বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

'যাপিত এইসব দিন'


কুয়াশাচ্ছন্ন শীতার্ত দিনগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু দেরি করেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে। শরীরের মাঝে কিংবা অবচেতনে কোথায় যেন একটা আড়ষ্টতা বেশ ভালোভাবেই থাবা গেড়ে বসে থাকে। কম্বল টা আরও খানিকটা টেনে কান এবং গলা ঢেকেঢুকে দিব্যি বেলা এগারোটা পর্যন্ত পড়ে থাকতে ভালোই লাগে আমার। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই বিচিত্র অভ্যাস টা যদিও আমার আগে কখনও ছিল না, বছর দুয়েক ধরে এভাবে থেকে আরাম বোধ করি। এটাই বয়স হয়ে যাবার সেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। বুড়ো হচ্ছি আমি। ইদানীং চিন্তাভাবনার মধ্যেও আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে নিজেই কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে থাকি। শরীরের মধ্যেও এসেছে শ্লথ হয়ে যাবার সুক্ষ্ম অনুভূতি। একটি বিষয় খুব নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতে পারি আজকাল। মানুষের পুরোটা জীবনকালে দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় আসে। একটি হলো তার বাল্য থেকে যৌবনে পদার্পণের সেই বিশেষ সন্ধিক্ষণ, যাকে বলে বয়ঃসন্ধিকাল, আর দ্বিতীয়টি হলো তার যৌবন থেকে বার্ধক্যে পদার্পণের বিশেষ সন্ধিক্ষণ। আমরা আমাদের প্রচলিত জীবনে শুধুমাত্র বাল্য থেকে যৌবনে যাবার সময়টা নিয়েই বেশি আলোচনা করি। এই স্টেজে থাকা কিশোর-কিশোরীদের মনো-দৈহিক অবস্থার বিবিধ বর্ণনা করে থাকি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পে লেখক লিখেছিলেন, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।' রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সমাপ্তি' গল্পে লিখেছিলেন, 'কখন বিধাতা তাঁর নিপুণ অস্ত্র দ্বারা মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই।'


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র কৈশোরের এই বয়ঃসন্ধিকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিধ বর্ণনা করে গেছেন। অথচ একজন মানুষ যখন তার যৌবনকাল অতিক্রান্ত করে বার্ধক্যের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে, সেই সময়কার একজন মানুষের মনো-দৈহিক পরিবর্তন কিংবা সেই মুহূর্তে দাঁড়ানো একজন মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেভাবে আলোচনা করতে তেমন কেউ আগ্রহী হননি। ঠিক যেভাবে তোরো-চৌদ্দ বছরের একজন মানুষ তার আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন দেখে চমকে যায়, সেটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে না পেরে একধরণের হীনমন্যতায় ভোগে, একইভাবে চল্লিশ বা একচল্লিশ বছর পার করা একজন মানুষের জন্যেও তার ব্যক্তিগত জীবনের আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন দেখে বিষ্মিত হওয়া এবং এটার সঠিক কোন ব্যাখ্যা না পেয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার কষ্টকর অনুভূতি হয়। এই বিশেষ স্টেজ টা অনেকেই পার করে গেছেন এবং আরও অনেকেই পার করে যাবেন। যারা এটা পার হয়ে গেছেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন এই সময়টিতে তাদের কেমন আকষ্মিক অনুভূতি হয়েছিল। আমি এখন এই স্টেজে দাঁড়িয়ে এটাকে বুঝতে চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তের সবচেয়ে খারাপ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হলো কোনকিছুতে আগ্রহ না পাওয়া এবং মাঝেমধ্যে সবকিছুকেই অর্থহীন মনে হওয়া। এই সময়েই সম্ভবত একজন মানুষ তার জীবনে 'কি পেলাম আর কি হারালাম' টাইপের বিষয় টা প্রথম ভাবতে শুরু করে, আস্তে আস্তে এই ভাবনা টা আরও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায়। এই স্টেজে দাঁড়িয়েই মানুষের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতির প্রথম জন্ম হয়, সেটা হলো চারপাশে অনেক মানুষজন থাকার পরেও অকারণে নিঃসঙ্গতার এক অদ্ভুত অনুভূতি। আমি অসংখ্য অসংখ্য পুরোদস্তুর সংসারী মানুষের সাথে কথা বলে দেখেছি, তাদের এই সময়ে এসে এই বিশেষ অনুভূতি তৈরি হয়েছে। এই স্টেজে এসেই একজন মানুষ হঠাৎ করে শারীরিক ক্লান্তিকে প্রথম বার প্রচ্ছন্ন ভাবে অনুভব করতে শুরু করে, যেটা দুই-এক বছর আগেও তার ছিল না। এই সময়ে এসে একজন মানুষ হঠাৎ করেই অকারণে কিছুটা খিটখিটে আচরণ শুরু করে, অল্পতেই তার মেজাজ হারাতে শুরু করে। এটা যদিও পরে ব্যালান্স করে নেয়, কিন্তু এই সময়ের এই হঠাৎ ক্ষিপ্ততা তার নিজের জন্যেও অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এই বয়সে এসে একজন মানুষের মধ্যে ধৈর্যের আকষ্মিক একটা অভাব এসে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিনের যাপিত জীবনে তার সেই ধারণ করা মনোযোগে ঘাটতি এসে যায়। দীর্ঘদিনের একজন বাচাল মানুষও এই সময়ে খানিকটা চুপচাপ হয়ে যায়। তোরো-চৌদ্দ বছর বয়সে একজন মানুষ একটু একটু করে নিজেকে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত হয়, কিন্তু এই চল্লিশ-একচল্লিশ বছর বয়সে এসে মানুষ হঠাৎ করে খানিকটা গুটিয়ে যেতে শুরু করে। সহজে বলতে গেলে বাহুল্যটুকু ঝেড়ে ফেলে নিজের নিরেট টুকুকে আশ্রয় করে সে আগামীর জন্য প্রস্তুত হয়। এই সময়ে এসে একজন মানুষ হঠাৎ করে অনেক অপ্রকাশিত বিষয় বুঝে ফেলতে শুরু করে। তার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন টা হয় তার বোধের।


শ্লথ হয়ে যাওয়া চেতনার সাথে নিজের এই আলাপনের মাঝে কখন জানি দুপুর গড়িয়ে গেছে। আজকেও রোদের দেখা মেলেনি। চারপাশে কেমন একটা কুয়াশায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, অকারণে মনটা খানিকটা ডাউন করে দেয়। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু শরীরে কোথায় যেন চিরাচরিত সেই উৎসাহ টা খুঁজে পাচ্ছি না। বিড়ালগুলো গতকাল রাত থেকে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের নিজস্ব প্রাকৃতিক চাহিদার কাছে আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া ওদের কাছে গৌন। সবাই আছে যার যার নিজস্ব প্রয়োজন আর মানিয়ে চলার প্রথাগত অভ্যাসের টানে। পৃথিবীও ঘুরে বেড়াচ্ছে অচিন সেই মহাকর্ষ সূত্র ধরে। দিন ফুরিয়ে রাত আসছে, আবারও রাত ফুরিয়ে দিন। এই কুয়াশায় মোড়া শীতের সময় বিদায় নিয়ে সামনেই আসবে মাঠঘাট চৌচির হওয়া চৈত্রের দাবদাহ। নানান আয়োজনে পূর্ণ হবে সবার জীবন কিংবা উজাড় হবে কেউ কেউ। আহা! কতটাই না তুচ্ছ এই জীবন! অথচ আমরা টেনেটুনে, ফুলিয়ে-ফালিয়ে এটাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করি। এখন কষ্টেসৃষ্টে চারটে মুখে দিতে হবে, মহিমান্বিত না হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কী আর করবো, আমার সময়টাই যে এখন গোলমেলে! ঠাকুরদা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে বলতাম, শুধু তোরো-চৌদ্দ বছর-ই বালাই নয় ঠাকুর মশাই, চল্লিশ-একচল্লিশ বছরও খুব বড় একটা বালাই। যে বালাইনাশক খুঁজতে গিয়ে আজকাল নিজেকে নিয়ে খুব বেশি বিপত্তির মধ্যে আছি। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস/ 🍂

২১.০১.২০২৪ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...