"দ্বিতীয় অস্তিত্ব"
....ক্লাস এইটে পড়াকালীন সময়ে স্কুলের লাইব্রেরী থেকে একটি বই নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে পড়েছিলাম। বইটি ছিলো রবার্ট লুই স্টিভেনসনের লেখা "ডঃ জেকিল এ্যন্ড মিঃ হাইড" বইয়ের অনুবাদ। গল্পটি শেষ করার পর অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছুঁয়ে গিয়েছিলো সেদিন আমার সমস্ত অন্তরাত্মাকে। সায়েন্স ফিকশন তখন সবে বুঝতে শুরু করেছি, কিন্তু সাইকোলজির বিষয়টুকু তখনও বোধের বাইরে। ক্লাস এইটের একজন ছাত্রের বোধের পরিব্যাপ্তি কতটুকুই বা হওয়া সম্ভব! তাই এই গল্পের মুল বিষয়বস্তু আত্মস্থ করতে স্বাভাবিক ভাবেই আমার একটু বেশিই সময় লেগেছিলো। পরে যখন দ্বৈত সত্ত্বার বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করেছি, খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বুঝতে পেরেছি এই তত্ত্বের গভীরতা আসলেই অনেকটা বিস্তৃত। সত্যি বলতে কি- প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই দ্বৈত সত্ত্বার বিষয়টি লুকিয়ে থাকে। একটি অংশ সুন্দর এবং অন্যটি কুৎসিত! সামাজিক পরিবেশে বসবাস করার জন্যই আমরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রাণপনে চেষ্টা করি কুৎসিত অংশটি'কে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু আমাদের অবচেতনে কুৎসিত অংশটি পূর্ণতা নিয়ে সদম্ভেই দাপিয়ে বেড়ায়। আমাদের প্রায় সবারই মনের মধ্যে কিছু গোপন অনুভূতি থাকে, যেগুলো সচরাচর অবদমন করে রাখা হয়। সেটা হতে পারে ব্যক্তিগত কামনা, ক্ষোভ, দুঃখবোধ কিংবা ভয়াবহ হিংস্রতা। সবার মাঝেই এই গোপন অনুভূতি গুলোকে প্রশ্রয় দেবার একটা প্রচ্ছন্ন মানসিকতা থাকে। কিন্তু সামাজিক অবকাঠামো তাদের সেই বিশেষ অনুভূতি গুলোর বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। গল্পে ডঃ জেকিল নামের একজন বিজ্ঞানী বিশেষ একটি ঔষধ নিজের ওপর প্রয়োগ করে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা দানব মিঃ হাইড কে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন, এরপর নিজের কুৎসিত বাসনাগুলো চরিতার্থ করার পর আবারও নিজের ওপর রাসায়নিক প্রয়োগ করে তিনি আগের মতোই ডঃ জেকিল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এটা তো স্রেফ একটি কাল্পনিক কাহিনী, কিন্তু বাস্তবে যদি সত্যিই একটি মানুষের দুটি পৃথক অস্তিত্ব থাকতো! আমি এই বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটি বিষয় নিজে থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। হ্যাঁ, খানিকটা হলেও এই বিষয়ের একটি বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো যায়। সেটা হলো ভার্চুয়াল জগতে!
ধরা যাক, ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ সাইটে আমার নিজস্ব একটি পরিচিতি আছে। সেখানে আমি সবার খুব পছন্দের একজন মানুষ। আমার আচার ব্যবহার খুবই বিনয়ী, আমি মানুষের দুঃখ কষ্টের সাথী হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করি। আমার কর্মকাণ্ডের জন্যেই পরিচিত মানুষেরা আমাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এবারে যদি আমি ভিন্ন নাম, ভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে একই যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন আর একটি পরিচিতি তৈরি করি, যে বিষয়টি আমি ব্যাতীত বাকী সবার কাছেই অজ্ঞাত থাকবে। আমার এই দ্বিতীয় পরিচিতি হবে আমার প্রথম পরিচিতির হুবহু উল্টো। এখানে আমি প্রচন্ড রকম উগ্র, অসামাজিক আর অপরাধী মানসিকতার একজন মানুষ। আমার গোপন করে রাখা চাপা অনুভূতির প্রকাশ এখানেই আমি ঘটাব এবং একটি সময়ে এই পরিচিতি থেকে লগ আউট হয়ে আবারও পূর্বের পরিচিতি'তে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সৌম্য, ভদ্রলোক হিসেবে থাকব। একই সঙ্গে নিজের দ্বৈত সত্ত্বার বাস্তব ব্যবহার! রবার্ট লুই স্টিভেনসনের গল্পের বাস্তবতা ভার্চুয়াল জগতটা এখন সম্ভব করে দিয়েছে। যদিও এখানে সরাসরি দৈহিক ভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু ছায়াময়তার মাঝে নিজের অনুভূতির পুরোটুকুই ব্যবহার করা যায়। কারণ এখানে ব্যবহৃত অংশটি আপনার কিংবা আমার একান্তই নিজস্ব চেতনার বাস্তব জীবন্ত অংশ, যেটুকু পরম যত্নে আমরা আগলে রাখি নিজেদের মস্তিষ্কের গোপনীয় এক কুঠুরীতে!
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
নভেম্বর, ২০২০ খ্রিঃ