একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে আজ সামান্য আলোচনা করতে চাই। বলতে গেলে তা প্রায় আড়াইশো বছর ধরে একটি ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে পাকাপোক্ত ভাবে সেট হয়ে গেছে যে— জ্ঞানার্জন করার আসল উদ্দেশ্যই হলো টু-পাইস কামানো। খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মধ্যে এই বিষয়টি এমন গভীর ভাবে ঢুকে গেছে যে, তারা এটার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি আজও। আমাদের উপমহাদেশে ব্যপকভাবে এই ধারণাটির বিস্তৃতি ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে। তখনকার দিনে তথাকথিত 'শিক্ষিত' সমাজ থেকে বাল্যশিক্ষার বইয়ে একটি বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে— 'লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।' তৎকালীন সময়ের কোমলমতি শিশুরা এই বাক্য মনস্তাত্ত্বিক ভাবে গ্রহণ করে বড় হয়েছিল। তারাও একটা সময়ে গিয়ে তাদের সন্তানদের মধ্যে এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং বংশপরম্পরায় এই ধারণাটি এতটাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, এখনকার দিনে বইপত্র পড়া কিংবা জ্ঞানার্জনের পেছনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে অর্থোপার্জন সংশ্লিষ্ট বিষয়।
আমি বাগেরহাট শহরের একজন রিক্সাচালক ভদ্রলোক কে চিনি, যিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর সংসারের নানান অভাব অনটনের কারণে তিনি আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি তার পেশাগত জীবনে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই ভদ্রলোকের একটি চমৎকার অভ্যাস আছে। তিনি গল্প-উপন্যাস পড়তে ভীষণ পছন্দ করেন। কয়েকদিন আগে তার রিক্সায় যেতে যেতে তিনি আমার সাথে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি সায়েন্স ফিকশন নিয়ে আলোচনা করলেন। একটা পর্যায়ে আমি তাকে এক কাপ চা অফার করলে তিনি সম্মত হলেন। রিক্সাটি ভৈরব নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা দু'জন একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম। এরপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি আমাকে কয়েকটি কথা বললেন, কথাগুলো বলার একপর্যায়ে তীব্র অভিমানে তার চোখে জল এসে গেল। তার কথার সারমর্ম ছিল এরকম— তার গল্পের বই পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। বই পড়ার জন্য তিনি কয়েকদিন গণগ্রন্থাগারে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে গেলে মানুষ তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। তাই তিনি তার কষ্টার্জিত টাকা থেকে মাঝেমধ্যে দুই-একটি বই কিনে পড়েন। এটা নিয়েও চারপাশের 'শিক্ষিত' সমাজের লোকজন তাকে খুবই উপহাস করে। নানান ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা তাকে হজম করতে হয় শুধুমাত্র বইপড়ার অপরাধে।
আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে যতটুকু বুঝি— শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জন। আর জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষের ভেতরকার মূল্যবোধের বিকাশ কিংবা তার চেতনাগত উন্নয়ন। নিজের অন্তর্নিহিত বোধের পরিধির বিস্তৃতিই যদি না ঘটে, সেক্ষেত্রে এতো এতো লেখাপড়া করে এবং অনেক গুলো ডিগ্রী নিয়ে আদৌ লাভ টা কোথায়? সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের একটা পিএইচডি ডিগ্রী আছে, অথচ তিনি বিরাট বড় চোর। তাহলে এই ডক্টরেট ডিগ্রীর কতটুকু মূল্য থাকলো, যেখানে তার আত্মিক উন্নয়ন হয়নি, যেখানে তার মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ হয়নি! আজকাল চারপাশে এরকম অসংখ্য অসংখ্য নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত 'উচ্চ শিক্ষিত' লোকজন দেখা যাচ্ছে। এসবের দায় কার জানেন? সেই পুরনো ভুল শিক্ষাব্যবস্থার। যে পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় তাকে শেখানো হয়েছে— লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্যই গাড়িঘোড়ায় চড়ে বিলাসবহুল জীবন কাটানো। আজকাল অনেক অভিভাবকদের দেখা যায় তাদের কোমলপ্রাণ শিশুটির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো একগাদা বইপত্র চাপিয়ে দিতে। তারা তাদের সন্তানের সাকসেস দেখার জন্য এতটাই বেশি মোহগ্রস্ত হয়ে যান যে, তাদের শিশুটি ঐ বোঝার ভার বহন করতে গিয়ে একটা সময় সমাজের তাবত মানুষের কাছে নিজেকে একজন ভুল মানুষ হিসেবে প্রমাণ করে। আজকাল চারপাশে শুধু ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিক্ষা কিংবা প্রকৃত জ্ঞান তাদের মধ্যে মূল্যবোধের জন্ম দিতে পারেনি।
আমি প্রচুর পরিমাণ বইপত্র পড়ি। এটা নিয়ে আমাকেও অসংখ্য বার অনেকের কাছে কটুকথা শুনতে হয়েছে। তাদের কথা হলো— এই যে আপনি এতো এতো বইপত্র পড়লেন, অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করলেন, অনেক তথ্য জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করলেন, কিন্তু আখেরে গিয়ে আপনি কি পেলেন? আপনার তো টাকাপয়সা নেই। এতো জ্ঞান দিয়ে হবে টা কি, যদি অর্থনৈতিক উন্নতি না করা যায়? আমি তাদের সহজ একটি বিষয় আজও বোঝাতে পারলাম না যে, অর্থনৈতিক উন্নতি করার জন্য আমি বইপত্র পড়ি না। এটা একটা আত্মিক ভালোলাগার জায়গা। আপনি যেমন দশ লাখ টাকা সঞ্চয় করে একধরণের আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, আমিও তেমনি কয়েকটি বই পড়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করি। সবকিছুই টাকাপয়সার সাথে সম্পর্কিত নয়। আপনি এভাবে চিন্তা করুণ— এক প্লেট কাচ্চি-বিরিয়ানি খেয়ে আপনি আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, আপনি চমৎকার একটি মুভি দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন কিংবা আপনার প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। এগুলো যেভাবে আপনার মনের খোরাক জোগায়, ঠিক সেভাবেই আমি নতুন একটি বই পড়ে মানসিক ভাবে তৃপ্তি লাভ করি। এরসাথে টাকাপয়সা উপার্জন করা কিংবা অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বইপড়ার সাথে বস্তুগত মুলধন প্রাপ্তির যে ভুল থিওরী জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন। আমি এভাবে অনেক অ্যাঙ্গেলে উদাহরণ দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তারা বুঝতে চায় না। তাদের মাথায় 'ভুল শিক্ষা' এমনভাবে ফিক্সড হয়ে গেছে যে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। তাই তারা প্রচুর খেটেখুটে পড়াশোনা করে, এরপর কয়েকটি সার্টিফিকেট অর্জন করে আবারও চাকরির জন্য দৌড়ঝাঁপ করে, সেটা মিটে গেলে টাকার পেছনে দৌড়ায়। বোধশক্তিহীন পশুর মতো দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে যখন সে দেখে— একজন লুঙ্গি পরিহিত রিক্সাচালক নিজের রিক্সায় বসে নিমগ্ন হয়ে একটি বই পড়ছে, এই দৃশ্য তখন তার সামগ্রিক বোধ কে অচল করে দেয়। প্রাচীণ কালের ভুল শিক্ষার সেই বিষ তার সারা শরীরে সঞ্চারিত হয়। সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। নির্দোষ পাঠক রিক্সাওয়ালা কে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে সে তখন মানসিক ভাবে তৃপ্তি লাভ করে।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
০৯.০৭.২০২৪ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন