একটা নিজস্ব দুঃখ এবং আক্ষেপ সম্ভবত আমার আজীবন ধরে থেকে যাবে। সেটা হলো একজন বাঙালী কিংবা বাংলাদেশী হিসেবে এই ভূখণ্ডে আমার জন্ম হয়েছে। আমার চল্লিশ বছর বয়সের এই পর্যন্ত সমস্ত পঠিত বিদ্যা এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, এই গ্রহের আর কোন রাষ্ট্র কিংবা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এতটা বেশি নিকৃষ্ট হিসেবে জন্ম নেয়নি। 'সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, আমার সোনার বাংলাদেশ', আহ্! কী অপূর্ব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ; অথচ এই উর্বর মাটিতেই জন্ম নেয় দুনিয়ার নিকৃষ্টতর এক একটি নরকের কীট! বাংলাদেশের মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি দূর্ভাগ্যের বিষয় হলো তারা এতটাই বেশি অশিক্ষিত মূর্খ যে, নিজের ইতিহাস সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও তাদের নেই। এদেশে প্রতিটি বছর এতো এতো মানুষ যে হাতে একটা সনদ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছে, তাদের ঐ গ্রাজুয়েশন ক্যাপ গাউনের ভেতরে যে মানুষ গুলো অবস্থান করছে, তারা আদৌ কতটুকু শিক্ষিত হতে পেরেছে? আমি শৈশব থেকেই দেশের ইতিহাস সম্পর্কে পড়তে গিয়ে একটা স্থুল ধারণা পেয়েছিলাম যে, একটি রাষ্ট্র কিংবা জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পাকিস্তান কে আমাদের ঘৃণা করতে হবে। আস্তে আস্তে যখন বড় হলাম, যখন আরও বিশদভাবে ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারলাম, তখন বিস্মিত হয়ে অনুভব করেছি- পাকিস্তানী মানুষেরা ততটা ঘৃণিত নয়, যতটা ঘৃণ্য নোংরা এই দেশের বাঙালীরা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈনিক যতটা নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে, তার চেয়ে দশগুণ বেশি নৃশংসতা চালিয়েছে এদেশে জন্ম নেওয়া ঘাতক দালাল রাজাকারের গোষ্ঠী। কই, তাদের প্রতি যতটা ঘৃণা প্রদর্শন করা উচিৎ, সেটা তো কোনদিনই এদেশে বসে দেখলাম না। এদেশের মানুষ হিসেবে সেই রাজাকারের সর্দারদের মহান জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখেছি। আমার এই লেখাটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আমি একটি স্বচ্ছ ইতিহাস তুলে ধরছি।
আমরা সবাই জানি, ফেব্রুয়ারী মাস আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবার মাস। এই মাস আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করতে গিয়ে চরম আত্মত্যাগ করার মাস। আচ্ছা, আপনারা সবাই জানেন যে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালী ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সকাল নয়টায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে জড়ো হতে শুরু করে। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সোয়া এগারোটার দিকে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করে। ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড় দেয় এবং বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করে। উপাচার্য পুলিশকে গুলি চালানো বন্ধ করতে এবং ছাত্রদেরকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। ছাত্রদের চলে যাবার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের জন্য কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানায়। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিঙের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টাকালে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ অনেক ছাত্র নিহত হয়। হ্যাঁ, এটুকু জানেন। কিন্তু আপনারা বলুন তো, নুরুল আমিন কে ছিলেন? তার পরিচয় কি ঠিকঠাক ভাবে জানেন? আচ্ছা, আমি জানাচ্ছি।
নুরুল আমিন ছিলেন একজন বাঙালী রাজনীতিবিদ। তিনি ১৮৯৩ সালে অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার শাহবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলায় তিনি বড় হয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্র ভাষা বাংলার জন্য আন্দোলনের সময়ে এই নুরুল আমিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সরাসরি ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারী ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনার নেপথ্যের কলকাঠি তিনিই নেড়েছেন। এবার আসুন নুরুল আমিনের সুপিরিয়র প্রসঙ্গে। আচ্ছা, বলুন তো- খাজা নাজিমুদ্দিন কে ছিলেন? তার পরিচয় কি ঠিকঠাক ভাবে জানেন? আচ্ছা, আমি জানাচ্ছি।
খাজা নাজিমুদ্দিন ছিলেন একজন বাঙালী রাজনীতিবিদ। তিনি ঢাকার নবাব পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সদস্য হিসেবে নাজিমুদ্দিন দুইবার বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যু পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের মৃত্যুর পর তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হন। অর্থাৎ ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের সময়ে এই ব্যক্তি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আচ্ছা, বিষয় টা কেমন জানি হয়ে গেল না? এই ভূখণ্ডের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে 'বাংলা' কে প্রতিষ্ঠিত করার সক্রিয় বিরোধী ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন। এই দুইজন লোক ছিলেন জন্মসূত্রে বাঙালী এবং এই দুজনের জন্ম হয়েছিল এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলায়। ছিঃ ছিঃ!! অথচ আপনারাও জন্মসূত্রে বাঙালী হিসেবে কিছু ভুলভাল ইতিহাস চর্চা করে বড় হয়েছেন এবং ভেবে বসে আছেন যে, এদেশের ভাষা আন্দোলনের বিরোধী কোন একজন পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী পাঞ্জাবী লোক, তাই না? ভুল, সবই ভুল!
এই লেখাটি আমি কেন এখন লিখছি জানেন? অত্যন্ত ক্ষোভ এবং ব্যক্তিগত দুঃখবোধের জায়গা থেকে। বাংলাদেশে এখন বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ) ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছে। দুদিন আগে ভাষার মাসের চিহ্ন হিসেবে এই টুর্নামেন্টের সব ক্রিকেটারের বাহুতে বাংলা বর্ণমালা সংবলিত একটি 'আর্মব্যাণ্ড' পরিধান করতে বলা হয়। সবাই সেই বাহুবন্ধনী পরে খেলার পর পাকিস্তানের ক্রিকেটার মোহাম্মদ রিজওয়ান কে স্পেশালি ডেকে সাংবাদিকেরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রিজওয়ান হাতে যেটা পরে আছেন, ওটার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন কিনা?! আচ্ছা, ভাবুন তো কতবড় নির্লজ্জ একটা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হলে নতুন এই প্রজন্মের একজন পাকিস্তানী ক্রিকেটার কে এই ধরনের প্রশ্ন করে বিব্রত করা হয়! রিজওয়ান সেদিন এর উত্তর দিতে পারেননি, তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে জানেন না। আমার কথা হলো, মোহাম্মদ রিজওয়ান মাত্র সেদিনের একটা পাকিস্তানী পুচকে ছেলে, ও কিভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিষয় জানবে? আমি জানতে চাই- রিজওয়ান কে যারা যারা এই প্রশ্ন করে বিব্রত করেছে, তারা নিজেরা একুশে ফেব্রুয়ারীর ইতিহাস নিয়ে কতটুকু জানেন?
শোন কুকুরের দল, তোর দেশের মহান ভাষা আন্দোলনের সেই ঘটনার দায়ভার কিন্তু মোহাম্মদ রিজওয়ানের বাপ-দাদার ওপরে বর্তায় না। এর দায়ভার তোর নিজস্ব বাঙালী বাপ-দাদার, যারা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করেছিল, তোর বাপ-দাদারাই আবার ১৯৭১ সালে স্বদেশী মুক্তিকামী মানুষের ওপর নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। যথেষ্ট সময় হয়েছে, এখন একটু শিক্ষিত হ! এখন একটু সভ্য হ! নাকি তোদের সেই ভূতপূর্ব বাঙালী পৈশাচিকতা এখনো সমানভাবে নতুন প্রজন্মের মানুষের সামনে হাজির করবি? ভালো হয়ে যা মূর্খের দল!
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১৩.০২.২০২৩ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন