট সিস্টেম বন্ধ হয়ে গেল। এটা আমার জন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল, কারণ ইন্টারনেট পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আমি মানসিক ভাবে একটি নিশ্চিত স্থিরাবস্থায় পৌঁছে গেলাম যে— আমার এই মুহূর্তে আসলে কোনো দিকে ফোকাস দেবার প্রয়োজন নেই। মোবাইল ফোনের সাথে আমার সংযোগ যেহেতু তখন পুরোপুরি ঘুচে গেছে, তাই আবারও একবার ধ্যানের গভীরে যাবার চেষ্টা করলাম।
সময়টা ছিল ২১ জুলাই ২০২৪, দিবাগত রাত। সেদিন প্রায় সারাদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে, এমনকি রাতেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। আনুমানিক রাত একটার পর বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেল। মেঘমুক্ত আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার অপূর্ব চাঁদ। চারপাশে ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙের একটানা ডেকে যাওয়ার শব্দ, এরপর মাঝেমধ্যে ওদের কোলাহল থেমে যাওয়া। সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে এক অপার্থিব শিথিলতা। আমার কোনো তাড়া নেই, কারো জন্যে প্রতীক্ষা নেই। দেশের সামগ্রিক এই সংঘাতময় পরিস্থিতি কিংবা দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুটিনাটি হিসাবনিকাশ ভুলে আমি যেন একটা আদিমতম পরাবাস্তবতার মুখোমুখি সেই মুহূর্তে। আমি বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নিলাম এবং চোখ বন্ধ করে নিজের মধ্যে নিমগ্ন হলাম। এর আগে আমি যতবারই ধ্যানস্থ হবার চেষ্টা করেছি, সব সময়ই মনের মধ্যে একটা বাড়তি তাড়না ছিল যে— বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলো কে দ্রুত তাড়িয়ে দিতে হবে। এদিন আর সেই বাড়তি চাপ টুকুও মনের ওপর প্রভাব ফেলেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি কোথায় যেন তলিয়ে যেতে শুরু করলাম। এখন সচেতন অবস্থায় আমি সেই মুহূর্তের বিচিত্র অনুভূতি লিখে প্রকাশ করতে পারবো না, কিন্তু সেটা ছিল আমার এযাবৎকালে জন্মানো বোধের বাইরের এক অনুভব। পুরোপুরি ভাবে চিন্তাশূন্য এক অবিশ্বাস্য জীবন্ত অনুভূতি। ঠিক কতক্ষণ এভাবে মোহাবিষ্ট হয়ে ছিলাম জানি না, তবে যখন আবারও আমার মাথায় ভাবনা অনুপ্রবেশ করলো— আমি লক্ষ্য করলাম বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে এবং আমার পোষা বিড়াল টা চিৎকার করে ডাকছে। দরজা খুলে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া বিড়ালটিকে ঘরে এনে এক কাপ চা বানিয়ে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া বিষয়টি ভাবতে বসলাম। এটা ছিল আমার জীবনের চল্লিশ বছর পার করার পরের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি, যখন আমি জীবনে প্রথম বারের মতো সত্যিকার অর্থে চিন্তাশূন্য স্থিরাবস্থায় প্রবেশ করে ধ্যানস্থ হলাম। প্রত্যাশা করি— প্রক্রিয়াটির আরও উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবো।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন