প্রায় বছর দশেক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে একটি ডকুমেন্টারি ভিডিও দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। ভিডিওটির বিষয়বস্তু এরকম যে— একটি তৃণভোজী প্রাণী তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি জলাশয়ে নেমে তৃষ্ণা নিবারণের মুহূর্তে একদল ক্ষুধার্ত হায়েনা সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। হিংস্র হায়েনার থেকে বাঁচার তাগিদে নিরীহ পশুটি জলে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে অন্য পাড়ে গিয়ে যখন পৌঁছালো, ততক্ষণে হায়েনার দল সেখানে পৌঁছে গেছে। পশুটি আবারও বহুকষ্টে সাঁতার কেটে অন্য দিকে রওনা হলো, কিন্তু সেখানেও হায়েনা চলে গেছে। সে তার সমস্ত প্রচেষ্টা করে যেদিক থেকে উঠে যেতে চেষ্টা করে, সেখানেই হায়েনারা দাঁড়িয়ে থাকে। সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পশুটির তখন ডুবে যাবার দশা। সে শেষবারের মতো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে জলাশয়ের তীরে উঠে দাঁড়ালো, প্রচণ্ড পরিশ্রমে সে তখন হাঁপাচ্ছে। ঠিকমতো বুকভরে দুইবার নিঃশ্বাস নেবার আগেই তার ওপর হিংস্র হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মেরে ফেললো।
আজকালকার এই ভুল ব্যবস্থাপনার বৈষম্যের পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশি বেশি আত্মঘাতী হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অসংখ্য আত্মহত্যার সংবাদ শুনতে পাচ্ছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে এটার বিরুদ্ধে খুব দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। ফেসবুকেই এটা নিয়ে অনেক বার লিখেছি। আমি সবসময় বলতাম— যা-ই ঘটুক, কখনো নিজেকে শেষ করে দেওয়া যাবে না। প্রতিকূলতার এই পৃথিবীতে যেভাবেই হোক সার্ভাইব করতে হবে। নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আপনি হারিয়ে গেলে কারো কিছুই এসে যাবে না, শুধুমাত্র আপনিই নিজের জীবন টা নষ্ট করবেন। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নিলে আপনাকে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে। হাল ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের সাথে শঠতা, এটা একটা কাপুরুষোচিত আচরণ। এই টাইপের অসংখ্য অসংখ্য গালভরা বয়ান নানান ভাবে, নানান উপমায় একটি সময় আমি লিখেছিলাম।
ইদানীং সামগ্রিক বাস্তবতা আর প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিরূপ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে— যে মানুষগুলো ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা হয়তো তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছিল। সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পরেই তারা শেষমেশ নিশ্চিত একটি পরিনতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে। সত্যিকার অর্থে আমার কাছে তাদের এখন আর ততটা নির্বোধ মনে হয় না। এই পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণীর ভীড়ে মানুষও একটি সাধারণ জীব। আর দশটি প্রাণীর মতো সে-ও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এতো সুন্দর এই গ্রহের আলো-বাতাসে ভালোমন্দ মিশিয়ে স্বাভাবিক একটা জীবন কাটিয়ে দিতে কে না চায়! জীবন তো মোটে একটা। তবুও যখন কোনো কিছুতেই আর কিছু হয় না, যখন জীবনের সামগ্রিক প্রতিকূলতা চক্রব্যূহের সেই সপ্তরথীর মতন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ক্রমাগত ভাবে আক্রমণ করে যায়, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের অবস্থা হয় সেই নিরীহ হরিণটির মতো— যে বারবার করে সাঁতার কেটে হাঁচড়েপাঁচড়ে তীরে উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু তীরে দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র একদল হায়েনা। সে বারবার করে সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে একটি সময় নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
০৮.০৭.২০২৪ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন