"সবার ওপরে ধর্ম সত্য"
একটি জাতি হিসেবে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশীরা এখন যথেষ্টই উন্নত। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, চেতনা বোধের সাথে ঐতিহাসিক বাস্তবতা মিলেমিশে বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে আমাদের অবস্থান এখন অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু আদৌ কি তাই? একটি সভ্য জাতি হিসেবে আমরা কি সত্যিই অনেক সুসংহত? একজন সত্যিকারের বাংলাদেশী হিসেবে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করুণ তো! আচ্ছা, একটি ভুল প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার সৎসাহস আমাদের বর্তমানের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠিক কতটা উপস্থিত? আমরা সঠিক ইতিহাস কিংবা তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের জন্য কতটা আগ্রহী? একটি ভুল পথে এগিয়ে যাওয়া বৃহত্তর সংখ্যার জনগোষ্ঠীকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে আমরা কতটুকু উদ্যোগী? হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চিন্তা করতে গিয়ে আমরা প্রত্যেকেই খানিকটা হলেও বিমর্ষ হয়ে যাই। কারণটা সবার কাছেই পরিষ্কার। গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখেছি সমস্ত নিউজ পোর্টাল আর অসংখ্য মানুষের টাইমলাইন জুড়ে একটি সংবাদ ঘুরে বেড়িয়েছে, সেই সাথে প্রচুর মানুষের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস সংবলিত কথাবার্তা। যদিও সংবাদটি ছিলো একটি মৃত্যুসংবাদ! জনৈক পীর সৈয়দ মাহবুব এ খোদা দেওয়ানবাগী মৃত্যুবরণ করেছেন, এটা শুনেই বৃহৎ সংখ্যক মানুষের মধ্যে সেকি বিজয়োল্লাস! আচ্ছা, ঠিক কেন এই মানুষটি এতটা ঘৃণিত? তার সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আমরা কয়জন ঠিকঠাক জানি? এর উত্তর দিতে গেলেও খানিকটা ঝিম ধরে থাকতে হবে। হ্যাঁ, তিনি ঘৃণিত ছিলেন তার ভুলভাল ধর্মীয় ব্যাখ্যার কারণে। অথচ, ভুল ভাবে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেওয়া আরো কিন্তু প্রচুর সংখ্যক মানুষ ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন। নিজস্ব নীতিতে ধর্মচর্চা করার অধিকার সবারই আছে, কথায় আছে- "নানা মুনির নানা মত"! যাইহোক, তাহলে উদ্ভট ধর্মপালন পদ্ধতির জন্য একটি মানুষ এতটাই ঘৃণিত হয়ে যান যে, তার মৃত্যুসংবাদ শুনে চরমভাবে উল্লাস প্রকাশ করা যায়। আমরা যারা নব্য প্রজন্মের মানুষ, তারা নানান ভাবেই সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। তার মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এই ঘৃণিত ভন্ড মানুষটিই ১৯৭১' এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিন নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে তিনি কর্মরত ছিলেন। ৩ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল কে.এম.শফিউল্লাহ এই মানুষটিকে পরে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। উল্লেখ্য যে, সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কে.এম.শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) এখনো জীবিত আছেন। তৎকালীন তিন নম্বর সেক্টরের অধিকাংশ অফিসার এবং সৈনিকের অত্যন্ত পছন্দের একজন মানুষ ছিলেন তরুণ মাওলানা সৈয়দ মাহবুব এ খোদা। বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা তাদের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইয়ে এই মানুষটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। অথচ, নতুন প্রজন্মের একজন মানুষ হিসেবে আপনি মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দ মাহবুব এ খোদার ভুমিকা লিখে গুগলে সার্চ দিন, কোন তথ্যই খুঁজে পাবেন না। কেন বলুন তো? ওই যে, উক্ত ব্যক্তিটি ধর্মীয় ভাবে বিতর্কিত! আর এই কারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার ভুমিকা নিয়ে লেখার মতো ন্যূনতম আগ্রহই সবাই হারিয়ে ফেলেছেন। তার মানে কি দাঁড়ায়? একজন মানুষ কে বিচারের মানদণ্ড হলো একমাত্র ধর্ম! মনুষ্যত্ব, বিচারবোধ, ব্যক্তি গুণাবলী থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পর্যন্ত ধূলিসাৎ হয়ে যায়, যদি ধর্মবোধে সামান্যতম টান পড়ে। এটাই যখন এখনকার প্রতিষ্ঠিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এক বাক্যেই স্বীকার করে নিতে হয়- "সবার ওপর ধর্ম সত্য, তাহার ওপর নাই!"
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রিঃ