সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে এই প্ল্যানেটে জন্ম নেবার পরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখা এবং অনেক অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ধীরেসুস্থে জীবনটাকে টেনেটুনে আরও খানিকটা দীর্ঘায়িত করা। একটি বহুকোষী প্রাণী হিসেবে আমাদের লাইফের জার্নি টা সত্যিই ভীষণ কঠিন। জন্ম প্রক্রিয়ার শুরুতেই মিলিয়ন মিলিয়ন স্পার্মের সাথে প্রাণপণে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে নিষিক্ত হবার পুরষ্কার প্রাপ্তি শেষে নিজেকে ভ্রূণের রূপে কনভার্ট করা, এরপর একটি ফিটাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ, তারপর... আস্তে আস্তে মাতৃগর্ভে প্রবল ধৈর্য্য সহকারে নিজের পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে একটি বিশেষ দিনে প্রকৃতির অপার মায়ায় ঘেরা এই পৃথিবীতে প্রথম বারের মতো বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া কিংবা প্রথম বারের জন্যে ঠিকরে ওঠা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণে চোখ মেলে বিস্মিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে পরম সৌভাগ্যের বিষয়। জন্ম নেবার আগেই অসংখ্য শিশু মাতৃগর্ভে তার লাইফের জার্নি শেষ করে, অপূর্ব সুন্দর এই পৃথিবীকে আর তাদের দেখার সৌভাগ্য হয় না!
একজন মানব শিশুর জন্ম নেবার পর থেকে তার বেড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। শিশুকালেই তার চারপাশে মারাত্মক কিছু রোগব্যাধি হুমকি হয়ে বিচরণ করে, সেসব রোগের সাথে মোকাবিলা করতে হয়, শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে হয়। এছাড়া খাবারের বিষক্রিয়া, মায়ের অসচেতনতার কারণে হঠাৎ দূর্ঘটনার শিকার হওয়া, ক্ষতিকর প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, জলাশয়ে পড়ে ডুবে যাওয়া, ছেলেধরা কর্তৃক ধৃত হওয়া, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সহ আরও অনেক ধরনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শৈশব থেকে একজন মানুষ কে বেড়ে উঠতে হয়। পরবর্তী সময়ে তার জীবনের দুর্গম পথে প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে খুব বেশি সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলতে হয়। এই যাত্রা বড়ই দুরূহ। কারণ তার চলার পথে ওঁৎ পেতে থাকে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগ, প্রতিটি দিনে থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় নেই হয়ে যাবার সংশয়, থাকে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, থাকে শত্রু দ্বারা নিহত হবার সম্ভাবনা, এছাড়াও থাকে নিজের মধ্যে জেঁকে বসা তীব্র হতাশার কারণে আত্মঘাতী হবার সম্ভাবনা। এতো এতো বৈপরীত্য অতিক্রম করে একজন মানুষ যখন নিজেকে গভীর যত্নে দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়, এর চেয়ে চমৎকার ব্যাপার আর কী-ই বা থাকতে পারে!
আজ ২৯ শে আগষ্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। এই প্রতিকূলতার পৃথিবীতে আজ আমি আমার জীবনের চল্লিশটি বছর পূর্ণ করলাম। একজন মানুষের জীবনে চল্লিশ বছর যথেষ্ট দীর্ঘ একটি সময়। এতো লম্বা একটি সময় ধরে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখতে পেরে আজ আমি ভীষণ আনন্দিত। এই দীর্ঘ চল্লিশটি বছরের হিসেব মেলাতে গিয়ে আজ মনেহলো, আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে পূর্ণতার তেমন কমতি নেই। কারণ পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোটি কোটি প্রাণীর ভীড়ে বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন, সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে পারা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্বীয় বোধের দ্বারা এর উদ্দেশ্য সমূহের কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারা'টা কি কম সৌভাগ্যের বিষয়! প্রতিটি দিনের কাকডাকা ভোরের সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ঝিঁঝিঁডাকা নীরব রাতের মধ্যপ্রহর পর্যন্ত প্রত্যেকটি মুহূর্ত কে নিজের মতো করে উপলব্ধি করেছি, জীবন কে বুঝতে চেয়েছি একান্তই ব্যক্তিগত দর্শনের আলোকে। গিনিপিগের মতো নিজেকে অসংখ্য বার ছিঁড়েখুঁড়ে বুঝতে চেয়েছি এই জীবনের অর্থ কি, কেন বেঁচে থাকে মানুষ? কোন তীব্র স্বপ্ন কে সাকার করার জন্য চারিদিকে এতো এতো দাঙ্গা হাঙ্গামা? মোহগ্রস্তের মতন এতো এতো মানুষ প্রতিনিয়ত কোথায় ছুটে যাচ্ছে? এইসব প্রশ্নের ভীড়ে আমার আজও জানা হয়নি অনেক কিছুই, খোঁজা হয়নি নিজেকে একান্ত নিজের সত্তার গভীরে। তবুও নিত্যকার যাপিত জীবনের খুটিনাটি নিয়ে আরও খানিকটা ভাবালুতা পেয়ে বসবে আমাকে, বেলা শেষে প্রতিটি দিন ফুরাবে নীরব রাতের জঠরে। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে বয়ে যাবে সময়, আর এর রেশ ধরেই একদিন বাজবে চীর বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি। এইতো সব! তবুও সর্বসাকুল্যে ক্ষুদ্র এই জীবনের কাছ থেকে যতটুকু যা পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। এই পর্যন্ত যাপন করা জীবনে কি পাইনি বা কতটুকু হারিয়েছি, সেইসব নিয়ে অযথা আক্ষেপের চেয়ে এটা ভাবতেই এখন ঢের আনন্দ হচ্ছে যে, আজ থেকে উনচল্লিশ বছর আগে ঠিক এমনই একটি দিনে এই নীল-সবুজের গ্রহে জন্মেছিলাম আমি!
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
২৯.০৮.২০২৩ খ্রিঃ