সবকিছুই সেই পূর্বের অবস্থানে বারবার করে ফিরে ফিরে আসে, এভাবেই একটি চক্র পূর্ণ হয়। জীবনের চক্র কিংবা সময়ের চক্র। সুপ্রাচীণ এক মহাজাগতিক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়ে চতুর্পাশে ছড়িয়ে পড়েছিল যে অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড— কালের আবর্তে একদিন সেটাও মহা সংকোচনের মাধ্যমে পরিনত হবে ক্ষুদ্রতম একটি বিন্দুতে, এক সময় সেই বিন্দুটিও অদৃশ্য হয়ে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে না কিছুই, শুরু হবার সেই আগেকার অবস্থার মতো। এভাবেই পূর্ণ হবে সময়ের চক্র। বায়োলজিক্যাল প্রাণী হিসেবে প্রাচীনকালে এই গ্রহেও শুরু হয়েছিল আমাদের লাইফের জার্নি। একটু একটু করে মেরুদণ্ড সোজা করে আমাদের চলতে শেখা, হাত-পায়ের সুষম ব্যবহার করতে শেখা, এরপর আগুন আবিষ্কার, গুহা থেকে বেরিয়ে মুক্ত স্থানে বসতি স্থাপন, চাকা আবিষ্কার এবং বহুদূর পর্যন্ত নিজেদের কে চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সেই প্রাচীনতম নিয়ম মেনে আমরাও ক্রমাগত ভাবে নিজেদের ছড়িয়ে দিতে শিখলাম চতুর্পাশে। নিজেকে জানা এবং নিজের গ্রহটিকে এক্সপ্লোর করার সেই বুনো উল্লাসে ভেসে আমরা জন্ম দিলাম আধুনিকতা নামের একটি পারিপার্শ্বিক আচ্ছাদন। এরপর থেকে শুধুই ছুটে চলা। এভাবে সভ্যতার পথে ছুটতে ছুটতে একটি পর্যায়ে গিয়ে আমরা, অর্থাৎ মানুষেরা লক্ষ্য করলাম যে— সবকিছুই কেমন জানি একঘেয়ে হয়ে গেছে। কোনকিছুর মধ্যে আর সেভাবে আগ্রহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই শুরু হলো পুরনো দিনের জীবনের স্পর্শ নিয়ে নতুনত্ব সৃষ্টির এক অদ্ভুত ফর্মুলা। ওল্ড লাইফস্টাইলের বৈচিত্র্যে মোড় নিল জীবনের নতুন গতিপথ। জংধরা পুরনো আমলের ফ্যাশন নতুন ভাবে বিক্রি করে কিছুদিন কেটে গেল ঠিকই, কিন্তু এরপর আবারও সেই একঘেয়ে জীবন। অতীত-বর্তমান এবং বর্তমান-অতীত কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আর কতকাল চলে! জীবনচর্চার মধ্যে অভিনব কিছুই তো আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যা কিছুই নতুন হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, তার পুরোটাই যান্ত্রিকতার অবয়বে মোড়া।
আজ থেকে একশো কিংবা দেড়শো বছর আগেও মানুষের প্রতি মানুষের এক নিবিড় আত্মিক টান লক্ষ্য করা গেছে। পরিচিত কেউ মারা গেলে আশেপাশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে গভীর বিষাদ নেমে আসতো। হারিয়ে যাওয়া মানুষটির অভাব ভুলতে বাকি মানুষদের কয়েক বছর লেগে যেতো। আর আজকাল খুব ঘনিষ্ঠ আপনজন মারা গেলেও মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটেনা। মৃত মানুষটিকে ভুলে যেতেও সময় লাগে না এখন। আবেগ-অনুভূতির জায়গায় সবাই খুব বেশি নির্লিপ্ত। আগেকার দিনের মানুষের প্রতিটি পরিবারে একগাদা সন্তান থাকার নেপথ্যেও ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তখনকার সময়ে ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি নিয়ে মানুষের মধ্যে তুমুল আগ্রহ এবং এই বিষয়টিকে উপভোগ করার বিষয় ছিল। সত্যিই তারা এটা থেকে দুর্দান্ত ফিজিক্যাল প্লেজার লাভ করতেন। আর এখনকার সময়ের মানুষের মধ্যে থেকে সেই প্রাকৃতিক বুনো আনন্দ হারিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ের অর্গাজমে সম্ভবত সেই পুরনো দিনের মতো শিহরণ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন ধরে বলতে হয়— 'কাঁচা লঙ্কায় এখন আর তেমন ঝাল নেই!' আজকাল সবকিছুর মধ্যে একটা কৃত্রিমতার ছোঁয়া। প্রকৃতি এখন মানুষের মধ্যে থেকে অনেক জৈবিক অনুভূতি লুপ্ত করে দিচ্ছে। মানুষ আজকাল এক মুহূর্তের নোটিশে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়। কেউ আজকাল বাড়তি পেইন নিতে পছন্দ করে না।
কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার রেশ ধরে সারাদেশের ইন্টারনেট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হলো। এবারই প্রথম অসংখ্য মানুষ একটি বিষয় বুঝতে পেরেছে যে— কোনো কিছুর সাথে অতিরিক্ত রকম অভ্যস্ততা তৈরির পর সেই বিষয়টির অনুপস্থিতির প্রতিক্রিয়া কতখানি মারাত্মক হতে পারে। যুগের হাল-হকিকত মেনে নিয়ে আমরা সবাই এখন খুব বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। তবে এটাও আমাদের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা দরকার যে, হঠাৎ করেই প্রযুক্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর বর্তমান যে পরিস্থিতি, সবখানেই যেরকম যুদ্ধংদেহী মনোভাব, তাতে অদূর ভবিষ্যতে গোটা পৃথিবীতে ভয়ংকর কোনো সংঘাত ঘটে গিয়ে সমস্ত পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে, তাতে আমি খুব বেশি অবাক হবো না। হয়তো একটা সময় আবারও আমাদের পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে আর একজন মানুষের খোঁজে, হয়তো আবারও আমাদের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠি লিখে পাঠাতে হবে দূরের একজন প্রিয় মানুষের কাছে। হয়তো সুসজ্জিত দালান-কোঠা ছেড়ে আমাদের আবারও গুহাবাসী হতে হবে। ভবিষ্যতের কথা যদিও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না, তবে— সবকিছুই সেই পূর্বের অবস্থানে বারবার করে ফিরে ফিরে আসে, এভাবেই একটি চক্র পূর্ণ হয়। জীবনের চক্র কিংবা সময়ের চক্র।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
২৯.০৭.২০২৪ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন