আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। বাংলাদেশের তৎকালীন আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করলে সেই সময়ের বিনোদন ব্যবস্থা কয়েকটি সীমিত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখনকার দিনে যেহেতু মানুষের ঘরে ঘরে টেলিভিশন আসেনি এবং স্যাটেলাইট চ্যানেল কি জিনিস সেটাও যেহেতু বেশিরভাগ মানুষের ধারণার বাইরে ছিল, তাই বিনোদনের উপকরণ হিসেবে দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা নিয়েই মেতে ছিল এদেশের সেই সময়কার মানুষ। উল্লেখযোগ্য বিনোদনের চর্চা বলতে পালাগান, ঘুড়ি ওড়ানো, গ্রামীণ মেলা, যাত্রাপালা, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়ার দৌড়, নৌকা বাইচ ইত্যাদি বিষয়গুলো ছিল বহুলভাবে চর্চিত। খেলাধুলা বলতে হাডুডু এবং কখনও কখনও ফুটবল। তখনকার সময়ের ফুটবল ম্যাচে খুব কম সংখ্যক খেলোয়াড়দের জার্সি কিংবা বুট পরে খেলতে দেখা যেতো। সেই সময়গুলোতে বাংলাদেশের ফুটবল ক্লাব বলতে আবাহনী এবং মোহামেডান আর ভারতীয় তথা পশ্চিমবঙ্গের ক্লাব হিসেবে ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের নাম খুব করে শোনা যেতো। আমি শৈশবে এইসব ক্লাবের ফুটবল খেলা চলাকালীন সময়ে প্রবীণদের রেডিও কানের কাছে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে ধারাভাষ্য শুনতে দেখেছি। ল্যাটিন আমেরিকান কিংবা ইউরোপিয়ান ফুটবলের চর্চা তখনও আমাদের দেশে সেভাবে শুরু হয়নি।
"চতুর্মাত্রিক সংলাপ" একটি বাংলা ভাষায় আর্টিকেল প্রকাশের একক ব্লগসাইট। এখানে প্রকাশিত আর্টিকেল বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিজ্ঞান, সামাজ ব্যাবস্থা, ইতিহাস এবং নিজস্ব দর্শনের ওপরে লিখিত।
বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩
'ফুটবল ভাবনা'
তাহলে এদেশে কিভাবে ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের চর্চা ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো? হ্যাঁ, আমি সেই সময়কার একজন মানুষ বলেই গোটা বিষয়টি খুব সুক্ষ্মভাবে আমার চোখের সামনে থেকে ঘটতে দেখেছি। সেই সময়কার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকের অন্তর্ভুক্ত বাংলা টেক্সটবুকে 'ফুটবলের রাজা' নামক একটি গল্প ছিল। আমার চেয়ে বয়ষ্ক কিংবা আমার সমবয়সী প্রজন্মের সমস্ত মানুষই পাঠ্য বইয়ের সেই গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। সেই গল্পে 'পেলে' নামক একজন ব্রাজিলিয়ান মানুষ কিভাবে হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে থেকে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে নিজের যোগ্যতাবলে ফুটবলের রাজা হয়েছিলেন তা বর্ণনা করা হয়েছিল। স্বভাবতই উক্ত ফুটবলারের খেলা না দেখেও শুধুমাত্র তাঁর গল্প পড়ে আমাদের সমসাময়িক কালের মানুষের মনের গভীরে পেলে'র জন্য একধরণের গভীর ভালোবাসা জন্ম নিয়েছিল। এরপর ১৯৮৬ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ আমাদের দেশের বেশ কিছু মানুষ দেখেছিলেন কিংবা সংবাদপত্রে এই খেলার ওপরে লেখা আর্টিকেল পড়েছিলেন, যেখানে ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামক একজন আর্জেন্টাইন ফুটবলারের একক কৃতিত্বে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়ের বিষয়টি ছিল।
আমরা সবাই নিজেদের সম্পর্কে একটি বিষয় খুবই স্পষ্টভাবে জানি যে, বাঙালি মুলত একটি হুজুগে মেতে ওঠা জাতি। আমাদের দেশের মানুষের ব্যপক অর্থে ল্যাটিন আমেরিকান ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল মুলত পেলে এবং ম্যারাডোনা নামক দু'জন মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হওয়া থেকেই। এরপর ১৯৯০ সালে ম্যারাডোনা যখন তাঁর নিজের দল নিয়ে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরে গেলেন, তখন আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ম্যারাডোনার জন্য যেমন ব্যথিত হলেন, সেইসাথে অন্য একটি দেশের জাদুকরী ফুটবল প্রত্যক্ষ করলেন যার নাম জার্মানি। এরপর এলো ১৯৯৪ সাল। আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন এসেছে। এতদিন ধরে এদেশের যেসব মানুষ কিংবদন্তী ফুটবলার পেলে'র প্রতি ভালোবাসা আগলে রেখেছিলেন, তারা সবাই ১৯৯৪ সালে একটি ব্রাজিলিয়ান নানন্দিক ফুটবল প্রত্যক্ষ করলেন। পেলে'র যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে রোমারিও, বেবেতো, কাফু প্রমুখের নাম জোরেশোরে উচ্চারিত হতে থাকল। ১৯৯৮ সালে সেই চর্চার পালে নতুন হাওয়া লেগেছিল, যখন হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো রোনালদো, রিভালদো, কার্লোস প্রভৃতি ফুটবলারগন ব্রাজিলের পতাকা নিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে হাজির হলেন। সেই বছর ব্রাজিলের পাশাপাশি একটি ইউরোপিয়ান ফুটবল দল ফ্রান্সের হয়ে নিজের জাত চেনালেন জিনেদিন জিদান। এরপর ক্রমান্বয়ে ২০০২ সালে রোনালদোর পাশাপাশি রোনালদিনহো এবং কাকা নামক দুর্দান্ত ফুটবলারদের ম্যাজিক্যাল সাম্বার তালে অসাধারণ ফুটবল উপভোগ করলাম আমরা। বহুদিন আগে থেকে যেসব ম্যারাডোনাপ্রেমী বাংলাদেশের দর্শকেরা বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়া, ওর্তেগা কিংবা ভেরনের মিডিয়াম টাইপ খেলা দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন, তাদের জন্যেই ২০০৬ সালে আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে উদয় হলেন লিওনেল মেসি। কিন্তু তখন অলিভার কান, মাইকেল বালাক আর মিরোস্লাভ ক্লোসা সেই বিস্ময় বালক 'মেসি'র কৃতিত্ব কে ম্লান করে দিলো। জার্মানি যেন আর্জেন্টিনার অলিখিত শত্রু!
এই লেখাটির প্রথমেই বলেছিলাম আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, অর্থাৎ আমি সেই সময়কার একজন মানুষ। তৎকালীন সেই আবহের মধ্যে বেড়ে ওঠার জন্য আমিও অনেক সিনিয়র ভাইদের দেখাদেখি আর্জেন্টিনার সমর্থকের খাতায় নাম লিখিয়েছিলাম। ভালো একটি টিম কে সাপোর্ট করতে হবে বলেই সাপোর্ট করা আর কি! নিজের সম্পর্কে বলতে গেলে- আমি তেমন ভাবে ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট নই। আমার স্পোর্টস বিষয়ক ভালোবাসার নব্বই শতাংশ জায়গাজুড়ে ক্রিকেটের রাজত্ব। আমি মনযোগ দিয়ে ফুটবল খেলা দেখতে শুরু করেছিলাম মুলত ২০০৬ সালের ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপ ম্যাচ থেকে। সেখানকার একটি খেলায় আমার তৎকালীন পছন্দের দল আর্জেন্টিনা কে জার্মানির কাছে চরমভাবে পরাজিত হবার সেই ম্যাচটি দেখেই আমি জার্মান ফুটবলের প্রেমে পড়েছিলাম। তারপর থেকে ২০১০, ২০১৪, ২০১৮ ইত্যাদি প্রতিটি ফিফা বিশ্বকাপে আমার সমস্ত ফোকাস জার্মানির ওপরেই নিবদ্ধ ছিল। এখনও মনে আছে ২০১৪ সালের জার্মানদের পুরো স্কোয়াড এবং তাদের খেলার পজিশন আমার মুখস্থ ছিল। তাদের কে কে বায়ার্ন মিউনিখে খেলে, কে কে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডে কিংবা রিয়াল মাদ্রিদে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দিতাম। ফুটবল খেলা মনযোগ দিয়ে দেখতে গিয়ে আমার নিজের একটি ব্যক্তিগত বোধোদয় হয়েছিলঃ খেলা ভালভাবে না দেখে, শুধুমাত্র হুজুগে মেতে একটি দলের পেছনে পড়ে থাকার কোন মানে হয় না। ওমুক ওই দল করে কিংবা আমার ফ্যামিলির মানুষ ওই দলের সমর্থক বলে আমাকেও যে সেই পথে হাঁটতে হবে, এটারও কোন যৌক্তিকতা দেখিনা। আমাদের দেশের বৃহৎ অংশের মানুষ কে যখন ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের সময়ে নির্দিষ্ট দুটো দলের মধ্যে বিভক্ত হয়ে যেতে দেখি, তখন একটি কথাই বারবার করে মনে পড়ে, এদের কয়জন ঠিকঠাক ভাবে বুঝেশুনে ফুটবল দেখে? বাঙালি বদলে যাক কিংবা একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে থাকুক, তাতে এসে যায় না কিছুই। শুধু একটাই প্রত্যাশা, সবাই সত্যিকার অর্থে ফুটবল দেখুক, ফুটবল উপভোগ করুক। অন্য দলের ভালো খেলার প্রশংসা করতে শিখুক। মনের গভীরে একরাশ ঘৃণা রেখে সেটা যত্রতত্র উগরে দেবার নোংরা চর্চা থেকে বেরিয়ে আসুক। জয় হোক ফুটবলের। উপভোগ্য হোক ওয়ার্ল্ডকাপের প্রতিটি ম্যাচ।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
২২.১১.২০২২ খ্রিঃ
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
'দানে দানে তিন দান'
সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...
-
কৃষ্ণেন্দু দাস একুশ শতকের আধুনিক বাংলা ভাষার এক অখ্যাত কবি। তাঁর জন্ম ২৯ শে আগষ্ট ১৯৮৩ ইং সালে বাগেরহাট জেলায়। বাংলার ভাষা, ঐতিহ্য, সাহি...
-
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতার্ত দিনগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু দেরি করেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে। শরীরের মাঝে কিংবা অবচেতনে কোথায় যেন একটা আড়ষ্টতা ব...
-
কেন জানি আজ খুব করে মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব দিনগুলোর কথা। তখন সবেমাত্র এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি, সেটা ছিল ২০০০ সালের কথা। পড়াশোনার সমস্ত চাপ হ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন