শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১

'নিজস্ব এক্সপেরিমেন্ট'

 

প্রায় এগারো বছর ধরে ফেসবুক সহ সোশ্যাল মিডিয়ার আরও দু'একটা সাইটে যুক্ত থাকার কারণে অনেক দিন থেকেই একটি কথা বেশ জোরেশোরে শুনতে পাই। কথাটি হলোঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোন একটি মেয়েকে প্রতিনিয়তই আবশ্যিক ভাবে অনাকাঙ্খিত কিছু উপদ্রবের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু এই উপদ্রবের মাত্রা আসলে কতটা গুরুতর এবং এজাতীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিক একটি মানুষ হিসেবে একজন নারী  আসলে কতটুকু বিড়ম্বনার শিকার হন, এই বিষয়ে আমার কখনোই পরিষ্কার কোন ধারণা ছিলনা। যাইহোক, বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবার জন্য হঠাৎ করেই একটি এক্সপেরিমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অত্যন্ত সহজ এবং শতভাগ কার্যকরী পদ্ধতি ছিল এটা।

কিছুদিন আগে মোটামুটি চেহারার অখ্যাত একজন নারী মডেলের কয়েকটি ছবি ব্যবহার করে একটি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করলাম, উক্ত প্রোফাইলে এমনভাবে সমস্ত তথ্য সংযোজন করলাম যাতে ওটা ভিজিট করতে গিয়ে কারোর মনে কোন প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। এরপর আরও একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমার কয়েকটি লেখা উক্ত এ্যাকাউন্টে সেই মেয়েটির নাম দিয়ে পোস্ট করে দিলাম। এবারে হাতেনাতে ফলাফল পেতে শুরু করলাম। অসংখ্য অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসতে শুরু করলো, বলাই বাহুল্য তাদের নিরানব্বই শতাংশই আমার জাতভাই একেকজন 'সিংহ পুরুষ'! তারা ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হয়েই ইনবক্সে এসে ইনিয়েবিনিয়ে নানান খুটিনাটি সস্তা ধরনের কথাবার্তা বলে অচেনা মেয়েটির মনোরঞ্জনে নিজেদের নিয়োজিত করলেন। দু'একজন তো একধাপ এগিয়ে গিয়ে নিজেদের পৌরুষ বিকৃত ভাবে প্রদর্শন করে বিভিন্ন কুৎসিত ছবি এবং অশ্লীল ভাষায় মন্তব্য প্রদান করলেন। আমি তাদের পাঠানো টেক্সটগুলো দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম! একটু কৌতূহলী হয়ে তাদের প্রোফাইল ঘুরে দেখে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি। যদিও বেশকিছু ফেইক এ্যাকাউন্ট ছিল, তবে যৌন বিকারগ্রস্থ সেইসব মানুষের অনেকেই নিজের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত প্রোফাইল ব্যবহার করেন। আমি ভীষণ রকম অবাক হয়ে দেখলাম তাদের কয়েকজন কিছুদিন আগেই 'ডটার্স ডে' উপলক্ষে নিজের ফুটফুটে কন্যা সন্তানটিকে কোলে নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে ছবি তুলে আপলোড দিয়েছেন, কয়েকজন নিজের ছোটবোনকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠার মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী করেছেন, কারো কারো ওয়ালে শোভা পাচ্ছে নিজের প্রেমিকা কে নিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাবার প্রেমময় মুহূর্ত, কেউ সস্ত্রীক নিজের সুখী দাম্পত্য জীবন কে বাহুল্য বর্ণনায় ভরিয়ে তুলেছেন! 

ওনারা প্রত্যেকেই এই সোসাইটিতে বসবাস করেন, প্রত্যেকেরই রয়েছে সুন্দর এনভায়রনমেন্টের একটি পারিবারিক জীবন। অথচ তারাই আবার সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যমে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে অপরিচিত একটি মেয়েকে গোপনে উত্যক্ত করে তীব্র মানসিক সুখ লাভ করছেন। এই পরীক্ষাটি করতে গিয়ে আমি সাংঘাতিক একটা ধাক্কা খেয়েছি, কারণ আমার বাস্তব জীবনে পরিচিত দুই-চারজন মানুষও আমার এই ফেইক এ্যাকাউন্টে এসে গদগদবচনে প্রোফাইলের মেয়েটির রূপের বন্দনা করে গেছেন! আমার জানতে ইচ্ছে করে- আমাদের বাঙালী সমাজের ম্যাক্সিমাম পুরুষেরাই কি নিজেদের অবচেতনে অবদমিত কামনা লালন করেন? ওনারা সংগোপনে প্রত্যেকেই কি যৌন বিকারগ্রস্ত? তাদের মধ্যে কি ব্যক্তিত্বের এতো বেশি স্খলন ঘটেছে? এর জবাব পেতে নিজেকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব গবেষণা করার দরকার পড়েনা। আমার ওই তিনটি প্রশ্নের প্রতিটির জবাবই 'হ্যাঁ'! দিন কে দিন নৈতিকতার এত বেশি অধঃপতন ঘটেছে যে- ওনাদের কারণে অনেক মেয়েরা এখন 'ফেসবুকের ইনবক্স কিভাবে বন্ধ করা যায়' লিখে গুগলে সার্চ করে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পন্থা কি নেই?! অথচ এভাবে কি চিন্তা করা যায় না- আপনি একজন পুরুষ। আপনার মেধা মনন, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব আর মার্জিত আচরণ দেখে একজন নারী আপনার প্রতি মুগ্ধ হবে!

ভাই, আপনি একজন পুরুষ। এই প্রকৃতি আপনাকে উদার হিসেবে, সুন্দর হিসেবে, শক্তিশালী হিসেবে, দায়িত্বশীল হিসেবে সৃষ্টি করেছে। নিজের প্রতি একটু তো সুবিচার করুণ! আপনার সামান্য কিছু ভুলের জন্য বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের কাছে আমাদের সবাই কে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার কোন অধিকার আপনার নেই। ঠিক যেভাবে পারিবারিক জীবনে আপনি একজন অনুগত সন্তান, প্রেমময় প্রেমিক, দায়িত্বশীল স্বামী এবং স্নেহময় পিতা এবং বড়ভাই, ঠিক সেভাবেই নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পেশ করুণ। কারণ আপনার পরিবার এবং আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে যেমন সমাজ ব্যবস্থা গঠিত হয়েছে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়াও আপনার সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজেকে পাল্টান, পাল্টে যাবে আপনার চতুর্পাশের পরিবেশ। আপনার সামান্য একটু সচেতনতাই আমাদের আগামী প্রজন্ম কে একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিতে পারে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১০.১০.২০২১ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...