বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০

"দ্বিতীয় অস্তিত্ব"

 "দ্বিতীয় অস্তিত্ব"  


....ক্লাস এইটে পড়াকালীন সময়ে স্কুলের লাইব্রেরী থেকে একটি বই নিয়ে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে পড়েছিলাম। বইটি ছিলো রবার্ট লুই স্টিভেনসনের লেখা "ডঃ জেকিল এ্যন্ড মিঃ হাইড" বইয়ের অনুবাদ। গল্পটি শেষ করার পর অদ্ভুত এক ভালোলাগা ছুঁয়ে গিয়েছিলো সেদিন আমার সমস্ত অন্তরাত্মাকে। সায়েন্স ফিকশন তখন সবে বুঝতে শুরু করেছি, কিন্তু সাইকোলজির বিষয়টুকু তখনও বোধের বাইরে। ক্লাস এইটের একজন ছাত্রের বোধের পরিব্যাপ্তি কতটুকুই বা হওয়া সম্ভব! তাই এই গল্পের মুল বিষয়বস্তু আত্মস্থ করতে স্বাভাবিক ভাবেই আমার একটু বেশিই সময় লেগেছিলো। পরে যখন দ্বৈত সত্ত্বার বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করেছি, খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বুঝতে পেরেছি এই তত্ত্বের গভীরতা আসলেই অনেকটা বিস্তৃত। সত্যি বলতে কি- প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই দ্বৈত সত্ত্বার বিষয়টি লুকিয়ে থাকে। একটি অংশ সুন্দর এবং অন্যটি কুৎসিত! সামাজিক পরিবেশে বসবাস করার জন্যই আমরা প্রায় প্রত্যেকেই প্রাণপনে চেষ্টা করি কুৎসিত অংশটি'কে লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু আমাদের অবচেতনে কুৎসিত অংশটি পূর্ণতা নিয়ে সদম্ভেই দাপিয়ে বেড়ায়। আমাদের প্রায় সবারই মনের মধ্যে কিছু গোপন অনুভূতি থাকে, যেগুলো সচরাচর অবদমন করে রাখা হয়। সেটা হতে পারে ব্যক্তিগত কামনা, ক্ষোভ, দুঃখবোধ কিংবা ভয়াবহ হিংস্রতা। সবার মাঝেই এই গোপন অনুভূতি গুলোকে প্রশ্রয় দেবার একটা প্রচ্ছন্ন মানসিকতা থাকে। কিন্তু সামাজিক অবকাঠামো তাদের সেই বিশেষ অনুভূতি গুলোর বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। গল্পে ডঃ জেকিল নামের একজন বিজ্ঞানী বিশেষ একটি ঔষধ নিজের ওপর প্রয়োগ করে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা দানব মিঃ হাইড কে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন, এরপর নিজের কুৎসিত বাসনাগুলো চরিতার্থ করার পর আবারও নিজের ওপর রাসায়নিক প্রয়োগ করে তিনি আগের মতোই ডঃ জেকিল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এটা তো স্রেফ একটি কাল্পনিক কাহিনী, কিন্তু  বাস্তবে যদি সত্যিই একটি মানুষের দুটি পৃথক অস্তিত্ব থাকতো! আমি এই বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করে একটি বিষয় নিজে থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। হ্যাঁ, খানিকটা হলেও এই বিষয়ের একটি বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো যায়। সেটা হলো ভার্চুয়াল জগতে! 

ধরা যাক, ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ সাইটে আমার নিজস্ব একটি পরিচিতি আছে। সেখানে আমি সবার খুব পছন্দের একজন মানুষ। আমার আচার ব্যবহার খুবই বিনয়ী, আমি মানুষের দুঃখ কষ্টের সাথী হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করি। আমার কর্মকাণ্ডের জন্যেই পরিচিত মানুষেরা আমাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। এবারে যদি আমি ভিন্ন নাম, ভিন্ন তথ্য ব্যবহার করে একই যোগাযোগ মাধ্যমে ভিন্ন আর একটি পরিচিতি তৈরি করি, যে বিষয়টি আমি ব্যাতীত বাকী সবার কাছেই অজ্ঞাত থাকবে। আমার এই দ্বিতীয় পরিচিতি হবে আমার প্রথম পরিচিতির হুবহু উল্টো। এখানে আমি প্রচন্ড রকম উগ্র, অসামাজিক আর অপরাধী  মানসিকতার একজন মানুষ। আমার গোপন করে রাখা চাপা অনুভূতির প্রকাশ এখানেই আমি ঘটাব এবং একটি সময়ে এই পরিচিতি থেকে লগ আউট হয়ে আবারও পূর্বের পরিচিতি'তে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সৌম্য, ভদ্রলোক হিসেবে থাকব। একই সঙ্গে নিজের দ্বৈত সত্ত্বার বাস্তব ব্যবহার! রবার্ট লুই স্টিভেনসনের গল্পের বাস্তবতা ভার্চুয়াল জগতটা এখন সম্ভব করে দিয়েছে। যদিও এখানে সরাসরি দৈহিক ভাবে যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু ছায়াময়তার মাঝে নিজের অনুভূতির পুরোটুকুই ব্যবহার করা যায়। কারণ এখানে ব্যবহৃত অংশটি আপনার কিংবা আমার একান্তই নিজস্ব চেতনার বাস্তব জীবন্ত অংশ, যেটুকু পরম যত্নে আমরা আগলে রাখি নিজেদের মস্তিষ্কের গোপনীয় এক কুঠুরীতে! 

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

নভেম্বর, ২০২০ খ্রিঃ

"পার্থিব ঋণ"

 "পার্থিব ঋণ"

...আষাঢ়ের বিমর্ষ এক আংশিক মেঘলা দুপুর, মেঘের ফাঁক গলে জ্বলন্ত সূর্যের গনগনে উত্তাপ এসে জেঁকে বসেছে চারপাশে। প্রবল জ্বরে ভোগা রোগীর চোখের মত হলদে অসুস্থতায় ছেয়ে আছে সমস্তটা পৃথিবী। পশুপাখি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক; ক্ষণে ক্ষণে করুণ বিলাপে ডেকে উঠে জানান দিচ্ছে এক বুক অব্যক্ত হতাশা। মানুষের ক্ষুধার্ত মুখে লেগে আছে গভীর অবসাদ, চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে মৃত্যুর বিভীষিকা!

এটা কোন 'হরর ফিকশন' এর ট্রায়াল কিংবা প্রাগৈতিহাসিক কালের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সভ্যতার দূর্ভাগ্যজনক পরিনতির বর্ণনা নয়, এটা একুশ শতকের আধুনিকতার চাকচিক্যে মোড়া বর্তমান সময়ের নির্মম বাস্তব একটি চিত্র। এটা চরম ভাবে উচ্ছন্নে যাওয়া এক মানব গোষ্ঠীর প্রতি প্রকৃতির কঠোর প্রতিশোধের একটি দুঃখময় গাঁথা।

বহুকাল আগের কথা, সেই পৃথিবীর প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রখর সৌর বিকীরন থেকে পৃথিবীর উপরিভাগের পরিবেশ কে রক্ষার জন্য প্রকৃতি এক অভেদ্য দেয়াল তুলে রেখেছিল পৃথিবীর চারপাশে, যা ওজোনস্তর নামে পরিচিত। এই স্তর'টি একটি অদৃশ্য ছাঁকনির মত জায়গা, অর্থাৎ সূর্য থেকে আগত অধিকাংশ ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমুহ এখানে এসে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং শুধুমাত্র উত্তাপ, আলো আর প্রয়োজনীয় রশ্মি; যা বায়ুমন্ডলের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সক্ষম, কেবল মাত্র সেটুকুই এই শক্তিশালী অদৃশ্য ছাঁকনি থেকে পরিশোধনের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করে। এই অনুকূল পরিবেশ তখন ধীরে ধীরে পৃথিবীতে প্রাণ সঞ্চারের ক্ষেত্র প্রস্তত করেছিল। পৃথিবীর কোমল মাটির বুক চিরে, উষ্ণ সূর্য কিরণ গায়ে মেখে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল সবুজ বৃক্ষরাজি। নানান জাতের উদ্ভিদ আর লতাগুল্মে পৃথিবী হয়ে উঠেছিল শ্যামল, সুন্দর। বর্ষার জলে ভিজে, গাছেদের শান্ত ছায়ায়, বাতাস আর আলোর প্রভাবে এরপর এখানে জন্ম নিল এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব। এই প্রোটোজোয়া পর্বের আদিপ্রাণের পরে এক এক করে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বহুকোষী বৃহদাকৃতির প্রাণী থেকে শুরু করে অতিক্ষুদ্র ডিএনএ অনুর গঠনে বিভিন্ন পরজীবি। প্রকৃতি তখন সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা!

মাটির গর্ত থেকে বৃক্ষের কোটর পর্যন্ত গিজগিজ করতে থাকল অসংখ্য কীট, নদ-নদী আর সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াল শতকোটিগুণ জলজপ্রাণী, জলে স্থলে একই সঙ্গে বিচরণ করল উভচরকূল, ডানা প্রসারিত করে আকাশে উড়ল অনেক খেচর, ঘন জঙ্গলে চরে বেড়াতে লাগল অসংখ্য তৃণভোজী আর মাংসাশী চতুষ্পদ, বুকে ভর করে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হেঁটে চলল কত বর্ণের সরীসৃপ। এভাবেই কেটে গেল কত মহাযুগ। আর এরপরেই কূলের কলঙ্ক হয়ে, সমগ্র প্রাণীকূল কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পৃথিবীতে পদার্পণ করল স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ প্রাণী 'হোমোস্যাপিয়েন্স' বা মানুষ।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা পৃথিবীতে এসেই পৃথিবীর যাবতীয় ঋণকে অস্বীকার করা শুরু করে দিল। নিজের অবস্থান কে শক্তপোক্ত করার জন্য নির্বিচারে নিধন করল অজস্র সংখ্যক প্রাণী, ফসল উৎপাদনের স্বার্থে কীটনাশক ছিটিয়ে মেরে ফেলল অগনিত উপকারী কীট, যারাই কিনা বাস্তুসংস্থানে বড় ভুমিকা পালন করে এবং পরাগায়নের মাধ্যমে অসংখ্য উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে সাহায্য করে। অতঃপর, এই অকৃতজ্ঞ মানুষেরা কারণে বা অকারণে বৃক্ষ নিধনে মেতে উঠল। যে বৃক্ষরাজি পৃথিবীর সমগ্র প্রাণীকূল কে যুগের পর যুগ ধরে যুগিয়ে যাচ্ছে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের অক্সিজেন, যে বৃক্ষ তাদের রক্ষা করে যাচ্ছে প্রচন্ড সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে, সেইসব গাছপালা কেটে ইটের ভাটায় পুড়িয়ে একদিকে যেমন মাটির স্তর'কে ক্ষয় করল; অপরদিকে বিষাক্ত গ্যাস আর ধোঁয়ায় দূষিত করতে লাগল বায়ুমন্ডল। প্রতিনিয়ত কল কারখানা থেকে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ বের করে তারা মিলিয়ে দিল বিশুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে, স্বাচ্ছন্দ জীবন যাপনের জন্য পেট্রোলিয়ামের বহুল ব্যাবহার করে সৃষ্টি করল দূষিত কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস, বানিজ্যিক ভাবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য গ্রীনহাউস তৈরির মাধ্যমে সৃষ্টি করল ক্লোরোফ্লুরো কার্বন। এই বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ভেঙ্গে যেতে শুরু করল ওজোনস্তরের দূর্ভেদ্য দেয়াল, যার মাধ্যমে সূর্যের বিকিরিত ক্ষতিকর রশ্মি ঢুকতে শুরু করল বায়ুমন্ডলে। এখানেই শেষ নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ, নানাবিধ উদ্ভিদ আর প্রাণীদের ধ্বংসের পর এই শ্রেষ্ঠ জীব'টি এরপর মেতে উঠল স্বগোত্রের বিনাশ সাধনে। নিজেদের মধ্যে বিলিয়ে দিল ভয়ংকর ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য, নিজেদের খাবারে নিত্যদিনই মিশিয়ে দিতে থাকল ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। আর সর্বশেষ প্রস্তুতি হিসাবে তৈরি করল ভয়ংকর বিধ্বংসী পারমাণবিক মারণাস্ত্র, যার আঘাতে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল পৃথিবীর উপরিভাগের সমস্ত জীবজগত। কিন্তু অঢেল জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তারা একটি বিষয় বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল, তা হলঃ প্রকৃতি কখনও অনিয়ম সহ্য করেনা। তাই মানবকূল যখন অনিয়মের শেষ ধাপে গিয়ে পা রাখতে চাইল, তখনই প্রকৃতি তার সংহারী রূপ ধারণ করে খড়গহস্ত হয়ে নেমে এল এই অকৃতজ্ঞ কূলান্তকের নিধনে। অদৃশ্য একটি জীব 'ভাইরাস' কে লেলিয়ে দেয়া হল মনুষ্য সংহারে। যাতে করে পৃথিবী যাবতীয় ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে, অন্যান্য প্রানীরাও বেঁচে যাবে, মাঝখান থেকে 'মানুষ' নামক এই অমানবিক নিষ্ঠুর প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। খুবই চমৎকার এক প্রাকৃতিক সমাধান! বহুকাল ধরে পৃথিবী যে অপার মমতায় বুকে করে আগলে রেখেছিল সমস্ত জীবজগত কে, সেই ঋণের দ্বায় তো অবশ্যই একদিন শোধ করতে হত। কারণ সব ঋণই শোধবোধ করতে হয় একদিন। 

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

১ জুলাই, ২০২০ খ্রিঃ

টানের অসমাপ্ত রহস্য

 "টানের অসমাপ্ত রহস্য"


....এমন একটা সময় ছিলো যখন খুব করে ভাবতাম- জীবনের অর্থ আর এর উদ্দেশ্য নিয়ে, স্বপ্ন দেখতাম একটি বদলে যাওয়া সমাজের জন্য। আর এখন, জানিনা ঠিক কেন, এখন কোন স্বপ্ন টপ্ন দেখতে ইচ্ছে করেনা। বর্তমানে অধিকাংশ সময় ধরে অদ্ভুত একটি বিষয় নিয়ে খুব গভীর ভাবে চিন্তা ভাবনা করি। বলা বাহুল্য ভাবনার বিষয়টি খানিকটা ছেলেমানুষী; তবে এটা যে মোটেই হেলাফেলা করার বিষয় না এটুকু সত্যি। বিষয়টি হলো একধরণের আকর্ষণ কিংবা সহজ কথায় বলতে গেলে 'টান'! আচ্ছা, এই টানের উৎস কোথায়? যে টানে অথর্বের মত আটকে পড়ে আছি চার দেয়ালের এক আবদ্ধ কুঠুরিতে! যে টানের কাছে জীবন মৃত্যুকে মুহূর্তেই তুচ্ছ জ্ঞান করি, যে টানের আবর্তে শত সহস্র সংঘাত মোকাবিলা করেও বেঁচে থাকে মানুষ, বেঁচে থাকে সমস্ত প্রাণীকুল। আচ্ছা, একটু বরং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে গিয়ে দেখি তারা কি বলেন-

মডার্ন থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স বলেঃ পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ হল পরমাণু। আর পরমাণু কে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তার ঠিক মাঝখানে রয়েছে নিউক্লিয়াস, আর নিউক্লিয়াসের চারপাশে অনবরত ঘুরে চলছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। এই অদ্ভুত পদ্ধতিটার নাম- থার্মোনিউক্লিয়ার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া অনুযায়ী ঠিক যেভাবে নিউক্লিয়াস কে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন, সেই একই রকম পদ্ধতিতে আমাদের সৌরজগতে সূর্য ও ঠিক নিউক্লিয়াসের ভূমিকায় থেকে তার চারপাশের গ্রহ আর উপগ্রহ গুলোকে টেনে রেখেছে গ্র্যাভিটি নামক এক অদৃশ্য টানে। আবার এই গ্র্যাভিটির টানেই এই পৃথিবীর উপরিভাগে বসবাস রত প্রানীকুল আটকে রয়েছে পৃথিবীর বুকে। যদি সমগ্র ইউনিভার্স সম্পর্কে বলা যায়- সেখানেও দেখা যাবে অদৃশ্য টানে প্রতিটি গ্যালাক্সি পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ না ঘটিয়েই সুষম ভাবে পাশাপাশি অবস্থান করছে। অনেকটা একটি মা মুরগীকে ঘিরে ছানারা যেভাবে বিচরণ করে, ঠিক তেমনই। আমাদের পৃথিবীর উপরিভাগে ওজোনস্তরের বাইরে যে নিকষ কালো বায়ুহীন মহাশূন্য রয়েছে, তার চেয়েও দূরে যেসব স্পেস, সেখানে ওৎ পেতে রয়েছে অসংখ্য ব্লাকহোল(কৃষ্ণ-গহবর), যারাও প্রতিক্ষণে নীরবে-নিভৃতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কত শত উজ্জ্বল নক্ষত্রকে তার অন্ধপূরীর মাঝে। তবে কোথায় নেই এই টান!

আচ্ছা, যদি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কথা বলা হয়- তবে তিনিও তো টেনে রেখেছেন তাঁর সমগ্র সৃষ্টি কে একান্ত  নিজের চারপাশে। সার্বিক ভাবে দেখা যায়ঃ মানুষ যে বাস্তবিক জীবনে বেঁচে থাকতে চায়, সেই বেঁচে থাকাটুকুও কিন্তু নানামুখী টানের জন্যে। কেউ অর্থের টানে, কেউ সামাজিক প্রতিষ্ঠা কিংবা খ্যাতি অর্জন করার টানে, কেউ মানব কল্যাণের টানে, কেউ দ্বায়িত্ব বোধের টানে, আর কেউ কেউ তো স্রেফ জীবনটাকে চমৎকার ভাবে উপভোগ করার টানে। আমি আর কিছু ভেবে কোন কূল পাইনা, এই টানের শেষ কোথায়?

তবে কি মৃত্যুই এই যাবতীয় টানের পরিসমাপ্তি নিয়ে আসে? নিশ্চয়ই না, কারণ ঐ মৃত ব্যক্তির প্রতিও তার আপন মানুষেরা টান অনুভব করে। তাই সবকিছুর শেষে সার্বিক দৃষ্টিতে আমার মাথায় যেটা আসে তা হলোঃ 'জীবনের সব উদ্দেশ্যই নিহিত আছে একটা রহস্যময় টানের মাঝে', যে টানের কোন সমাপ্তি নেই! 

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

"নারীবাদ- জিন্দাবাদ"

 "নারীবাদ- জিন্দাবাদ!"


 শুধুমাত্র "নারীর ক্ষমতায়ন" কথা'টি বলে বলে চায়ের কাপে ধোঁয়া তুলে আর অসংখ্য সভা, সেমিনারে হাত-পা ছুড়ে চিৎকার করে গলা ফাটালে অদৌ কিছুই হবেনা। প্রথমে দেখতে হবে, "নারীর ক্ষমতায়ন" বিষয়ে একজন নারী নিজে কতটুকু সচেতন! ছোটবেলা থেকে একটি কথা শুনে শুনে মাথাটা ধরে গেছে, তা হলোঃ পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারী চীরকাল অবহেলিতা আর নির্যাতিতা। আচ্ছা, একটি বার একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখা যাক, এই ধারাবাহিকতায় একজন পুরুষ আসলে ঠিক কতটা দ্বায়ী!

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে (এখানে আমি শুধুমাত্র আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের কথা বলছি, এরমাঝে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমাজ ব্যবস্থার কথা ভেবে ভুল করবেন না।) আমাদের দেশের ৯৫ শতাংশ গর্ভবতী নারী'ই একটি পুত্র সন্তান জন্ম দেবার কথা কল্পনা করে। এই ভাবনা তার মনে এমনিতেই যে জন্ম নেয় তা কিন্তু না। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য সুনির্দিষ্ট কারণ। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবারের কর্তা অর্থাৎ একজন পুরুষ কিংবা একজন বাবা সারাক্ষণই ব্যাস্ত থাকে উপার্জনের মাধ্যম তথা চাকুরী, ব্যাবসা অথবা অন্য কোন পেশায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একজন নারী কিংবা মা সংসারের যাবতীয় রক্ষনাবেক্ষনের দিকে লক্ষ্য রাখে। এই মা তার গর্ভের দুটি সন্তান অর্থাৎ একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের মাঝে ছেলেটির ব্যাপারে সর্বদাই একটু বেশি সহানুভূতিশীল হয়, মেয়েটির ব্যাপারে একটু সুক্ষ্ণ অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। কারণটা কিন্তু খুবই সহজ, একজন মা জানে যে- তার মেয়েটি হল টেম্পোরারি বা ক্ষণস্থায়ী। কারণ বিয়ের পরই সে অন্য কোন সংসারে গিয়ে স্থায়ী হবে। অথচ তার ছেলেটি থেকে যাবে তার নিজের কাছে, যে তার বৃদ্ধ বয়সে তার দেখভাল করবে। অর্থাৎ সহজেই একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়, সমাজ তো অনেক বড় বিষয় কিন্তু একজন নারী প্রাথমিক অবহেলার শিকার হয় শৈশবে, পরিবার থেকে। তাও আবার কিনা তার মা অর্থাৎ অন্য একজন নারীর কাছ থেকেই। এখানে তাহলে পুরুষ শাসিত পরিবারের দোষটা কোথায়?

একটি বিষয় হয়তো অনেকেই পরিষ্কার ভাবে জানেন না, কিংবা অনেকেই আছেন যারা বিষয়টি জানা সত্ত্বেও ভুল তর্ক উপস্থাপন করে জট বাঁধিয়ে দেবার স্বার্থে অস্বীকার করেন। বিষয়টি সবার জ্ঞাতার্থে একটু সংক্ষেপে আলোচনা করছিঃ


প্রথমতঃ পৃথিবীতে স্বতন্ত্র একটি প্রানী হিসাবে জন্মগ্রহনের পর থেকেই একজন পুরুষ স্বাভাবিক ভাবেই একজন নারীর থেকে শারীরিক ভাবে শক্তিশালী, শক্ত-সমর্থ আর আকৃতিতে বড় হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে একজন নারী শারীরিক ভাবে নরম, কোমল আর নাজুক প্রকৃতির হয়ে থাকে, যেটা কার্যক্ষেত্রে তাদের উভয়ের আচরনে ব্যাপক ভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতিগত ভাবে একজন পুরুষের মাঝে থাকে হিংস্রতা, প্রতিযোগী মনোভাব আর সহজাত নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা। অপর দিকে একজন নারীর মাঝে থাকে মমত্ববোধ, ধৈর্য্য, সন্তান কিংবা অন্যদের প্রতি সেবামুলক মনোভাব আর সহানুভূতি। সুতরাং একে অপরের সাথে প্রতিযোগীতার দৌড়ে একজন নারী সব সময়ই একজন পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে থাকে।

দ্বিতীয়তঃ শারীরিক ক্ষমতার পর আসা যাক মানসিক ক্ষমতার বিষয়ে। পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে একটি বিষয় নিশ্চিত করেছেন যে, একজন পুরুষের মস্তিষ্ক স্বাভাবিক ভাবেই একজন নারীর চেয়ে আকৃতিতে বড় হয়ে থাকে। পুরুষের করোটি অর্থাৎ মাথার খুলিতে যে পরিমান নিউরোন এবং সিন্যাপ্স থাকে, নারীর খুলিতে তার চেয়ে কম পরিমানে থাকে। যার দৌলতে একজন পুরুষ সব সময় একজন নারীর চেয়ে বেশি চিন্তাশীল হয়ে থাকে। এছাড়া পুরুষের মাঝে থাকে আত্মত্যাগ বা ছাড় দেবার মানসিকতা, যা নারীর মাঝে সত্যিই অনুপস্থিত। পুরুষ হয়ে থাকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর সাহসী, অপরদিকে নারীরা হয়ে থাকে ভীত-সন্ত্রস্ত আর হিংসুটে প্রকৃতির। অতএব, পুরুষ আর নারীর মাঝে এইসব ভেদাভেদ কিন্তু পুরুষ শাসিত সমাজ তৈরি করেনি। এই ভেদাভেদ যদি কেউ সৃষ্টি করেই থাকে তবে সে আর কেউ না, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর স্বয়ং। যিনি এই পৃথিবীতে অন্যান্য প্রানীর সাথে “হোমোস্যাপিয়েন্স” অর্থাৎ কিনা মানব সম্প্রদায় সৃষ্টি করেছেন।


নারীর সৌন্দর্য্য চর্চাঃ

প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজকের এই আধুনিক সময় পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবীব্যাপী একটি বিষয় প্রচলিত। তা হল নারীর সৌন্দর্য্য চর্চা। এটা কিন্তু এমনি এমনি আসেনি, নারীরা একটি বিষয় খুব ভাল ভাবে অনুধাবন করে যে, তারা শারীরিক ভাবে পুরুষের তুলনায় অসুন্দর। তাই তারা বরাবরই সৌন্দর্য্য চর্চা নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। এই প্রকৃতিতে এটা ব্যাপক ভাবেই প্রমানিত। আচ্ছা, আসুন- একটু প্রমান দিই। প্রথমেই বলি একটি রাজকীয় প্রানীর কথা। তার নাম সিংহ, সিংহের মুল সৌন্দর্য্য হল তার ঘাড়ের লম্বা কেশর। মজার বিষয় হল কেশর শুধুমাত্র পুরুষ সিংহের থাকে। সিংহীর ঘাড়ে কোন কেশর নেই। আচ্ছা, ময়ূর কেন সুন্দর? ময়ূর সুন্দর তার রঙ্গিন বর্ণিল পেখমের জন্যে। আর পেখম হয়ে থাকে শুধুই পুরুষ ময়ূরের, নারী ময়ূর বা যাকে বলে ময়ূরী তার কোন পেখম নেই। হরিণের সৌন্দর্য্য হল তার মাথার বিচিত্র আকৃতির শিং এর জন্য। মাথায় বিচিত্র আকৃতির শিং থাকে শুধু পুরুষ হরিণের। স্ত্রী হরিণ তথা হরিণীর মাথায় শিং ওঠেনা। এভাবে এক এক করে সকল প্রানীর দিকে খেয়াল করে দেখুন, তফাৎ সহজেই চোখে পড়বে। আর এই কারনেই পুরুষ কখনও সৌন্দর্য্য নিয়ে মাথা ঘামায় না। কারন সে জানে, সে এমনিতেই সুন্দর।


নারীর ব্যাপক ক্ষমতাঃ

এখানে কয়েকটি ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনা তুলে ধরছি, যাতে নারীর ক্ষমতা ব্যাপক ভাবে প্রকাশ পায়।

(১) প্রাচীন মিশরীয় সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রার নির্বুদ্ধিতার জন্যে বিখ্যাত যোদ্ধা- জেনারেল মার্ক এ্যান্টনি মৃত্যু বরণ করেন, এই সম্রাজ্ঞীর কারণেই সম্রাট জুলিয়াস সিজার কয়েক বছর সুষ্ঠু ভাবে রাজ্য পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছিলেন।

(২) স্পার্টার কুইন হেলেনের জন্যে সৌন্দর্য্য মন্ডিত ট্রয় নগরী পুড়ে ছারখার হয়েছিল।

(৩) ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জের ছেলে- রাজপুত্র এ্যাডওয়ার্ড একজন মার্কিন নারী “মিসেস সিম্পসন” এর প্রেমের কারনে রাজত্ব ত্যাগ করেছিলেন।

(৪) ব্রিটেনের কুইন ভিক্টোরিয়ার শাসনামলেই ব্রিটিশরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অধিকৃত সাম্রাজ্যগুলো হারায়।

(৫) ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপক ভাবে আলোচিত ঘটনা ছিল- মহানবী হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর দৌহিত্র, খলিফা হযরত আলী (রাঃ) এর পুত্র অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারী ইমাম হাসান (রাঃ) তাঁর স্ত্রী জায়েদা কর্তৃক বিষ প্রদানে নিহত হয়েছিলেন।

অতএব, এত এত আলোচনার দ্বারা আমি কিন্তু নারীকে অপমান কিংবা ছোট করার চেষ্টা করছিনা। কারণ নারীদের সাথে আমার ব্যক্তিগত কোন বিরোধ নেই। এখানে যা কিছু লিখেছি, সবই প্রমানিত সত্য। তাই বলছি- এত বোকার মত চিৎকার, হৈ-চৈ করার কোন মানেই হয়না। তারচেয়ে যেটা সত্য, যেটা শাশ্বত, সেটা মেনে নেয়াই বরং বুদ্ধিমান কিংবা বুদ্ধিমতীর কাজ।


(সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই লেখাটি মোটেই কোন গবেষনাধর্মী আর্টিকেল নয়, এটি নিশ্চিত ভাবেই একটি রম্যরচনা।)

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...