বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩

'নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণ'

 

কেন জানি আজ খুব করে মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব দিনগুলোর কথা। তখন সবেমাত্র এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি, সেটা ছিল ২০০০ সালের কথা। পড়াশোনার সমস্ত চাপ হঠাৎ করে শেষ হবার পর নির্লিপ্ত সময় কিছুতেই কাটছিল না। একে তো কিশোর বয়স, তার ওপর অদেখা আগামীর বর্নিল হাতছানি। সবকিছু মিলিয়ে খানিকটা দিশেহারা আমি তখন। ঠিক সেই সময় তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা। আসলে ওই সময় গুলোকে এখন ব্যাখ্যা করতে পারবনা। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় যদিও স্কুলে। আমরা দুজনেই সহপাঠী ছিলাম। খুবই চুপচাপ ধরনের ছেলে ছিল সে। স্কুল জীবনে কখনও তার সাথে কথা বলেছি বলে তো মনে পড়েনা। তবে এস.এস.সি পরীক্ষার আগে তিন মাস আমাদের স্কুল টিচার অরুন স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়েছিলাম। অরুন স্যারের ব্যাচে গিয়েই ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ। কে জানত, এই সাদামাটা নিতান্ত অমিশুক ছেলেটাকে আমি এতটা পছন্দ করে ফেলব!

ওর নাম শিমুল। সম্পূর্ন নাম মোঃ আখিরুজ্জামান। যাইহোক, পরীক্ষার পরের সময়গুলো আমাদের যে কতটা আনন্দে কেটেছে তা ব্যাখ্যাতীত। আমরা তখন রেগুলার নিয়ম করে যেটা করতাম তা হল, সাইকেল নিয়ে পুরোটা বাগেরহাট চক্কর দেওয়া। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। এরপর আমরা লঞ্চ টার্মিনালের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে বসে স্ন্যাকস্ আর কফি খেতাম। জীবনে অনেক ভালো ভালো খাবার হয়তো খেয়েছি, কিন্তু সেই সময়ের মতো মজা কখনও উপভোগ করতে পারিনি। আর এই সবকিছুই শিমুলের জন্য। আমাদের প্রতিদিনকার ভ্রমনের জায়গা ছিল সাধারনত ষাটগম্বুজ স্টেশন, সাবেকডাংগা, হাঁড়িখালির কাঠের পুল, ভৈরব নদীর পাড়, দশানী প্রভৃতি। কিছুদিন পর আমাদের সাথে যুক্ত হয় আমাদের স্কুল জীবনের আর এক সহপাঠী রিফাত আদনান রাজন। তবে সেইসময়ে রাজন আমদের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ট না হলেও তার মাধ্যমে আমরা অসাধারন একটা বন্ধু পেয়েছিলাম। তার নাম আল ওয়াসিম রনি। এরপরের দিনগুলোতে প্রধানত আমরা তিনজনেই বেশি আড্ডা দিয়েছি। শিমুল, রনি এবং আমি। কিছুদিন পরে শিমুল খুলনা চলে যায়। সেই সময়ে ভীষণ ভাবে মিস করতাম ওকে। সত্যি বলতে কি, শিমুল কে ছাড়া কোন আড্ডাই কখনও জমত না। তবে পড়াশোনার ফাঁকে কখনও ছুটিছাটা পেলেই শিমুল চলে আসত। ততদিনে আমাদের আড্ডাস্থল পরিবর্তিত হয়ে দশানী পচাঁদীঘির পাইপের ওপর এসেছে।

তখন ২০০৩ সাল। হঠাৎ ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা দিনাজপুর বেড়াতে যাব। যেই কথা সেই কাজ, কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই আমি আর শিমুল ডিসেম্বরের সেই কনকনে ঠান্ডায় ট্রেনে চড়লাম। গভীর রাতে অন্ধকার ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে সীমান্ত এক্সপ্রেস, আমরা দুই বন্ধু বিস্মিত চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি। এরপর কত অসংখ্য বার যে ট্যুর করেছি, কিন্তু সেই ট্যুরের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। আসলে শিমুল ছিল অন্য রকম একটা ছেলে। প্রেম করা তো বহুদূরের বিষয়, কখনও কোন মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আসলে চরিত্রগত কারনে নাকি অন্য কোন কারনে ওর প্রতি আমার আলাদা ধরনের এক অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল, যা আজও অবিচল।

এরপর জীবনে এসেছে হাজার রকম চড়াই-উৎরাই, অনেক রকম অভিজ্ঞতায় হয়েছি পরিপূর্ন। পরিচিত হয়েছি অসংখ্য মানুষের সাথে। অনেক বন্ধু এসেছে, অনেক বন্ধু হরিয়েও গেছে। আমি জানিনা, হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন, সেই সব প্রিয় বন্ধু আজ কোথায়! অনেকে আজ কাজের সন্ধানে হয়েছে প্রবাসী, অনেকে সম্পূর্ন ভাবে জড়িয়ে গেছে সংসার জীবনে। জীবন থেকে একটু একটু করে হারিয়ে গেছে দিন, মাস, বছর, যুগ। পৃথিবীও একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছে অবিরত তার নিজের অক্ষে। শুধু অমিই হয়তো এখনও দাঁড়িয়ে আছি একই জায়গায় পুরোনো কিছু স্মৃতিকে আকড়ে নিয়ে। তবে সবকিছু বদলে গেলেও শিমুল কিন্তু এখনও হারিয়ে যায়নি। আজও কর্মব্যাস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই সে আমার কাছে আসে। আমরা আবারো ফিরে চলে যাই ফেলে আসা সেইসব দিনে, হয়তো পুরনো সেইখানে, ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলাম বহু বছর আগের কোন একদিন!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
🍂

'ব্যক্তিগত দর্শন'


খুব সম্ভবত নবম কিংবা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আমি মোতাহের হোসেন চৌধুরী'র লেখা 'শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব' নামক গদ্যটি পড়ে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখনকার বয়সে যদিও সেইসব দার্শনিক কথার তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু বিষয়টি মাথায় ঠিকই থেকে গিয়েছিল এবং বেড়ে ওঠার সাথে সাথে একসময় বুঝতে পারলাম ঠিক কতখানি গভীরতা রয়েছে ঐ লেখাটির মাঝে। এরপর পরিনত বয়সে এসে একটু একটু করে প্রাচ্য দর্শন, আত্মিকবাদী রচনা, স্পিরিচুয়ালিটি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর পড়েছি এবং নিজে নিজে চিন্তা করে বিষয়গুলোর ব্যাপকতা বুঝতে চেষ্টা করেছি। স্বতন্ত্র একটি প্রাণী হিসেবে এই পৃথিবীতে জন্ম নেবার পর একজন মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত কোথায় ছুটে চলেছি, কি মহান উদ্দেশ্য কে চরিতার্থ করার জন্য আমাদের এই প্রাণপণ প্রচেষ্টা এবং এতো এতো লাফঝাঁপ করে অবশেষে আমাদের প্রাপ্তি ঠিক কতটুকু? এই ভাবনাগুলো আমাকে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। আমি দেখেছি- প্রাচীণকাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা এবং পুরুষানুক্রমিক প্রথা কে আঁকড়ে ধরে অনিশ্চিত পথে ছুটে যাচ্ছে বর্তমানের মানুষ। অনেকে আদৌ জানেই না কেন তারা বাধ্যতামূলক ভাবে এসব করে যাচ্ছে! মুলত একটি সদ্যোজাত শিশুর জন্মের পর যখন সে একটু বড়ো হয়, তখনই তাকে তার পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থায় অনিবার্য ভাবেই কিছু শিক্ষা নিতে হয়। তাকে শেখানো হয়ঃ

'তুমি এখন স্কুলে যাবে তারপর আরও একটু বড়ো হয়ে কলেজে যাবে। তোমার পাঠ্য বইয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী কি লিখেছেন তা শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসবে, তাহলে রেজাল্ট ভালো হবে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সবশেষে তোমাকে একটি সনদপত্র দেওয়া হবে, যেটি দেখিয়ে তুমি একটি মানসম্মত চাকরি পেতে পারো। তারপর তোমার উপার্জন প্রদর্শন করে তুমি বিপরীত লিঙ্গের একজন সঙ্গী বেছে নিয়ে সন্তান উৎপাদন করবে এবং তাদের প্রতিপালন করবে, একটি সময় সমূহ জরা নিয়ে বার্ধক্য এসে তোমাকে ঢেকে দেবে আর তুমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবে। ব্যাস! এটাই তোমার পুরো জীবন। তুমি নিজেকে এভাবেই পরিচালিত করবে কারণ তোমার পূর্বপুরুষেরাও ঠিক এটাই করে এসেছেন!'
কোমলমতি শিশুরাও পারিবারিক কিংবা সামাজিক সেই আদেশ শিরোধার্য করে রণপা হয়ে এগিয়ে চলে অদেখা আগামীর পথে। যদি তাদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন করে বসে, 'আচ্ছা, আমার পূর্বপুরুষগন এই কাজ করে গেছেন বলে আমাকেও কেন একই ট্রেডিশন মেনে চলতে হবে? আমি তো স্বতন্ত্র একটি প্রাণী, আমি তো স্বতঃস্ফূর্ত সত্তা, আমার মগজেও তো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউরন রয়েছে, যেখানে ইউনিক সব ভাবনা কিলবিল করে!' এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পরিবার কিংবা সমাজ একবাক্যে বলবে- তুই দুই লাইন বেশি বুঝিস, তোর মাথায় সমস্যা আছে। হাহাহা... ম্যাক্সিমাম মানুষের চিন্তার সাথে ম্যাচ না করলেই একজন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়, তাই না?! খুবই হাস্যকর থিওরী!

ছোটবেলায় দেখতাম গ্রামাঞ্চলে ধান মাড়াই করার জন্য সারা উঠোনে সদ্য কাটা ফসল ছড়িয়ে রাখা হতো। উঠোনের মাঝখানে একটি খুঁটি পুঁতে সেই খুঁটির সাথে পাঁচ-ছয়টি গরুকে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রাখা হতো। কেন্দ্রে যে গরুটি থাকতো, বাকী গরুগুলো তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকতো। কেন্দ্রের গরুটি দাঁড়িয়ে পড়লে অন্য গরুগুলোও দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হতো। পুরুষানুক্রমিক প্রথা আমার কাছে একই সিস্টেম। এই প্রথার মাধ্যমে আমাকে শেষপ্রান্তে উপস্থিত গরুটির মতো পরপর সারিবাঁধা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের গরু অর্থাৎ আমার পূর্বপুরুষ কিভাবে হাঁটা-চলা করে, আমাকেও সামাজিক ভাবে সেভাবে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এই ধান মাড়াইয়ের গরু হতে রাজি না হলে বলা হয়- তুমি একটু বেশি বোঝো। তোমার মতো দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো, যার মানে তোমার সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়া উচিৎ! মাত্র তিন কি চারদিন আগে আমার এলাকার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, 'বাপ্পী, তুমি সবসময় একটু বেশিই বোঝো। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলেপুলে তোমার চিন্তা ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। তুমি দয়া করে নতুন প্রজন্মের কাউকে কোন ভুলভাল থিওরী দিও না!'
তার কথায় আমি হোহো করে হেসে উঠলাম। তিনি বিব্রত হয়ে বললেন, আমি কি কোন হাসির কথা বলেছি?
আমি বিনীতভাবে তাকে বললাম, 'জানেন, বহুকাল আগে প্রাচীণ গ্রীসে সক্রেটিস নামে একজন মানুষ ছিলেন। তিনিও একটু বেশিই বুঝতেন। তাঁর চিন্তার প্যাটার্ন বুঝতে না পেরে সেই সময়ের মানুষেরা প্রায়ই অভিযোগ করতেন যে, তিনি নতুন প্রজন্মের মানুষকে ভুলভাল শিক্ষা দিচ্ছেন!' আমার কথাটি শুনে ভদ্রলোক ভ্যাবদা মেরে বসে থাকলেন।
যাইহোক, যে নিজস্ব দর্শন শেয়ার করতে চেয়েছিলাম, সেই বিষয়টি নিয়েই বরং কথা বলা যাক। খাঁচায় বন্দী করে রাখা একটি পাখির জীবন লক্ষ্য করেছেন কখনও? বন্দী পাখিটির সর্বক্ষণ চেষ্টা থাকে কিভাবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। সে যখন লোহার খাঁচা থেকে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মনের মধ্যে কি চলে সেটা কি উপলব্ধি করতে পারেন? পাখিটিকে কিন্তু খাঁচার মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ খাবারের লোভ তাকে একবিন্দু আকৃষ্ট করতে পারে না। সে যদি কোনভাবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, তখন নীল আকাশে ডানা মেলে সে যে মুক্তির স্বাদ পায়, তার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় সুস্বাদু খাবার তুচ্ছ। হয়তো অক্লান্ত চিত্তে আকাশে উড়ে বেড়াতে গিয়ে সারাদিনে সে খাবার হিসেবে একটি পোকা পেতেও পারে কিংবা অভুক্ত থাকতেও পারে। তবুও তার মনে কোন খেদ থাকেনা। সে কি কখনো খাবারের লোভে আপনার খাঁচায় বন্দী হবে?!

ঠিক একইভাবে ব্যক্তিগত জীবনেও একজন মানুষ স্বাধীনভাবে একটি জীবন কাটাতে চাইতেই পারে। তার জীবনে হয়তো অর্থকষ্ট থাকবে, সামাজিক প্রতিকূলতা থাকবে, বিলাসী জীবনের অভাব থাকবে, কিন্তু সে যে কতখানি গভীর আত্মিক প্রশান্তির মাঝে বেঁচে থাকবে- সেটা কি কল্পনা করতে পারেন?
আমি অসংখ্য মানুষ দেখেছি, পরিশ্রম করতে করতে যারা রাতদিন এক করে ফেলে। দিনশেষে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে ঘরে ফিরেও বউ-বাচ্চা এবং পরিবারের সবাইকে সে খুশি করতে পারে না। এই শ্রমক্লান্ত মানুষটি যখন বারান্দায় বসে ফ্যালফ্যাল করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মধ্যে আমি খাঁচায় বন্দী সেই পাখিটিকে খুঁজে পাই, যে চারপাশে প্রচুর খাবার থাকা সত্ত্বেও খাঁচা ভেঙে উড়াল দিতে চায়। একটি বারের জন্য মুক্তির স্বাদ পেতে চায়! কিন্তু সংসার নামক এক জগদ্দল পাথর তার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে থাকে। সে না পারে এই বিতৃষ্ণা থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে। তাহলে এতো এতো কাঠখড় পুড়িয়ে কতটুকু লাভ হলো? এর সদুত্তর দেবার ক্ষমতা কিন্তু আপনার ট্রেডিশনাল সমাজব্যবস্থার নেই।

তাই শৈশবে একটি শিশুর জন্ম দিয়েই আপনি তার কানে কানে প্রতিনিয়ত পরম্পরা মেনে চলার যে গুরুমন্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। আপনার সন্তান কে তার নিজের মতো করে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করুণ। এমন তো নয় যে, আপনার মগজেই শুধুমাত্র ঘিলু আছে আর আপনার সন্তানটির মগজে রয়েছে আলুভর্তা! তাই বলছি কি- যে অজানা ভুল কে বুকে আগলে রেখে জীবন পার করে দিলেন, সামান্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে একটু যৌনতার জন্য ঢ্যাংঢ্যাং করে বিয়ে করে ফেলে ভেবে নিলেন, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! কিন্তু কয়দিন পরেই তো সেই জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়তি। কথায় আছে না, ডাইলের মজা তলে!

যাইহোক, আমি আমার ব্যক্তিগত দর্শনের প্রতি কাউকে প্রলুব্ধ করতে চাই না। যে যার মতো করে ভালো থাকুক। তবে আমার একটাই চাওয়া, তা হলো- ধান মাড়াইয়ের গরুর মতো ট্রেডিশনাল জীবন ছেড়ে সত্যিকারের মানুষ বের হয়ে আসুক। অবশ্য সে যে একজন বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ, এটা যদি কারো বোঝার ক্ষমতা থাকে, তবেই সে তার চিন্তার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
০৭.০৪.২০২২ খ্রিঃ

'সখী, ভালোবাসা কারে কয়'

 

আচ্ছা, বলুন তো ভালোবাসা ব্যাপারটি আসলে কি? প্রচুর পরিমাণ মানুষ প্রায়ই এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করেন। এর উত্তর কিন্তু মোটেই সহজ নয় বরং পরিষ্কার ভাবে চিন্তা করতে গেলে ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। 'ভালোবাসা' নামক বিষয়টি নিয়ে নানান সময়ে অসংখ্য গুণীজন প্রচুর পরিমাণ হিসাবনিকাশ করেছেন, অনেক থিওরীও বের করেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও স্পষ্ট করে কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। অনেকেই বলে থাকেন ভালোবাসা একটি মানসিক অনুভূতির নাম। এটা একান্তই নাকি মনের মধ্যে আবদ্ধ। আচ্ছা, মন বিষয়টি আসলে কি? এর একটাই উত্তরঃ মস্তিষ্ক-ই হচ্ছে মন। মানুষের যাবতীয় আবেগ-অনুভূতির একমাত্র নিয়ন্ত্রক হলো মস্তিষ্ক। মানুষের ব্রেইনের টেম্পোরাল লোবে ভালোবাসা বাস করে। টেম্পোরাল লোবে অসংখ্য নিউরোনের ভেতর দিয়ে ইলেকট্রিক ইম্পালসের বিশেষ ধরনের আদান-প্রদানই ভালোবাসা। কিন্তু কেউ কেউ আবার অন্য ভাবে বলে থাকেন যে- মানুষের আবেগ-অনুভূতি এবং ভয়ভীতির মুল নিয়ন্ত্রক হচ্ছে পিটুইটারী গ্লান্ড। একটি মেয়ে যখন একটি ছেলের প্রেমে পড়ে, তখন ছেলেটিকে দেখামাত্রই তার পিটুইটারী গ্লান্ড থেকে বিশেষ একধরণের এনজাইম নিসৃত হয় এবং সেই এনজাইমের কারনেই ছেলেটি তখন যা করে, তা দেখেই মেয়েটির হৃদয়ে দোলা লাগে।

এবারে আসুন, একেবারে মুল জায়গায় যাওয়া যাক। অসংখ্য বিজ্ঞানীরা একবাক্যে বলেছেন- প্রকৃতির প্রধান ইচ্ছা এই জীবজগৎ যেন টিকে থাকে। জীবজগতের কোন বিশেষ ধারা যেন বিলুপ্ত না হয়। আমাদের এই পার্থিব জীবজগতের একটি প্রধান ধারা হচ্ছে হোমোস্যাপিয়েন্স বা মানবজাতি। এই মানবজাতিকে টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্ত হলো তাদের সন্তান উৎপাদন করা এবং অতি অবশ্যই উৎকৃষ্ট সন্তান উৎপাদন করা। সন্তান সৃষ্টির জন্য একজন মানব এবং একজন মানবীকে পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসতে হয়। এই কাছাকাছি আসার প্রক্রিয়াটির জন্য তাদের একজনের অপরজনের প্রতি একটি তীব্র শারীরিক আকর্ষণ তৈরি হতে হয়। এই শারীরিক আকর্ষণের মুল রূপটির নাম-ই ভালোবাসা। সময় বিশেষে এই ভালোবাসার তীব্রতারও হেরফের হয়। প্রকৃতি যখন বুঝতে পারে দুজন বিশেষ মানব-মানবীর মিলনে উৎকৃষ্ট সন্তান তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে, তখন প্রাকৃতিক ভাবেই উক্ত মানব-মানবীর মধ্যকার ভালোবাসা তীব্রতর হয়। তারা একে অপরের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে এবং কোন বাঁধা-ই তাদের কাছে তখন বাঁধা বলে মনে হয় না। পুরুষেরা রূপবতী মেয়েদের প্রেমে পড়ে, কারণ প্রকৃতি চায় পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুন্দর হয়। যুগে যুগে নারীরা গুণী পুরুষদের প্রেমে পাগল হয়েছে, কারণ প্রকৃতি চেয়েছে পুরুষদের গুণ যেন পরবর্তী প্রজন্মে ডিএনএ-র মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। প্রকৃতি সবসময়ই চেয়েছে মানব সম্প্রদায়ের গুণগুলো যেন প্রবাহিত হতে হতে একটি সময় পূর্ণ মাত্রায় বিকাশ লাভ করে, যেন তৈরি হয় একটি অসাধারণ মানবগোষ্ঠী।
এটাই হচ্ছে মুল বিষয়। অথচ শৈশব থেকেই দেখে এসেছি এই ভালোবাসা নিয়ে মানুষের মধ্যে সে কি সীমাহীন আদিখ্যেতা! ভালোবাসার জন্য কতোই না পাগলামি করা হয়। গল্প-উপন্যাস কিংবা চলচ্চিত্রের কাহিনির মধ্যে অতি অবশ্যই একজন নায়ক থাকে, সে যখনই তার নায়িকা কে পেয়ে যায় কাহিনী ওখানেই সমাপ্ত করা হয়। নায়ক নায়িকাকে পেয়ে যাবার পর কি হয়, সেটা তো সবাই বোঝে! অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে থাকে। তারমানে নিজের প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করার স্বার্থে বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের সাথে জৈবিক সম্পর্ক স্থাপন করাকেই বাহুল্য করে ভালোবাসা বলা হয়। এই তুচ্ছতম বিষয়টির জন্য মানুষ সীমাহীন উদ্যমে কবিতা-গান লেখে, রাত জেগে কল্পনার আকাশে ডানা মেলে, অনেকে নিজেকে পাল্টে ফেলে, পরিবার কিংবা সমাজ ত্যাগ করে, কখনও নিজের জীবনের ঝুঁকি নেয়। আর ভালোবাসা না পেলে কেঁদেকেটে একাকার করে, হাত-পা কাটে, নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে, কেউ কেউ তো আত্মহত্যা পর্যন্ত করে। আহারে... ভালোবাসার কি ঠ্যালা! কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমি এখনও পর্যন্ত এই অসাধারণ বিষয়টি ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠতে পারলাম না। তাই মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে, কোন একজন নারীর কাছে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করি-
'সখী, ভালোবাসা কারে কয়?'

কৃষ্ণেন্দু দাস/

'পৌষ পার্বণ'


প্রাচীণ লোকসংস্কৃতি এবং আবহমান বাংলার পুরনো দিনের বেশকিছু ঐতিহ্য এখন আধুনিকায়নের তীব্র স্রোতের তোড়ে ভেসে ভেসে হারিয়ে গেছে অজানায়, এমনই একটি প্রাচীণ সাংস্কৃতিক উৎসবের নাম পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ পার্বণ। এই প্রাচীণ উৎসবটির প্রতিটি পর্যায়ে জড়িয়ে আছে আগেকার দিনের গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের জীবন এবং জীবিকার প্রতিচ্ছবি। সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্ম হয়েছিল আশির দশকের প্রথম ভাগে এবং আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছিল প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। এরজন্য আমি প্রাচীণ সেইসব দিনের প্রথাগত সামাজিক জীবন-জীবিকা এবং ঐতিহ্যবাহী সেইসব লোকসংস্কৃতি কে সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পৌষের সেইসব দিনে বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদের মানুষের বাড়িতে নতুন আমন ধানের চালে গোলা ভর্তি হয়ে যেতো। প্রথমে ধানের জমি থেকে নতুন ফসল কেটে এনে উঠোনে স্তুপ করে রাখা হতো, এরপর উঠোনের মাঝখানে একটি খুঁটি পুঁতে একটা দড়ির সাহায্যে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি গরুকে বেঁধে সেই ধান মাড়াই করা হতো। ধান কাটা থেকে শুরু করে চাল বের করা পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়া ছিল যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনি এই প্রতিটি পর্যায় ছিল দারুণ উৎসবমুখর।

নতুন খাদ্যশস্য ঘরে তোলার পর এই সময়ে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলে যেতো। এরপর পৌষের শেষে জাঁকিয়ে শীত নামা শুরু হলে প্রতিটি বাড়ির বউঝি এবং অন্যান্য নারীরা চালের পাত্র নিয়ে ঢেঁকিতে পিষে চাল গুড়ো করতে যেতেন। আমি শৈশবে বেশ কয়েকবার মায়ের সঙ্গে চাল কুটতে গিয়েছি। গ্রামের নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে ঢেঁকিঘরে আরও অনেক মহিলারা কোলের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হতেন। সেটাও ছিল দারুণ উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। এরপর সন্ধ্যা বেলায় হাত-মুখে চালের গুঁড়ো মেখে সাদা ভূত হয়ে ঘরে ফিরতাম। শুরু হতো পিঠা তৈরির আয়োজন। চুলার আগুনে মাটির ছাঁচ রেখে চালের গুঁড়ো গুলে সেটা ছাঁচে ফেলে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখা হতো। আমি উনুনের আঁচে বসে মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম। মা যথারীতি প্রথম বার পিঠা তুলে আমাকেই দিতেন। তীব্র শীতে সেই ধোঁয়া ছড়ানো গরম পিঠা হাতে নিয়ে যে সুখানুভূতি পেতাম, তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। সেই সময়কার আমার সমবয়সী সকল শিশুর হাতেই থাকতো থালা ভর্তি পিঠা আর নতুন খেজুরের গুড়।

এরপর সময়ের আবর্তে চুরি যাওয়া রোদের মতোই সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে বহুদূরে। গ্রামীণ জনপদের সমাজব্যবস্থায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন আমরা যন্ত্র নির্ভর সময়ে এসে পৌঁছে গিয়েছি। চারপাশে বিনোদনের অসংখ্য উপকরণ। এখন আর কেউ লাঙ্গলে হালচাষ করতে করতে টানা সুরে গান গায় না, এখন উঠোনে গোবর লেপে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হয় না। এখন কেউ আর চাল নিয়ে ঢেঁকিঘরে যায় না। এখন ফসল উৎপাদনের গুরুদায়িত্ব মেশিনের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে। মেশিন হালচাষ করে, আর জমির মালিকেরা সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে। সবকিছুই খুব বেশি শর্টকাট। এখন আর পিঠা বানানোর জন্য উৎসবের প্রয়োজন হয় না, এখনকার শিশুরা উনুনের আঁচে মায়ের পাশে বসে পিঠার জন্য বায়না করে না। শিশুদের হাতে তাদের বাবা-মা স্মার্টফোন তুলে দিয়েছেন। ওদের পিঠা খাওয়াতে গেলেও টিভিতে 'গোপাল ভাঁড়' কিংবা 'মোটু-পাতলু' দেখানো লাগে। নতুন ধানের চালের ঘ্রাণ ওদের কাছে অজানা, ওদের কাছে অজানা খেজুরের গুড়ের সেই আঠালো মিষ্টি স্বাদ। আধুনিকায়ন আর স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্যে এখনকার সময়ের শিশুরা যে স্মার্টনেস বগলদাবা করে বেড়ে উঠছে, তাতে আগামী বিশ কিংবা পঁচিশ বছর পরের প্রজন্মের কাছে 'পৌষ পার্বণ' বিষয়টি হবে নেহাৎ একটি পঠিত বিষয়। এই খটখটে স্মার্টনেসে নেই মাটির ছোঁয়া, নেই নিজের আবহমান সংস্কৃতির প্রভাব। এখনকার দিনের একটাই টার্ম, ঘাড় সোজা রেখে আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও! তবুও শৈশবের যে সোনালী অধ্যায় পার করে এসেছিলাম, যে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের স্মৃতিতে এখনও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই, এখনও কুয়াশায় ঢাকা পৌষ শেষের সন্ধ্যায় নতুন চালের একটা গরম পিঠার স্পর্শ আমাকে যতটা গভীর ভাবে আবেগে আপ্লুত করে- সেই দিন, সেই সময়গুলো, সেইসব স্মৃতিই আমাকে আবারও প্রতিবারের পৌষ সংক্রান্তিতে সেই পুরনো অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, যে দিনের কাছে কোনভাবেই আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সবার প্রতি পৌষ পার্বণের অনেক অনেক শুভকামনা!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১৪.০১.২০২৩ খ্রিঃ

'সমকালীন জীবন ও আমাদের ভবিষ্যৎ'

বেশ কিছুদিন আগে আমার পার্শ্ববর্তী এলাকার শ্রদ্ধেয় দাদা জি.সি. পাইক বলেছিলেন— ২০৪০ সালের পর আশেপাশে কোন থুরথুরে বুড়ো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। দাদার এই দূরদর্শী চিন্তা আমার ভালো লেগেছিলো। বিষয় টা নিয়ে আমি নিজেও অনেক চিন্তা ভাবনা করেছি এবং বইপত্র পড়ে দেখেছি। মানুষের জীবনকাল আস্তে আস্তে সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। আগেকার দিনে একজন মানুষের (হোক সে পুরুষ কিংবা নারী) মধ্যে যতটা উদ্যম, যতটা প্রাণশক্তি ছিলো, এখনকার সময়ে এসে সেটা আশ্চর্যজনক ভাবে লুপ্ত হয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়াটি কতটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে হয়েছে এবং ঠিক কিভাবে হয়েছে, সেটা ব্যাখ্যা করতে যাবার আগে আসুন, কিছু তথ্যের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।

আমাদের এই গ্রহে মানুষ কর্তৃক আগুনের আবিষ্কার হয়েছিলো আনুমানিক প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে। আদিম মানুষের আগুন আবিষ্কার করতে যতটা দীর্ঘ সময় লেগেছিলো, তার চেয়ে চাকা আবিষ্কার করতে অস্বাভাবিক রকমের কম সময় লেগেছে। প্রথম চাকা আবিষ্কার হয়েছিলো আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে। চাকা আবিষ্কারের সাথে সাথে সভ্যতাও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছুটতে শুরু করেছিলো। চাকা আবিষ্কারের পর ষ্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার করতে মানুষের আরও কম সময় লেগেছে। ষ্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়েছে মাত্র আড়াইশো বছর আগে। ষ্টীম ইঞ্জিন থেকে সুপার কম্পিউটার আবিষ্কার করতে লেগেছে আরও অল্প সময়। সুপার কম্পিউটার আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র পঞ্চাশ বছর আগে। একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে দেখা যায় আমাদের এই মানব সভ্যতা কতটা দ্রুতগতিতে ছুটে চলছে। আগুন থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার পর্যন্ত আমাদের এই দীর্ঘ জার্নির স্পীড একটু একটু করে যেভাবে বেড়ে গিয়ে তীব্র গতিতে গিয়ে ঠেকেছে, সেভাবে আমাদের বায়োলজিক্যাল পরিবর্তন-ও হয়েছে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে। সহজে বলি, যান্ত্রিক সভ্যতা যতটা তাড়াতাড়ি বিস্তার লাভ করেছে, আমাদের এই মনুষ্য শরীরও তার সাথে তাল মিলিয়ে ততটাই তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হয়েছে। এটা নিয়ে আরও একটু খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করি। আলোচনার সুবিধার্থে আমি উদাহরণ হিসেবে এখানে নিজেকে এবং নিজের পারিপার্শ্বিকতা কে তুলে ধরছিঃ
আমার পিতামহ ছিলেন একজন মিষ্টি প্রস্ততকারক এবং বিক্রেতা। আমাদের বাড়ি থেকে পনের কিলোমিটার দূরের একটি বাজারে তার মিষ্টির দোকান ছিলো। আমার পিতামহ প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে তার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি থেকে পনের কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে তার দোকানে গিয়ে এরপর মিষ্টি তৈরি করে, সারাদিন ধরে সেগুলো বিক্রি করে সন্ধ্যার পর পরিবারের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আবারও পনের কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে বাড়ি এসে পৌঁছাতেন। এইযে তার নিত্যকার কায়িক পরিশ্রম, এটা তার শরীর এবং মনকে চমৎকার এক দৃঢ়তায় বেঁধে রেখেছিলো। অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তার খাবারের প্রতি অরুচি ছিলো না, ঘুমের কোন ঘাটতি ছিলো না। তার সময়ে পুকুর, খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণ মাছ ছিলো, গাছে ছিলো টাটকা ফল, ক্ষেতে ছিলো সবজি। তার সময়কার মাছ কিংবা তরকারি, ফলমূল, সবজি ইত্যাদি প্রতিটি জিনিস ছিলো ক্ষতিকর রাসায়নিক মুক্ত। তিনি ভোরবেলা যখন পনের কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতেন, তার চলার পথে ছিলো নির্মল বাতাস। তার আশেপাশে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের দূষণ ছিলো না। এবারে তার স্ত্রী, অর্থাৎ আমার পিতামহী সম্পর্কে বলি। নিতান্তই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া এই মহিলার প্রাত্যহিক জীবনও ছিলো তার স্বামীর মতোই কর্মমুখর। একদম ভোরবেলা যখন তার স্বামী দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করতেন, তিনি তখন ঝাড়ু নিয়ে বাড়ির উঠোনে জমে থাকা ময়লা এবং শুকনো পাতা পরিষ্কার করা শুরু করতেন, এরপর হাঁস-মুরগি কে খেতে দেওয়া, বাগানের গাছে জল দেওয়া, আঙ্গিনায় সবজির পরিচর্যা শেষে স্নান সেরে এসে রান্না শুরু করতেন। তার একগাদা ছেলেপুলে ছিলো, তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখার বিষয় তো ছিলোই। আমি কিশোর বয়সেও আমার ঠাকুরমা কে যথেষ্ট কাজ করতে দেখেছি। এই দৈনন্দিন কাজগুলো তিনি করতেন স্বেচ্ছায় এবং মনের আনন্দে।
আমি যে সময়ের কথা লিখছি, তখনকার দিনে এদেশের মানুষ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির সাথে পুরোপুরি জড়িয়ে ছিলো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মানুষগুলো পরিশ্রম করেছে। জমির চাষ করার জন্য গরু এবং লাঙ্গল ব্যবহার করা হতো, জমিতে সেঁচের জন্যেও কায়িক পরিশ্রম করতে হয়েছে, এরপর ফসল কাটা, ফসল মাড়াই করা, মাড়াইকৃত শষ্য রোদে শুকানো, ঢেঁকিতে ছেঁটে সেই ধান থেকে চাল বের করা, চাল থেকে তুষ আলাদা করা, চাল সেদ্ধ করা, খড় এবং বিচালি গবাদিপশুর জন্য সংরক্ষণ করা থেকে এই পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট শ্রমসাধ্য ব্যাপার ছিলো। তখনকার সময়ে প্রতিটি এলাকায় একটি নির্দিষ্ট স্থানে সপ্তাহে একদিন হাট বসতো। দূর দূর থেকে মানুষেরা পায়ে হেঁটে সেই হাটে এসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেন, কেউ কেউ নিজস্ব উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রি করতে আসতেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এইসব হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও সেই সময়ের মানুষের মনে অনেক আনন্দ ছিলো। তাদের মধ্যে আশেপাশের মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা ছিলো। তাদের সময়ে বিনোদনের এতো এতো ব্যবস্থা ছিলো না, কিন্তু তারা প্রত্যেকে ছিলেন মানসিক ভাবে সুখী। তাদের এই আত্মতুষ্টি তাদেরকে দীর্ঘায়ু করেছিলো। সেই সময়ের মানুষেরা সুস্থ সবল ভাবে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতেন। তাদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ছিলো যথেষ্ট বেশি। আমার ঠাকুরদার আমলে অধিকাংশ মানুষ ৮০-৯০ বছর অবলীলায় বেঁচে থাকতেন।
আমার বাবা যখন স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, তখনও পর্যন্ত আমাদের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়নি। তিনি দশ থেকে বারো কিলোমিটার পায়ে হেঁটে রোজ কলেজে যেতেন এবং ততটা পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। আমার বাবার ছাত্রজীবনে বাগেরহাট থেকে খুলনা পর্যন্ত একটা মিটারগেজ লাইনের ট্রেন চলাচল করতো। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, আমাদের এলাকা থেকে বাগেরহাট শহরে তখনকার দিনে সবাই পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতেন। আমার বাবা যখন শিক্ষকতা শুরু করেন, তখন তিনি বাড়ি থেকে রোজ বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতেন। তার সময়েও খাবারে সেভাবে ভেজাল মেশানোর সংস্কৃতি শুরু হয়নি। কায়িক পরিশ্রম বলতে রোজ দুইবার সাইক্লিং করে এবং খাটি খাবারের গুণে তিনিও মোটামুটি সুস্থ-সবল ভাবে জীবন পার করেছেন। তার সমসাময়িক কালের মানুষের আয়ু ছিল প্রায় ৬৫-৭৫ বছর। এরপর থেকেই মুলত আমাদের পারিপার্শ্বিক বাস্তুতন্ত্র এবং জীবনযাত্রায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে শুরু করলো।
আমার জন্ম হয়েছিলো আশির দশকের শুরুতে। আমার শৈশবে আমিও প্রাকৃতিক ভাবে খাল-বিলের দেশি কইমাছ, শোল, শিং মাগুর, বোয়াল দেখেছি। আমার ছোটবেলায় কৃষকের গরু নিয়ে হালচাষের কালচার ছিলো, ঢেঁকিছাটা চালের গরম ভাতের সাথে খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে খেয়ে সকালে স্কুলে যেতাম। আমার শৈশবে আমি আমার সমবয়সী ছেলেদের সাথে খোলা মাঠে নানান ধরনের খেলাধুলায় মেতে থাকতাম, পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার, আর সারাদিনের দৌড়ঝাঁপে শরীর টা সুস্থ এবং মন প্রফুল্ল ছিলো। আমার শৈশবের বিনোদন ছিল মাঠের খেলাধুলা, গ্রামীণ উৎসব, মেলার দোকানপাটে ঘোরাঘুরি, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। ছোটবেলায় রেডিওতে গান শোনা ছিলো বিশুদ্ধ বিনোদনের আর একটি অংশ। তারপর মুহূর্তের মধ্যে আশ্চর্যজনক ভাবে সবকিছু ক্রমান্বয়ে বদলে যেতে শুরু করলো। রেডিও হারিয়ে গেলো, লাঙ্গল, ঢেঁকি অদৃশ্য হলো, আশেপাশে কৃষিজমিতে কলকারখানা বিস্তার লাভ করলো, সেঁচের জন্য এলো চীনের তৈরি শ্যালো ইঞ্জিন, জমিতে এলো পাওয়ার ট্রিলার, ধান মাড়াইয়ের জন্য মেশিন, চাল ছাড়ানোর জন্য রাইস মিল। যানবাহনের পরিমাণ বাড়তে লাগলো হুহু করে। কোন মানুষ আর দুই পা হেঁটে কোথাও যেতে চাইলো না। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার শুরু হলো, ধ্বংস হলো লক্ষ লক্ষ উপকারী কীট-পতঙ্গের জীবন। মানুষ অতিরিক্ত লাভের আশায় খাবারে ভেজাল দেওয়া শুরু করলো। বন উজাড় করে ইটের ভাটা শুরু হলো। নদনদী মরে গেলো, প্রাকৃতিক ভাবে মাছের উৎপাদন কমে গেলো। মানুষ হাইব্রিড ভাবে মাছের চাষ, মুরগির খামারে মনোনিবেশ করলো। চতুর্দিকেই তখন নানান ধরনের পরিবর্তনের ছোঁয়া। একটু আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষেরা তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য।

প্রকৃতি তখন ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমসিম খাচ্ছে। স্বভাবতই নতুন নতুন রোগব্যাধির উৎপত্তি হলো, এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার বাড়তে শুরু করলো। আগেকার দিনের টিকে থাকা বুড়ো মানুষেরা হারিয়ে যেতে শুরু করলো। মানুষের মন থেকে নির্মল আনন্দ লুপ্ত হতে লাগলো। অনেক বিনোদনের মধ্যে থেকেও মানুষ সব সময় চাপা একটা উদ্বেগের মধ্যে বেঁচে থাকার পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হলো। এখনকার সময়ের মানুষের বেঁচে থাকার কোন গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। সবাই অল্পতেই খুব বেশি হতাশ, সবাই খুব বেশি বিষন্ন। মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং মানুষের আরামপ্রিয় জীবনযাপন পদ্ধতি এখনকার মানুষ কে ঠেলতে ঠেলতে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার বয়স চল্লিশ বছর, অথচ আমার সমবয়সী এবং আমার চেয়ে বয়সে ছোট অসংখ্য মানুষ কে আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে দেখেছি। যে বিষাক্ত পরিবেশে ক্লেদাক্ত জীবন যাপন করে যাচ্ছি, তাতে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবো কিনা, এব্যাপারে আমি সন্দিহান। মানুষ যেভাবে লাগামহীন ভাবে ঊর্ধ্বমুখে প্রতিনিয়ত অজানার দিকে ছুটে চলেছে, তাতে এদের এই জার্নি টা আগামী দুইশো বছর পর্যন্ত টেকে কি-না সন্দেহ আছে। যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আমার প্রতিবেশী দাদা জি.সি. পাইক বলেছেন ২০৪০ সালের পর আশেপাশে কোন বৃদ্ধ মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিভাবে খুঁজে পাবেন, মানুষ বুড়ো হওয়ার মতো সময় পেলে তো! ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকাই তো দুষ্কর। এখন বেঁচে থাকতে গেলে একটাই সমাধান, অতিরিক্ত লোভ পরিত্যাগ করতে হবে। নিজের খাবার টা নিজেকেই বিশুদ্ধ ভাবে উৎপাদন করতে হবে, প্রচুর পরিমাণ শারীরিক শ্রমের কাজ করতে হবে, প্রচুর পরিমাণ বৃক্ষরোপণ করতে হবে, টেকনোলজিক্যাল বিনোদনের ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে মানুষের সাথে মানুষের জীবন্ত যোগাযোগ রাখতে হবে। অন্যের প্রতি সহনশীলতা, সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণী, আমরা মানুষ। এতো সহজে আমরা নিজেদের ধ্বংস করে ফেলতে পারি না। আমাদের এই মানবসভ্যতা এই গ্রহে আরও বহু সহস্রাব্দ ধরে টিকে থাকুক। আমাদের পৃথিবীর এই মানবসভ্যতা ছড়িয়ে পড়ুক পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি কোনায়। জয় হোক সমগ্র মানবজাতির।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১২.০৭.২০২৩ খ্রিঃ

'আঁধারের কথা'


বেশ কয়েক'টা দিন থেকেই মনটা বড় বেশি রকমের অস্থির হয়ে আছে। কোনভাবেই স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছি না। দুঃখজনক বিষয় হলো, আমি আবার সঠিক ভাবে জানিও না, ঠিক কি জন্যে এমনটা হচ্ছে। তবে অতি আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে, প্রত্যেক বছরের আগষ্ট মাস এলেই আমার জন্য সমস্ত দূর্ভাগ্য আর দূর্ঘটনার একটি ফ্রী প্যাকেজ চালু হয়ে যায়। এটা ইনস্ট্যান্ট, অর্থাৎ আমি ভালো করেই জানি যে, এই মাসে এমন কিছু একটা ঘটবে; যার জন্যে আমি মোটেও প্রস্তুত নই! ব্যক্তিগত জীবনে আমি এ্যাস্ট্রোলজি (জ্যোতিষ বিদ্যা) কিংবা অতীত জীবনের ঘটে যাওয়া বিশেষ কোন ঘটনা কিংবা ভবিষ্যতবানী- এই সমস্ত বিষয়'কে এক বিন্দুও বিশ্বাস করি না।

এসব ক্ষেত্রে কাকতালীয় ভাবে কিছু কিছু ঘটনার প্রমান যদিও পাওয়া যায়, তবে আর যাইহোক, একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসাবে অন্তত এইসব ভণ্ডামি তো আর মেনে নিতে পারিনা; অথচ এই মুহূর্তে আমাকে ভাবনার প্রসার ঘটাতে হচ্ছে। কারণ আর কিছুই না, এই আগষ্ট মাস! অভ্যাস বশতঃ দীর্ঘদিন থেকেই আমি দিনলিপি লিখে আসছি। এখন আমার কাছে আমার পেছনে ফেলে রেখে আসা পুরো ষোল বছরের হিসাব লিপিবদ্ধ আছে। এবং বলাই বাহুল্য, এই ১৬ টি বছরের প্রত্যেকটি আগষ্ট মাসেই আমার জন্য দুর্বিসহ যপন্ত্রনাময় সব ঘটনার প্রমান রেখে গেছে। তবে সবথেকে মজার বিষয়টা হলোঃ আমার জন্ম হয়েছিলো ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের এই আগষ্ট মাসের ২৯ তারিখের একটি সোমবারে, বাংলা ক্যালেন্ডারে তখন ১৩৯০ বঙ্গাব্দের ১২ ই ভাদ্র। আমি জন্মেছিলাম কৃষ্ণপক্ষের ঘোর নিশুতি রাতে। বড় হবার পর অনেকের কাছে শুনেছি, ভাদ্র মাসের অমাবস্যা তিথিতে নাকি অনেক অশুভ আর অলৌকিক ঘটনা ঘটে! এরপর থেকেই আমার তাগিদ হয়ে দাঁড়ালো প্রতি ভাদ্র মাসের অমাবস্যা রাতে জিরো আওয়ার (রাত ১২ টা) পার হলেই চুপি চুপি কোন আলো ছাড়াই নির্জন কোন স্থানে গিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করা। প্রথম প্রথম যদিও যথেষ্ট ভয় লাগতো আমার, তারপর কখন যে ভয় নামক এই অনুভূতিটা ভালোলাগায় রূপ নিলো, তা বুঝতেই পারিনি। শুধু এইটুকু অনুভব করতে পারতাম, কৃষ্ণপক্ষের নিকষ কালো আঁধারী রাত এলেই আমার ব্যক্তিসত্তার মধ্যে এক প্রকারের অদম্য আকর্ষণ সৃষ্টি হতো। কিন্তু কেন? সেটাও জানা হয়নি আমার আজও। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আর আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, আমার মুল নাম 'কৃষ্ণেন্দু'। এটা মুলত একটি সংস্কৃত শব্দ। শাব্দিক ভাবে 'কৃষ্ণ' নামটির সমার্থক শব্দ হলো কালো, আর 'ইন্দু' শব্দের অর্থ চাঁদ। কিন্তু চাঁদ তো কালো নয়। চাঁদ সব সময় সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হয়ে উজ্জ্বল বর্ন ধারণ করে। তাহলে 'কৃষ্ণেন্দু' নামটির মানে কি হবে? পরে গভীর ভাবে চিন্তা করে দেখেছি যে, চাঁদ নির্দিষ্ট একটি সময় কালো বর্ণ ধারণ করে; যখন সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ সমান্তরালে অবস্থান নেয়, তখনই হয় গ্রহন। তার মানে কি এটাই পরিষ্কার নয় যে, 'কৃষ্ণেন্দু' নামের সত্যিকার অর্থ হল গ্রহন লাগা চাঁদ কিংবা অমাবস্যা তিথির চাঁদ! খুব সম্ভবতঃ এই কারনেই আঁধার আমার এতটাই প্রিয়। তাই যখনই সুযোগ পাই গভীর রাতে চুপিসারে একা একা বেরিয়ে পড়ি ঘর থেকে এক অপার্থিব সৌন্দর্য্যকে খুঁজতে। কখনও কখনও পেয়ে যাই, আর কখনও'বা নিজেকেই হারিয়ে ফেলি এক অনিশ্চিত অন্ধকারের মাঝে..!
© কৃষ্ণেন্দু দাস/

All 

'রিজওয়ান ইজ বেটার দ্যান ইউ, ব্লাডি ফুলস্!'

 

একটা নিজস্ব দুঃখ এবং আক্ষেপ সম্ভবত আমার আজীবন ধরে থেকে যাবে। সেটা হলো একজন বাঙালী কিংবা বাংলাদেশী হিসেবে এই ভূখণ্ডে আমার জন্ম হয়েছে। আমার চল্লিশ বছর বয়সের এই পর্যন্ত সমস্ত পঠিত বিদ্যা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, এই গ্রহের আর কোন রাষ্ট্র কিংবা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এতটা বেশি নিকৃষ্ট হিসেবে জন্ম নেয়নি। 'সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, আমার সোনার বাংলাদেশ', আহ্! কী অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ; অথচ এই উর্বর মাটিতেই জন্ম নেয় দুনিয়ার নিকৃষ্টতর এক একটি নরকের কীট! বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো তারা এতটাই বেশি অশিক্ষিত মূর্খ যে, নিজের ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও তাদের নেই। এদেশে প্রতিটি বছর এতো এতো মানুষ যে হাতে একটা সনদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছে, তাদের ঐ গ্রাজুয়েশন ক্যাপ গাউনের ভেতরে যে মানুষ গুলো অবস্থান করছে, তারা আদৌ কতটুকু শিক্ষিত হতে পেরেছে? আমি শৈশব থেকেই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে পড়তে গিয়ে একটা স্থুল ধারণা পেয়েছিলাম যে, একটি রাষ্ট্র কিংবা জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পাকিস্তান কে আমাদের ঘৃণা করতে হবে। আস্তে আস্তে যখন বড় হলাম, যখন আরও বিশদভাবে ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারলাম, তখন বিস্মিত হয়ে অনুভব করেছি- পাকিস্তানী মানুষেরা ততটা ঘৃণিত নয়, যতটা ঘৃণ্য নোংরা এই দেশের বাঙালীরা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিক যতটা নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে, তার চেয়ে দশগুণ বেশি নৃশংসতা চালিয়েছে এদেশে জন্ম নেওয়া ঘাতক দালাল রাজাকারের গোষ্ঠী। কই, তাদের প্রতি যতটা ঘৃণা প্রদর্শন করা উচিৎ, সেটা তো কোনদিনই এদেশে বসে দেখলাম না। এদেশের মানুষ হিসেবে সেই রাজাকারের সর্দারদের মহান জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখেছি। আমার এই লেখাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আমি একটি স্বচ্ছ ইতিহাস তুলে ধরছি।

আমরা সবাই জানি, ফেব্রুয়ারী মাস আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবার মাস। এই মাস আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করতে গিয়ে চরম আত্মত্যাগ করার মাস। আচ্ছা, আপনারা সবাই জানেন যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালী ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সকাল নয়টায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে শুরু করে। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করে। ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড় দেয় এবং বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করে। উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে এবং ছাত্রদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ছাত্রদের চলে যাবার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানায়। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিঙের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টাকালে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ অনেক ছাত্র নিহত হয়। হ্যাঁ, এটুকু জানেন। কিন্তু আপনারা বলুন তো, নুরুল আমিন কে ছিলেন? তার পরিচয় কি ঠিকঠাক ভাবে জানেন? আচ্ছা, আমি জানাচ্ছি।
নুরুল আমিন ছিলেন একজন বাঙালী রাজনীতিবিদ। তিনি ১৮৯৩ সালে অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার শাহবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলায় তিনি বড় হয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনের সময়ে এই নুরুল আমিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সরাসরি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার নেপথ্যের কলকাঠি তিনিই নেড়েছেন। এবার আসুন নুরুল আমিনের সুপিরিয়র প্রসঙ্গে। আচ্ছা, বলুন তো- খাজা নাজিমুদ্দিন কে ছিলেন? তার পরিচয় কি ঠিকঠাক ভাবে জানেন? আচ্ছা, আমি জানাচ্ছি।
খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন একজন বাঙালী রাজনীতিবিদ। তিনি ঢাকার নবাব পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে নাজিমুদ্দিন দুইবার বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থাৎ ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সময়ে এই ব্যক্তি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আচ্ছা, বিষয় টা কেমন জানি হয়ে গেল না? এই ভূখণ্ডের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে 'বাংলা' কে প্রতিষ্ঠিত করার সক্রিয় বিরোধী ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। এই দুইজন লোক ছিলেন জন্মসূত্রে বাঙালী এবং এই দুজনের জন্ম হয়েছিল এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলায়। ছিঃ ছিঃ!! অথচ আপনারাও জন্মসূত্রে বাঙালী হিসেবে কিছু ভুলভাল ইতিহাস চর্চা করে বড় হয়েছেন এবং ভেবে বসে আছেন যে, এদেশের ভাষা আন্দোলনের বিরোধী কোন একজন পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী পাঞ্জাবী লোক, তাই না? ভুল, সবই ভুল!
এই লেখাটি আমি কেন এখন লিখছি জানেন? অত্যন্ত ক্ষোভ এবং ব্যক্তিগত দুঃখবোধের জায়গা থেকে। বাংলাদেশে এখন বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ) ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে। দুদিন আগে ভাষার মাসের চিহ্ন হিসেবে এই টুর্নামেন্টের সব ক্রিকেটারের বাহুতে বাংলা বর্ণমালা সংবলিত একটি 'আর্মব্যাণ্ড' পরিধান করতে বলা হয়। সবাই সেই বাহুবন্ধনী পরে খেলার পর পাকিস্তানের ক্রিকেটার মোহাম্মদ রিজওয়ান কে স্পেশালি ডেকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রিজওয়ান হাতে যেটা পরে আছেন, ওটার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কিনা?! আচ্ছা, ভাবুন তো কতবড় নির্লজ্জ একটা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হলে নতুন এই প্রজন্মের একজন পাকিস্তানী ক্রিকেটার কে এই ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করা হয়! রিজওয়ান সেদিন এর উত্তর দিতে পারেননি, তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে জানেন না। আমার কথা হলো, মোহাম্মদ রিজওয়ান মাত্র সেদিনের একটা পাকিস্তানী পুচকে ছেলে, ও কিভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিষয় জানবে? আমি জানতে চাই- রিজওয়ান কে যারা যারা এই প্রশ্ন করে বিব্রত করেছে, তারা নিজেরা একুশে ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস নিয়ে কতটুকু জানেন?
শোন কুকুরের দল, তোর দেশের মহান ভাষা আন্দোলনের সেই ঘটনার দায়ভার কিন্তু মোহাম্মদ রিজওয়ানের বাপ-দাদার ওপরে বর্তায় না। এর দায়ভার তোর নিজস্ব বাঙালী বাপ-দাদার, যারা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল, তোর বাপ-দাদারাই আবার ১৯৭১ সালে স্বদেশী মুক্তিকামী মানুষের ওপর নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। যথেষ্ট সময় হয়েছে, এখন একটু শিক্ষিত হ! এখন একটু সভ্য হ! নাকি তোদের সেই ভূতপূর্ব বাঙালী পৈশাচিকতা এখনো সমানভাবে নতুন প্রজন্মের মানুষের সামনে হাজির করবি? ভালো হয়ে যা মূর্খের দল!
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১৩.০২.২০২৩ খ্রিঃ

'ফুটবল ভাবনা'

 আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করলে সেই সময়ের বিনোদন ব্যবস্থা কয়েকটি সীমিত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখনকার দিনে যেহেতু মানুষের ঘরে ঘরে টেলিভিশন আসেনি এবং স্যাটেলাইট চ্যানেল কি জিনিস সেটাও যেহেতু বেশিরভাগ মানুষের ধারণার বাইরে ছিল, তাই বিনোদনের উপকরণ হিসেবে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা নিয়েই মেতে ছিল এদেশের সেই সময়কার মানুষ। উল্লেখযোগ্য বিনোদনের চর্চা বলতে পালাগান, ঘুড়ি ওড়ানো, গ্রামীণ মেলা, যাত্রাপালা, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়ার দৌড়, নৌকা বাইচ ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল বহুলভাবে চর্চিত। খেলাধুলা বলতে হাডুডু এবং কখনও কখনও ফুটবল। তখনকার সময়ের ফুটবল ম্যাচে খুব কম সংখ্যক খেলোয়াড়দের জার্সি কিংবা বুট পরে খেলতে দেখা যেতো। সেই সময়গুলোতে বাংলাদেশের ফুটবল ক্লাব বলতে আবাহনী এবং মোহামেডান আর ভারতীয় তথা পশ্চিমবঙ্গের ক্লাব হিসেবে ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের নাম খুব করে শোনা যেতো। আমি শৈশবে এইসব ক্লাবের ফুটবল খেলা চলাকালীন সময়ে প্রবীণদের রেডিও কানের কাছে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ধারাভাষ্য শুনতে দেখেছি। ল্যাটিন আমেরিকান কিংবা ইউরোপিয়ান ফুটবলের চর্চা তখনও আমাদের দেশে সেভাবে শুরু হয়নি।

তাহলে এদেশে কিভাবে ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের চর্চা ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো? হ্যাঁ, আমি সেই সময়কার একজন মানুষ বলেই গোটা বিষয়টি খুব সুক্ষ্মভাবে আমার চোখের সামনে থেকে ঘটতে দেখেছি। সেই সময়কার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত বাংলা টেক্সটবুকে 'ফুটবলের রাজা' নামক একটি গল্প ছিল। আমার চেয়ে বয়ষ্ক কিংবা আমার সমবয়সী প্রজন্মের সমস্ত মানুষই পাঠ্য বইয়ের সেই গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সেই গল্পে 'পেলে' নামক একজন ব্রাজিলিয়ান মানুষ কিভাবে হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে থেকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে নিজের যোগ্যতাবলে ফুটবলের রাজা হয়েছিলেন তা বর্ণনা করা হয়েছিল। স্বভাবতই উক্ত ফুটবলারের খেলা না দেখেও শুধুমাত্র তাঁর গল্প পড়ে আমাদের সমসাময়িক কালের মানুষের মনের গভীরে পেলে'র জন্য একধরণের গভীর ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল। এরপর ১৯৮৬ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ আমাদের দেশের বেশ কিছু মানুষ দেখেছিলেন কিংবা সংবাদপত্রে এই খেলার ওপরে লেখা আর্টিকেল পড়েছিলেন, যেখানে ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামক একজন আর্জেন্টাইন ফুটবলারের একক কৃতিত্বে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের বিষয়টি ছিল।

আমরা সবাই নিজেদের সম্পর্কে একটি বিষয় খুবই স্পষ্টভাবে জানি যে, বাঙালি মুলত একটি হুজুগে মেতে ওঠা জাতি। আমাদের দেশের মানুষের ব্যপক অর্থে ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল মুলত পেলে এবং ম্যারাডোনা নামক দু'জন মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া থেকেই। এরপর ১৯৯০ সালে ম্যারাডোনা যখন তাঁর নিজের দল নিয়ে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে গেলেন, তখন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ম্যারাডোনার জন্য যেমন ব্যথিত হলেন, সেইসাথে অন্য একটি দেশের জাদুকরী ফুটবল প্রত্যক্ষ করলেন যার নাম জার্মানি। এরপর এলো ১৯৯৪ সাল। আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন এসেছে। এতদিন ধরে এদেশের যেসব মানুষ কিংবদন্তী ফুটবলার পেলে'র প্রতি ভালোবাসা আগলে রেখেছিলেন, তারা সবাই ১৯৯৪ সালে একটি ব্রাজিলিয়ান নানন্দিক ফুটবল প্রত্যক্ষ করলেন। পেলে'র যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে রোমারিও, বেবেতো, কাফু প্রমুখের নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকল। ১৯৯৮ সালে সেই চর্চার পালে নতুন হাওয়া লেগেছিল, যখন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো রোনালদো, রিভালদো, কার্লোস প্রভৃতি ফুটবলারগন ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে হাজির হলেন। সেই বছর ব্রাজিলের পাশাপাশি একটি ইউরোপিয়ান ফুটবল দল ফ্রান্সের হয়ে নিজের জাত চেনালেন জিনেদিন জিদান। এরপর ক্রমান্বয়ে ২০০২ সালে রোনালদোর পাশাপাশি রোনালদিনহো এবং কাকা নামক দুর্দান্ত ফুটবলারদের ম্যাজিক্যাল সাম্বার তালে অসাধারণ ফুটবল উপভোগ করলাম আমরা। বহুদিন আগে থেকে যেসব ম্যারাডোনাপ্রেমী বাংলাদেশের দর্শকেরা বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া, ওর্তেগা কিংবা ভেরনের মিডিয়াম টাইপ খেলা দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন, তাদের জন্যেই ২০০৬ সালে আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে উদয় হলেন লিওনেল মেসি। কিন্তু তখন অলিভার কান, মাইকেল বালাক আর মিরোস্লাভ ক্লোসা সেই বিস্ময় বালক 'মেসি'র কৃতিত্ব কে ম্লান করে দিলো। জার্মানি যেন আর্জেন্টিনার অলিখিত শত্রু!

এই লেখাটির প্রথমেই বলেছিলাম আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, অর্থাৎ আমি সেই সময়কার একজন মানুষ। তৎকালীন সেই আবহের মধ্যে বেড়ে ওঠার জন্য আমিও অনেক সিনিয়র ভাইদের দেখাদেখি আর্জেন্টিনার সমর্থকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম। ভালো একটি টিম কে সাপোর্ট করতে হবে বলেই সাপোর্ট করা আর কি! নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে- আমি তেমন ভাবে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট নই। আমার স্পোর্টস বিষয়ক ভালোবাসার নব্বই শতাংশ জায়গাজুড়ে ক্রিকেটের রাজত্ব। আমি মনযোগ দিয়ে ফুটবল খেলা দেখতে শুরু করেছিলাম মুলত ২০০৬ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ ম্যাচ থেকে। সেখানকার একটি খেলায় আমার তৎকালীন পছন্দের দল আর্জেন্টিনা কে জার্মানির কাছে চরমভাবে পরাজিত হবার সেই ম্যাচটি দেখেই আমি জার্মান ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলাম। তারপর থেকে ২০১০, ২০১৪, ২০১৮ ইত্যাদি প্রতিটি ফিফা বিশ্বকাপে আমার সমস্ত ফোকাস জার্মানির ওপরেই নিবদ্ধ ছিল। এখনও মনে আছে ২০১৪ সালের জার্মানদের পুরো স্কোয়াড এবং তাদের খেলার পজিশন আমার মুখস্থ ছিল। তাদের কে কে বায়ার্ন মিউনিখে খেলে, কে কে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে কিংবা রিয়াল মাদ্রিদে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতাম। ফুটবল খেলা মনযোগ দিয়ে দেখতে গিয়ে আমার নিজের একটি ব্যক্তিগত বোধোদয় হয়েছিলঃ খেলা ভালভাবে না দেখে, শুধুমাত্র হুজুগে মেতে একটি দলের পেছনে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। ওমুক ওই দল করে কিংবা আমার ফ্যামিলির মানুষ ওই দলের সমর্থক বলে আমাকেও যে সেই পথে হাঁটতে হবে, এটারও কোন যৌক্তিকতা দেখিনা। আমাদের দেশের বৃহৎ অংশের মানুষ কে যখন ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের সময়ে নির্দিষ্ট দুটো দলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যেতে দেখি, তখন একটি কথাই বারবার করে মনে পড়ে, এদের কয়জন ঠিকঠাক ভাবে বুঝেশুনে ফুটবল দেখে? বাঙালি বদলে যাক কিংবা একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকুক, তাতে এসে যায় না কিছুই। শুধু একটাই প্রত্যাশা, সবাই সত্যিকার অর্থে ফুটবল দেখুক, ফুটবল উপভোগ করুক। অন্য দলের ভালো খেলার প্রশংসা করতে শিখুক। মনের গভীরে একরাশ ঘৃণা রেখে সেটা যত্রতত্র উগরে দেবার নোংরা চর্চা থেকে বেরিয়ে আসুক। জয় হোক ফুটবলের। উপভোগ্য হোক ওয়ার্ল্ডকাপের প্রতিটি ম্যাচ।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
২২.১১.২০২২ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...