"পার্থিব ঋণ"
...আষাঢ়ের বিমর্ষ এক আংশিক মেঘলা দুপুর, মেঘের ফাঁক গলে জ্বলন্ত সূর্যের গনগনে উত্তাপ এসে জেঁকে বসেছে চারপাশে। প্রবল জ্বরে ভোগা রোগীর চোখের মত হলদে অসুস্থতায় ছেয়ে আছে সমস্তটা পৃথিবী। পশুপাখি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক; ক্ষণে ক্ষণে করুণ বিলাপে ডেকে উঠে জানান দিচ্ছে এক বুক অব্যক্ত হতাশা। মানুষের ক্ষুধার্ত মুখে লেগে আছে গভীর অবসাদ, চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে মৃত্যুর বিভীষিকা!
এটা কোন 'হরর ফিকশন' এর ট্রায়াল কিংবা প্রাগৈতিহাসিক কালের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা সভ্যতার দূর্ভাগ্যজনক পরিনতির বর্ণনা নয়, এটা একুশ শতকের আধুনিকতার চাকচিক্যে মোড়া বর্তমান সময়ের নির্মম বাস্তব একটি চিত্র। এটা চরম ভাবে উচ্ছন্নে যাওয়া এক মানব গোষ্ঠীর প্রতি প্রকৃতির কঠোর প্রতিশোধের একটি দুঃখময় গাঁথা।
বহুকাল আগের কথা, সেই পৃথিবীর প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রখর সৌর বিকীরন থেকে পৃথিবীর উপরিভাগের পরিবেশ কে রক্ষার জন্য প্রকৃতি এক অভেদ্য দেয়াল তুলে রেখেছিল পৃথিবীর চারপাশে, যা ওজোনস্তর নামে পরিচিত। এই স্তর'টি একটি অদৃশ্য ছাঁকনির মত জায়গা, অর্থাৎ সূর্য থেকে আগত অধিকাংশ ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমুহ এখানে এসে বাঁধাপ্রাপ্ত হয় এবং শুধুমাত্র উত্তাপ, আলো আর প্রয়োজনীয় রশ্মি; যা বায়ুমন্ডলের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে সক্ষম, কেবল মাত্র সেটুকুই এই শক্তিশালী অদৃশ্য ছাঁকনি থেকে পরিশোধনের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশ করে। এই অনুকূল পরিবেশ তখন ধীরে ধীরে পৃথিবীতে প্রাণ সঞ্চারের ক্ষেত্র প্রস্তত করেছিল। পৃথিবীর কোমল মাটির বুক চিরে, উষ্ণ সূর্য কিরণ গায়ে মেখে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল সবুজ বৃক্ষরাজি। নানান জাতের উদ্ভিদ আর লতাগুল্মে পৃথিবী হয়ে উঠেছিল শ্যামল, সুন্দর। বর্ষার জলে ভিজে, গাছেদের শান্ত ছায়ায়, বাতাস আর আলোর প্রভাবে এরপর এখানে জন্ম নিল এককোষী আণুবীক্ষণিক জীব। এই প্রোটোজোয়া পর্বের আদিপ্রাণের পরে এক এক করে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের বহুকোষী বৃহদাকৃতির প্রাণী থেকে শুরু করে অতিক্ষুদ্র ডিএনএ অনুর গঠনে বিভিন্ন পরজীবি। প্রকৃতি তখন সৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা!
মাটির গর্ত থেকে বৃক্ষের কোটর পর্যন্ত গিজগিজ করতে থাকল অসংখ্য কীট, নদ-নদী আর সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াল শতকোটিগুণ জলজপ্রাণী, জলে স্থলে একই সঙ্গে বিচরণ করল উভচরকূল, ডানা প্রসারিত করে আকাশে উড়ল অনেক খেচর, ঘন জঙ্গলে চরে বেড়াতে লাগল অসংখ্য তৃণভোজী আর মাংসাশী চতুষ্পদ, বুকে ভর করে চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হেঁটে চলল কত বর্ণের সরীসৃপ। এভাবেই কেটে গেল কত মহাযুগ। আর এরপরেই কূলের কলঙ্ক হয়ে, সমগ্র প্রাণীকূল কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পৃথিবীতে পদার্পণ করল স্বঘোষিত শ্রেষ্ঠ প্রাণী 'হোমোস্যাপিয়েন্স' বা মানুষ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তারা পৃথিবীতে এসেই পৃথিবীর যাবতীয় ঋণকে অস্বীকার করা শুরু করে দিল। নিজের অবস্থান কে শক্তপোক্ত করার জন্য নির্বিচারে নিধন করল অজস্র সংখ্যক প্রাণী, ফসল উৎপাদনের স্বার্থে কীটনাশক ছিটিয়ে মেরে ফেলল অগনিত উপকারী কীট, যারাই কিনা বাস্তুসংস্থানে বড় ভুমিকা পালন করে এবং পরাগায়নের মাধ্যমে অসংখ্য উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে সাহায্য করে। অতঃপর, এই অকৃতজ্ঞ মানুষেরা কারণে বা অকারণে বৃক্ষ নিধনে মেতে উঠল। যে বৃক্ষরাজি পৃথিবীর সমগ্র প্রাণীকূল কে যুগের পর যুগ ধরে যুগিয়ে যাচ্ছে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের অক্সিজেন, যে বৃক্ষ তাদের রক্ষা করে যাচ্ছে প্রচন্ড সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে, সেইসব গাছপালা কেটে ইটের ভাটায় পুড়িয়ে একদিকে যেমন মাটির স্তর'কে ক্ষয় করল; অপরদিকে বিষাক্ত গ্যাস আর ধোঁয়ায় দূষিত করতে লাগল বায়ুমন্ডল। প্রতিনিয়ত কল কারখানা থেকে বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ বের করে তারা মিলিয়ে দিল বিশুদ্ধ পরিবেশের মধ্যে, স্বাচ্ছন্দ জীবন যাপনের জন্য পেট্রোলিয়ামের বহুল ব্যাবহার করে সৃষ্টি করল দূষিত কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস, বানিজ্যিক ভাবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য গ্রীনহাউস তৈরির মাধ্যমে সৃষ্টি করল ক্লোরোফ্লুরো কার্বন। এই বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ভেঙ্গে যেতে শুরু করল ওজোনস্তরের দূর্ভেদ্য দেয়াল, যার মাধ্যমে সূর্যের বিকিরিত ক্ষতিকর রশ্মি ঢুকতে শুরু করল বায়ুমন্ডলে। এখানেই শেষ নয়, প্রাকৃতিক পরিবেশ, নানাবিধ উদ্ভিদ আর প্রাণীদের ধ্বংসের পর এই শ্রেষ্ঠ জীব'টি এরপর মেতে উঠল স্বগোত্রের বিনাশ সাধনে। নিজেদের মধ্যে বিলিয়ে দিল ভয়ংকর ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য, নিজেদের খাবারে নিত্যদিনই মিশিয়ে দিতে থাকল ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। আর সর্বশেষ প্রস্তুতি হিসাবে তৈরি করল ভয়ংকর বিধ্বংসী পারমাণবিক মারণাস্ত্র, যার আঘাতে তারা নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল পৃথিবীর উপরিভাগের সমস্ত জীবজগত। কিন্তু অঢেল জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তারা একটি বিষয় বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিল, তা হলঃ প্রকৃতি কখনও অনিয়ম সহ্য করেনা। তাই মানবকূল যখন অনিয়মের শেষ ধাপে গিয়ে পা রাখতে চাইল, তখনই প্রকৃতি তার সংহারী রূপ ধারণ করে খড়গহস্ত হয়ে নেমে এল এই অকৃতজ্ঞ কূলান্তকের নিধনে। অদৃশ্য একটি জীব 'ভাইরাস' কে লেলিয়ে দেয়া হল মনুষ্য সংহারে। যাতে করে পৃথিবী যাবতীয় ক্ষতি থেকে রেহাই পাবে, অন্যান্য প্রানীরাও বেঁচে যাবে, মাঝখান থেকে 'মানুষ' নামক এই অমানবিক নিষ্ঠুর প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। খুবই চমৎকার এক প্রাকৃতিক সমাধান! বহুকাল ধরে পৃথিবী যে অপার মমতায় বুকে করে আগলে রেখেছিল সমস্ত জীবজগত কে, সেই ঋণের দ্বায় তো অবশ্যই একদিন শোধ করতে হত। কারণ সব ঋণই শোধবোধ করতে হয় একদিন।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১ জুলাই, ২০২০ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন