বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের স্তর টা যেমন থিতু হয়, তেমনি তার বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সুক্ষ্ম হিসাবনিকাশের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। আজকাল আমি জীবনের সেই শাশ্বত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি— যেখানে দাঁড়িয়ে নির্মোহ ভাবে চারপাশের সবকিছু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। ইদানীং খুব বেশি করে প্রাচীণ ইতিহাস এবং তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর লিখিত বইগুলো খুঁজে বের করে পড়ি। ইতিহাসের পাতা উল্টে প্রাচীণ কালের সেইসব দিনগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে আজকাল তীব্র এক ব্যথায় বুকটা ভীষণ টনটন করে ওঠে। কিসের জন্যে মানুষের সাথে মানুষের এতো বিভেদ? পাশাপাশি একই ভূখণ্ডের একই আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষের মধ্যে কেন এতটা বিজাতীয় ক্ষোভ আর ঘৃণা? অনেক চিন্তাভাবনা করেও এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না।
মাত্র আড়াইশো বছর আগেও আমাদের মধ্যে ভীষণ গভীর এক আত্মিক টান, পারস্পরিক সম্প্রীতি আর চমৎকার সৌহার্দ্য বিরাজমান ছিল। সেই ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে আমরা পরস্পরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহামারীর সময়ে আমরা হাতে-হাত রেখে মোকাবিলা করেছিলাম সেইসব প্রতিকূল পরিস্থিতি। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা সহোদর দুই ভাইয়ের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করেছি। প্রতিটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সমস্ত ধর্মীয় উৎসবে মেতে উঠেছি নির্মল আনন্দে। এরপর হঠাৎ করে কী এমন হলো যে, মুহূর্তের ব্যবধানে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম? দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আমাদের ভেতরকার সেই ঐক্যবদ্ধ মানসিকতা, সেই ভ্রাতৃত্ব, সেই দারুণ সম্প্রীতি, পারস্পরিক সেই গভীর আত্মিক টান কিভাবে রাতারাতি নেই হয়ে গেল? আমরা কেউ-ই তো এটা চাইনি।
১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের অধিবেশনে উপস্থাপিত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রবর্তিত দ্বিজাতিতত্ত্বের থিওরী এই উপমহাদেশ জুড়ে প্রধান দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মারাত্মক ভাবে হিংসার জন্ম দিয়েছিল। এই তত্ত্বের প্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা এবং বিহার রাজ্যে ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল। জিন্নাহর খামখেয়ালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হাজার হাজার নির্দোষ হিন্দু এবং মুসলিম জনগণ নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলিম নিজেদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে ছুটে গিয়েছিল আলাদা আলাদা এলাকায়। ভুল থিওরী নিয়ে ১৯৪৭ সাথে জন্ম হয়েছিল 'পাকিস্তান' নামের রাষ্ট্রের। ধর্মের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন এবং ভারতে অসংখ্য মুসলিম ধর্মাবলম্বী লোকজন ঠিকই থেকে গিয়েছিল। জিন্নাহ চেয়েছিলেন শুধুমাত্র তার ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রের সূচনা করবেন। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সেটা আর কখনোই সম্ভব হয়নি, বরং দিন কে দিন পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের গঠন সফল না হলেও ক্ষতি যেটুকু হবার, তা ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। ঐ ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বের কারণে এই উপমহাদেশে দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যে তীব্র বিদ্বেষ এবং পারস্পরিক ঘৃণার সূত্রপাত ঘটেছিল— সেটা বংশপরম্পরায় আজও ভয়াবহ ভাবে চলমান রয়েছে। ১৯৪০ সালে জিন্নাহ যে ঘৃণার বীজ বপন করেছিলেন, তার খেসারত হিসেবে আজও প্রচণ্ড দুঃখে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। দীর্ঘকাল ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শত বিপদে পাশাপাশি চলা একজন মানুষ যখন আজ প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলে— 'মালাউনের বাচ্চার মা'কে....' তখন ভীষণ দুঃখ হয়। কারণ মালাউন একটি কুৎসিত গালি, যা বাংলাদেশে মূলত হিন্দুদের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়। 'মালাউন' শব্দটি আরবী শব্দ "ملعون" থেকে উদ্ভূত— যার অর্থ অভিশপ্ত বা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। অথবা আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভেদের ফলশ্রুতিতে ঘৃণা প্রকাশের এই নোংরা রীতি এখন বহুল-চর্চিত। এখনকার দিনে নিতান্ত তুচ্ছতম কারণে ধর্মীয় পরিচয় কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। অথচ আমরা দীর্ঘকাল ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে, হাতে হাত ধরে অসংখ্য অসংখ্য প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে থেকেছি। আমাদের মধ্যে বিভেদ কিংবা বিভাজন ছিল না। পারস্পরিক সম্প্রীতি আর আত্মিক টান নিয়ে আমরা একটি সময় সুখে-দুঃখে মিলেমিশে ছিলাম। তাই আজ যখন এই বিভেদ আর ঘৃণার সংস্কৃতি কে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখি, তখন খুব দুঃখ হয়। হয়তো জিন্নাহ সাহেবের মতো গুটিকয়েক মানুষ এই ঘৃণার রাজনীতি চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাস্ট মি— আমরা বৃহৎ সংখ্যক মানুষেরা কেউ-ই এটা চাইনি।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
১১.০৭.২০২৪ খ্রিঃ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন