বুধবার, ৩১ জুলাই, ২০২৪

'বিস্মৃতির কথা'

 বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে মানুষের মন থেকে একটু একটু করে অসংখ্য পূর্বের স্মৃতি হারিয়ে যেতে থাকে। হয়তো কয়েক বছর কেটে যাবার পর হঠাৎ করে সামনে এমন কিছু একটা বিষয় এসে যায়, যেটা দেখে বহুকাল আগের কোনো একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। আবার কখনো কখনো স্বপ্নের মধ্যেও বহুকাল আগের কিছু একটা ঘটনা অস্পষ্ট ভাবে দেখা দেয়। উদাহরণ দেই— আজ সারাদিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। দুপুরে প্রবল বৃষ্টির সময়ে আমাদের উঠোন থেকে তীব্রভাবে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সেখান থেকে ছোট ছোট একঝাঁক মাছ সাঁতরে চলেছে। ঠিক তখনই কিভাবে যেন মনে পড়ে গেল খুব ছোটবেলায় বৃষ্টির মধ্যে আমি গামছা দিয়ে উঠোন থেকে সাঁতরে যাওয়া ছোট ছোট মাছ ধরতাম। একবার প্রায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরার সময় একটা জোঁক এসে আমার পায়ে লেগেছিল, এটা দেখেই আমি বিকট চিৎকার করে দৌড়ে ঘরে উঠতে গিয়ে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমার কপালের কাছে খানিকটা জায়গা কেটে গিয়েছিল। ব্যাস, এতটুকুই। এর আগে বা পরের আর কোনো স্মৃতি নেই। অনেক চেষ্টা করেও সেই সময় বা তার কাছাকাছি আর কোনো ঘটনা মনে করতে পারলাম না। অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা মনে আসতে চায়, কিন্তু কিছুতেই সেটা আর গুছিয়ে নিতে পারি না।


সপ্তাহ খানিক আগে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলাম— খুব সম্ভবত মায়ের সঙ্গে আমি মামাবাড়ি যাচ্ছি। একটু ভুল বললাম, আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি যাচ্ছি। মা আমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছেন আর বাবার হাতে ভারী কোনো ব্যাগ। আমার পায়ের জুতোজোড়া খুবই টাইট লাগছিল বলে আমি বায়না করে মায়ের কোল থেকে নেমে পড়লাম। এরপর আমি দৌড়াচ্ছি। বাবা-মা আমাকে থামতে বলছেন, কিন্তু আমি দৌড়ে চলেছি। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একটি স্কুলঘরের সামনে চলে এলাম। স্কুলঘরের মধ্যে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ওটা আসলে কোনো স্কুলঘর না, একটা কালী মন্দির। মন্দিরের ভেতর মানুষজন নেই। চারপাশে অদ্ভুত দর্শন অসংখ্য মূর্তি। আমি ভয়ে জড়সড় হয়ে বাবা-মা কে ডাকছি, কিন্তু তারা আর আমার আশেপাশেই নেই। এই স্বপ্ন দেখার পর গভীর ভাবে চিন্তা করলাম, শৈশবে আমার সাথে কখনো কি এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছিল? চোখ বন্ধ করে আমি ভীষণ মনযোগী হয়ে চিন্তা করলাম। কিছুটা অস্পষ্ট ভাবে কোনো একটা বিষয় মনে আসতে চায়, কিন্তু কিছুতেই সেটা পরিষ্কার ভাবে গুছিয়ে নিতে পারি না।


প্রায় এক মাস আগে বেশ আটঘাট বেঁধে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছিলাম। ভৌতিক ধরনের রহস্যময় একটি গল্প। খুব হিসেব করে গল্পের প্লট নির্ধারণ করে ঝটপট লিখে যাচ্ছি। টানা আটটি পৃষ্ঠা লেখার পর— ওটুকু পড়েই রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর বর্ণনা, এতটা নিখুঁত প্রেজেন্টেশন! তখন আমার চোখে প্রায় জল এসে যাবার যোগাড়। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আট পৃষ্ঠার পর গল্প আর একটা লাইনও এগিয়ে নেওয়া গেল না। এরপর যা-ই লিখি না কেন, কেমন জানি খাপছাড়া মনে হয়। কোনোভাবে আর গুছিয়ে নিতে পারলাম না। প্রাণপণে চেষ্টা করেও আজকাল কিছুই আর গোছানো হচ্ছে না। নাকি শুরু থেকে সবকিছু অগোছালো করেই রেখেছিলাম আমি! অগোছালো জীবন, অগোছালো সময়, অগোছালো চিন্তা আর অগোছালো ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে ক্রমাগত ভাবে বার্ধক্যে ঢোকার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে— ইদানীং কেমন জানি এক অর্থহীন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অনুভূতির মধ্যে হারিয়ে যাই। এরপর সম্বিত ফিরে এলে গভীর ভাবে পুরোটা ভেবে দেখার চেষ্টা করি। সমস্ত ভুলত্রুটি আর যাবতীয় হিসাবনিকাশ একটু একটু করে মেলাবার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সেটা আর গুছিয়ে নিতে পারি না। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

৩০.০৬.২০২৪ খ্রিঃ

'আত্মহননের কারণ নিয়ে আলোচনা'

 প্রায় বছর দশেক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে একটি ডকুমেন্টারি ভিডিও দেখে ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। ভিডিওটির বিষয়বস্তু এরকম যে— একটি তৃণভোজী প্রাণী তৃষ্ণার্ত হয়ে একটি জলাশয়ে নেমে তৃষ্ণা নিবারণের মুহূর্তে একদল ক্ষুধার্ত হায়েনা সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল। হিংস্র হায়েনার থেকে বাঁচার তাগিদে নিরীহ পশুটি জলে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে অন্য পাড়ে গিয়ে যখন পৌঁছালো, ততক্ষণে হায়েনার দল সেখানে পৌঁছে গেছে। পশুটি আবারও বহুকষ্টে সাঁতার কেটে অন্য দিকে রওনা হলো, কিন্তু সেখানেও হায়েনা চলে গেছে। সে তার সমস্ত প্রচেষ্টা করে যেদিক থেকে উঠে যেতে চেষ্টা করে, সেখানেই হায়েনারা দাঁড়িয়ে থাকে। সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পশুটির তখন ডুবে যাবার দশা। সে শেষবারের মতো তার সমস্ত শক্তি দিয়ে দ্রুত সাঁতার কেটে জলাশয়ের তীরে উঠে দাঁড়ালো, প্রচণ্ড পরিশ্রমে সে তখন হাঁপাচ্ছে। ঠিকমতো বুকভরে দুইবার নিঃশ্বাস নেবার আগেই তার ওপর হিংস্র হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে মেরে ফেললো।


আজকালকার এই ভুল ব্যবস্থাপনার বৈষম্যের পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশি বেশি আত্মঘাতী হচ্ছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অসংখ্য আত্মহত্যার সংবাদ শুনতে পাচ্ছি। আমি দীর্ঘদিন ধরে এটার বিরুদ্ধে খুব দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। ফেসবুকেই এটা নিয়ে অনেক বার লিখেছি। আমি সবসময় বলতাম— যা-ই ঘটুক, কখনো নিজেকে শেষ করে দেওয়া যাবে না। প্রতিকূলতার এই পৃথিবীতে যেভাবেই হোক সার্ভাইব করতে হবে। নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আপনি হারিয়ে গেলে কারো কিছুই এসে যাবে না, শুধুমাত্র আপনিই নিজের জীবন টা নষ্ট করবেন। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে জন্ম নিলে আপনাকে একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে হবে। হাল ছেড়ে দেওয়া মানে নিজের সাথে শঠতা, এটা একটা কাপুরুষোচিত আচরণ। এই টাইপের অসংখ্য অসংখ্য গালভরা বয়ান নানান ভাবে, নানান উপমায় একটি সময় আমি লিখেছিলাম।


ইদানীং সামগ্রিক বাস্তবতা আর প্রাসঙ্গিক সমস্ত বিরূপ পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে— যে মানুষগুলো ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা হয়তো তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করেছিল। সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পরেই তারা শেষমেশ নিশ্চিত একটি পরিনতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে। সত্যিকার অর্থে আমার কাছে তাদের এখন আর ততটা নির্বোধ মনে হয় না। এই পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির প্রাণীর ভীড়ে মানুষও একটি সাধারণ জীব। আর দশটি প্রাণীর মতো সে-ও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এতো সুন্দর এই গ্রহের আলো-বাতাসে ভালোমন্দ মিশিয়ে স্বাভাবিক একটা জীবন কাটিয়ে দিতে কে না চায়! জীবন তো মোটে একটা। তবুও যখন কোনো কিছুতেই আর কিছু হয় না, যখন জীবনের সামগ্রিক প্রতিকূলতা চক্রব্যূহের সেই সপ্তরথীর মতন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে ক্রমাগত ভাবে আক্রমণ করে যায়, সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একজন মানুষের অবস্থা হয় সেই নিরীহ হরিণটির মতো— যে বারবার করে সাঁতার কেটে হাঁচড়েপাঁচড়ে তীরে উঠতে চাচ্ছে, কিন্তু তীরে দাঁড়িয়ে আছে হিংস্র একদল হায়েনা। সে বারবার করে সাঁতার কেটে কেটে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে একটি সময় নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে বাধ্য হয়।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

০৮.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'বই পড়া এবং জ্ঞানার্জন'

 একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক নিয়ে আজ সামান্য আলোচনা করতে চাই। বলতে গেলে তা প্রায় আড়াইশো বছর ধরে একটি ধারণা আমাদের মস্তিষ্কে পাকাপোক্ত ভাবে সেট হয়ে গেছে যে— জ্ঞানার্জন করার আসল উদ্দেশ্যই হলো টু-পাইস কামানো। খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাধারার মধ্যে এই বিষয়টি এমন গভীর ভাবে ঢুকে গেছে যে, তারা এটার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেনি আজও। আমাদের উপমহাদেশে ব্যপকভাবে এই ধারণাটির বিস্তৃতি ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে। তখনকার দিনে তথাকথিত 'শিক্ষিত' সমাজ থেকে বাল্যশিক্ষার বইয়ে একটি বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে— 'লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।' তৎকালীন সময়ের কোমলমতি শিশুরা এই বাক্য মনস্তাত্ত্বিক ভাবে গ্রহণ করে বড় হয়েছিল। তারাও একটা সময়ে গিয়ে তাদের সন্তানদের মধ্যে এই ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে এবং বংশপরম্পরায় এই ধারণাটি এতটাই দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, এখনকার দিনে বইপত্র পড়া কিংবা জ্ঞানার্জনের পেছনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে অর্থোপার্জন সংশ্লিষ্ট বিষয়।


আমি বাগেরহাট শহরের একজন রিক্সাচালক ভদ্রলোক কে চিনি, যিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এরপর সংসারের নানান অভাব অনটনের কারণে তিনি আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। তিনি তার পেশাগত জীবনে রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এই ভদ্রলোকের একটি চমৎকার অভ্যাস আছে। তিনি গল্প-উপন্যাস পড়তে ভীষণ পছন্দ করেন। কয়েকদিন আগে তার রিক্সায় যেতে যেতে তিনি আমার সাথে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটি সায়েন্স ফিকশন নিয়ে আলোচনা করলেন। একটা পর্যায়ে আমি তাকে এক কাপ চা অফার করলে তিনি সম্মত হলেন। রিক্সাটি ভৈরব নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে আমরা দু'জন একটি চায়ের দোকানে ঢুকলাম। এরপর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তিনি আমাকে কয়েকটি কথা বললেন, কথাগুলো বলার একপর্যায়ে তীব্র অভিমানে তার চোখে জল এসে গেল। তার কথার সারমর্ম ছিল এরকম— তার গল্পের বই পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। বই পড়ার জন্য তিনি কয়েকদিন গণগ্রন্থাগারে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে গেলে মানুষ তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করে। তাই তিনি তার কষ্টার্জিত টাকা থেকে মাঝেমধ্যে দুই-একটি বই কিনে পড়েন। এটা নিয়েও চারপাশের 'শিক্ষিত' সমাজের লোকজন তাকে খুবই উপহাস করে। নানান ধরনের ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা তাকে হজম করতে হয় শুধুমাত্র বইপড়ার অপরাধে।


আমি আমার স্বল্প জ্ঞানে যতটুকু বুঝি— শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জন। আর জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হলো একজন মানুষের ভেতরকার মূল্যবোধের বিকাশ কিংবা তার চেতনাগত উন্নয়ন। নিজের অন্তর্নিহিত বোধের পরিধির বিস্তৃতিই যদি না ঘটে, সেক্ষেত্রে এতো এতো লেখাপড়া করে এবং অনেক গুলো ডিগ্রী নিয়ে আদৌ লাভ টা কোথায়? সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের একটা পিএইচডি ডিগ্রী আছে, অথচ তিনি বিরাট বড় চোর। তাহলে এই ডক্টরেট ডিগ্রীর কতটুকু মূল্য থাকলো, যেখানে তার আত্মিক উন্নয়ন হয়নি, যেখানে তার মনুষ্যত্ব বিকাশের সুযোগ হয়নি! আজকাল চারপাশে এরকম অসংখ্য অসংখ্য নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত 'উচ্চ শিক্ষিত' লোকজন দেখা যাচ্ছে। এসবের দায় কার জানেন? সেই পুরনো ভুল শিক্ষাব্যবস্থার। যে পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থায় তাকে শেখানো হয়েছে— লেখাপড়া করার মূল উদ্দেশ্যই গাড়িঘোড়ায় চড়ে বিলাসবহুল জীবন কাটানো। আজকাল অনেক অভিভাবকদের দেখা যায় তাদের কোমলপ্রাণ শিশুটির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো একগাদা বইপত্র চাপিয়ে দিতে। তারা তাদের সন্তানের সাকসেস দেখার জন্য এতটাই বেশি মোহগ্রস্ত হয়ে যান যে, তাদের শিশুটি ঐ বোঝার ভার বহন করতে গিয়ে একটা সময় সমাজের তাবত মানুষের কাছে নিজেকে একজন ভুল মানুষ হিসেবে প্রমাণ করে। আজকাল চারপাশে শুধু ভুল শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিক্ষা কিংবা প্রকৃত জ্ঞান তাদের মধ্যে মূল্যবোধের জন্ম দিতে পারেনি।


আমি প্রচুর পরিমাণ বইপত্র পড়ি। এটা নিয়ে আমাকেও অসংখ্য বার অনেকের কাছে কটুকথা শুনতে হয়েছে। তাদের কথা হলো— এই যে আপনি এতো এতো বইপত্র পড়লেন, অনেক বিষয়ে জ্ঞান লাভ করলেন, অনেক তথ্য জেনে নিজেকে সমৃদ্ধ করলেন, কিন্তু আখেরে গিয়ে আপনি কি পেলেন? আপনার তো টাকাপয়সা নেই। এতো জ্ঞান দিয়ে হবে টা কি, যদি অর্থনৈতিক উন্নতি না করা যায়? আমি তাদের সহজ একটি বিষয় আজও বোঝাতে পারলাম না যে, অর্থনৈতিক উন্নতি করার জন্য আমি বইপত্র পড়ি না। এটা একটা আত্মিক ভালোলাগার জায়গা। আপনি যেমন দশ লাখ টাকা সঞ্চয় করে একধরণের আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, আমিও তেমনি কয়েকটি বই পড়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করি। সবকিছুই টাকাপয়সার সাথে সম্পর্কিত নয়। আপনি এভাবে চিন্তা করুণ— এক প্লেট কাচ্চি-বিরিয়ানি খেয়ে আপনি আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, আপনি চমৎকার একটি মুভি দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত দেখে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন কিংবা আপনার প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে সময় কাটিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। এগুলো যেভাবে আপনার মনের খোরাক জোগায়, ঠিক সেভাবেই আমি নতুন একটি বই পড়ে মানসিক ভাবে তৃপ্তি লাভ করি। এরসাথে টাকাপয়সা উপার্জন করা কিংবা অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়ার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বইপড়ার সাথে বস্তুগত মুলধন প্রাপ্তির যে ভুল থিওরী জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসুন। আমি এভাবে অনেক অ্যাঙ্গেলে উদাহরণ দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি, কিন্তু তারা বুঝতে চায় না। তাদের মাথায় 'ভুল শিক্ষা' এমনভাবে ফিক্সড হয়ে গেছে যে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। তাই তারা প্রচুর খেটেখুটে পড়াশোনা করে, এরপর কয়েকটি সার্টিফিকেট অর্জন করে আবারও চাকরির জন্য দৌড়ঝাঁপ করে, সেটা মিটে গেলে টাকার পেছনে দৌড়ায়। বোধশক্তিহীন পশুর মতো দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ করে যখন সে দেখে— একজন লুঙ্গি পরিহিত রিক্সাচালক নিজের রিক্সায় বসে নিমগ্ন হয়ে একটি বই পড়ছে, এই দৃশ্য তখন তার সামগ্রিক বোধ কে অচল করে দেয়। প্রাচীণ কালের ভুল শিক্ষার সেই বিষ তার সারা শরীরে সঞ্চারিত হয়। সে আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না। নির্দোষ পাঠক রিক্সাওয়ালা কে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিয়ে সে তখন মানসিক ভাবে তৃপ্তি লাভ করে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

০৯.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'বাংলাদেশের ধর্মীয় বিদ্বেষ'

 বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানের স্তর টা যেমন থিতু হয়, তেমনি তার বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সুক্ষ্ম হিসাবনিকাশের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। আজকাল আমি জীবনের সেই শাশ্বত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি— যেখানে দাঁড়িয়ে নির্মোহ ভাবে চারপাশের সবকিছু নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। ইদানীং খুব বেশি করে প্রাচীণ ইতিহাস এবং তৎকালীন সময়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর লিখিত বইগুলো খুঁজে বের করে পড়ি। ইতিহাসের পাতা উল্টে প্রাচীণ কালের সেইসব দিনগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে আজকাল তীব্র এক ব্যথায় বুকটা ভীষণ টনটন করে ওঠে। কিসের জন্যে মানুষের সাথে মানুষের এতো বিভেদ? পাশাপাশি একই ভূখণ্ডের একই আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা কিছু মানুষের মধ্যে কেন এতটা বিজাতীয় ক্ষোভ আর ঘৃণা? অনেক চিন্তাভাবনা করেও এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাই না।


মাত্র আড়াইশো বছর আগেও আমাদের মধ্যে ভীষণ গভীর এক আত্মিক টান, পারস্পরিক সম্প্রীতি আর চমৎকার সৌহার্দ্য বিরাজমান ছিল। সেই ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে আমরা পরস্পরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে যুদ্ধ করেছিলাম। অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মহামারীর সময়ে আমরা হাতে-হাত রেখে মোকাবিলা করেছিলাম সেইসব প্রতিকূল পরিস্থিতি। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে আমরা সহোদর দুই ভাইয়ের মতো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লড়াই করেছি। প্রতিটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সমস্ত ধর্মীয় উৎসবে মেতে উঠেছি নির্মল আনন্দে। এরপর হঠাৎ করে কী এমন হলো যে, মুহূর্তের ব্যবধানে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম? দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা আমাদের ভেতরকার সেই ঐক্যবদ্ধ মানসিকতা, সেই ভ্রাতৃত্ব, সেই দারুণ সম্প্রীতি, পারস্পরিক সেই গভীর আত্মিক টান কিভাবে রাতারাতি নেই হয়ে গেল? আমরা কেউ-ই তো এটা চাইনি।


১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের অধিবেশনে উপস্থাপিত মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রবর্তিত দ্বিজাতিতত্ত্বের থিওরী এই উপমহাদেশ জুড়ে প্রধান দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে মারাত্মক ভাবে হিংসার জন্ম দিয়েছিল। এই তত্ত্বের প্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালে পূর্ববঙ্গের নোয়াখালী, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা এবং বিহার রাজ্যে ভয়ংকর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটেছিল। জিন্নাহর খামখেয়ালী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হাজার হাজার নির্দোষ হিন্দু এবং মুসলিম জনগণ নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলিম নিজেদের পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে ছুটে গিয়েছিল আলাদা আলাদা এলাকায়। ভুল থিওরী নিয়ে ১৯৪৭ সাথে জন্ম হয়েছিল 'পাকিস্তান' নামের রাষ্ট্রের। ধর্মের ভিত্তিতে এই রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অসংখ্য হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকজন এবং ভারতে অসংখ্য মুসলিম ধর্মাবলম্বী লোকজন ঠিকই থেকে গিয়েছিল। জিন্নাহ চেয়েছিলেন শুধুমাত্র তার ধর্মের অনুসারীদের নিয়ে একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রের সূচনা করবেন। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সেটা আর কখনোই সম্ভব হয়নি, বরং দিন কে দিন পাকিস্তানের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যাচ্ছে।


দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের গঠন সফল না হলেও ক্ষতি যেটুকু হবার, তা ঠিকই হয়ে গিয়েছিল। ঐ ত্রুটিপূর্ণ তত্ত্বের কারণে এই উপমহাদেশে দুটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যে তীব্র বিদ্বেষ এবং পারস্পরিক ঘৃণার সূত্রপাত ঘটেছিল— সেটা বংশপরম্পরায় আজও ভয়াবহ ভাবে চলমান রয়েছে। ১৯৪০ সালে জিন্নাহ যে ঘৃণার বীজ বপন করেছিলেন, তার খেসারত হিসেবে আজও প্রচণ্ড দুঃখে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। দীর্ঘকাল ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে শত বিপদে পাশাপাশি চলা একজন মানুষ যখন আজ প্রকাশ্যে চিৎকার করে বলে— 'মালাউনের বাচ্চার মা'কে....' তখন ভীষণ দুঃখ হয়। কারণ মালাউন একটি কুৎসিত গালি, যা বাংলাদেশে মূলত হিন্দুদের উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়। 'মালাউন' শব্দটি আরবী শব্দ "ملعون" থেকে উদ্ভূত— যার অর্থ অভিশপ্ত বা আল্লাহর অভিশাপপ্রাপ্ত। অথবা আল্লাহর রহমত থেকে বিতাড়িত। শুধুমাত্র ধর্মীয় বিভেদের ফলশ্রুতিতে ঘৃণা প্রকাশের এই নোংরা রীতি এখন বহুল-চর্চিত। এখনকার দিনে নিতান্ত তুচ্ছতম কারণে ধর্মীয় পরিচয় কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। অথচ আমরা দীর্ঘকাল ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে, হাতে হাত ধরে অসংখ্য অসংখ্য প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে থেকেছি। আমাদের মধ্যে বিভেদ কিংবা বিভাজন ছিল না। পারস্পরিক সম্প্রীতি আর আত্মিক টান নিয়ে আমরা একটি সময় সুখে-দুঃখে মিলেমিশে ছিলাম। তাই আজ যখন এই বিভেদ আর ঘৃণার সংস্কৃতি কে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখি, তখন খুব দুঃখ হয়। হয়তো জিন্নাহ সাহেবের মতো গুটিকয়েক মানুষ এই ঘৃণার রাজনীতি চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাস্ট মি— আমরা বৃহৎ সংখ্যক মানুষেরা কেউ-ই এটা চাইনি।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১১.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'ধ্যানের অভিজ্ঞতা'

 আনুমানিক প্রায় তিনটি বছর ধরে আমি খুব একাগ্রতা নিয়ে একটি বিশেষ চর্চার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। বইপত্র পড়ে এবং ইউটিউবে টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে দেখে নানান ভাবে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা নিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেও কোনো ফল হয়নি। বিষয়টা হলো ধ্যানস্থ হওয়া। এটা এতটাই কঠিন একটি প্রক্রিয়া— যা বলে বোঝানো যাবে না। মস্তিষ্ক পুরোপুরি ভাবে চিন্তাশূন্য করে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। আমাদের চেতনে এবং অবচেতনে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সবসময়ই কিছু না কিছু ভাবনা চলমান থাকে। এই ভাবনাগুলো কে কোনোভাবে বন্ধ করে রাখা যায় না। আমি অসংখ্য বার চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলেছি যে, আমি এখন আর কিছুই ভাবতে চাই না। আমার মন এই মুহূর্তে পুরোপুরি স্তব্ধ থাকবে। জোরের ওপর দুই-চার মিনিট এভাবে ঠিক থাকে, এরপর কোন ফাঁকে হঠাৎ একটা ভাবনা চুপচাপ ঢুকে পড়ে এবং সেটার লেজ ধরে আরও অনেকগুলো ভাবনা ঢুকে পড়ে। সেগুলো কে তাড়িয়ে দিয়ে মনের ঘরে কপাট লাগিয়ে আবারও যখন একটু স্তব্ধ হই— তখন আবারও সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অনুপ্রবেশ। একপর্যায়ে 'ধুত্তেরি' বলে উঠে যেতে বাধ্য হই। যদিও বছর দুয়েক ধরে 'প্রাণায়াম' নামের যোগ টা ঠিকঠাক ভাবে করে যাচ্ছি। তবে শিথিলায়নের একটি পর্যায়ে গিয়ে জগৎ-সংসারের সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর কনসেন্ট্রেশন দেওয়া কিছুতেই আর সম্ভব হচ্ছিল না।


বর্তমান সময়ের আরও অসংখ্য মানুষের মতো আমার মধ্যেও একটি অভ্যাস ভয়াবহ ভাবে ঢুকে গিয়েছিল। সেটা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে সার্বক্ষণিক ভাবে যুক্ত থাকার প্রবনতা। তবে গত দুই মাসের মধ্যে অবিশ্বাস্য ভাবে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন মানুষের সাথে হঠাৎ করে দূরত্ব তৈরি হবার কারণে আজকাল আমি সেভাবে অনলাইনে অ্যাক্টিভ থাকি না। কেউ যে আমাকে এখন আর খুঁজবে না, এটা পুরোপুরি মন থেকে মেনে নেবার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কিছুটা দূরত্ব ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছিল। এরমধ্যেই হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে টালমাটাল অবস্থা, চলমান সহিংসতা এবং নৈরাজ্যের জের ধরে ইন্টারনেট সিস্টেম বন্ধ হয়ে গেল। এটা আমার জন্য একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ছিল, কারণ ইন্টারনেট পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যাবার কারণে আমি মানসিক ভাবে একটি নিশ্চিত স্থিরাবস্থায় পৌঁছে গেলাম যে— আমার এই মুহূর্তে আসলে কোনো দিকে ফোকাস দেবার প্রয়োজন নেই। মোবাইল ফোনের সাথে আমার সংযোগ যেহেতু তখন পুরোপুরি ঘুচে গেছে, তাই আবারও একবার ধ্যানের গভীরে যাবার চেষ্টা করলাম। 


সময়টা ছিল ২১ জুলাই ২০২৪, দিবাগত রাত। সেদিন প্রায় সারাদিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে, এমনকি রাতেও সেই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। আনুমানিক রাত একটার পর বৃষ্টি পুরোপুরি থেমে গেল। মেঘমুক্ত আকাশে তখন জ্বলজ্বল করছে পূর্ণিমার অপূর্ব চাঁদ। চারপাশে ঝিঁঝি পোকা আর ব্যাঙের একটানা ডেকে যাওয়ার শব্দ, এরপর মাঝেমধ্যে ওদের কোলাহল থেমে যাওয়া। সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে এক অপার্থিব শিথিলতা। আমার কোনো তাড়া নেই, কারো জন্যে প্রতীক্ষা নেই। দেশের সামগ্রিক এই সংঘাতময় পরিস্থিতি কিংবা দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় খুটিনাটি হিসাবনিকাশ ভুলে আমি যেন একটা আদিমতম পরাবাস্তবতার মুখোমুখি সেই মুহূর্তে। আমি বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নিলাম এবং চোখ বন্ধ করে নিজের মধ্যে নিমগ্ন হলাম। এর আগে আমি যতবারই ধ্যানস্থ হবার চেষ্টা করেছি, সব সময়ই মনের মধ্যে একটা বাড়তি তাড়না ছিল যে— বিচ্ছিন্ন ভাবনাগুলো কে দ্রুত তাড়িয়ে দিতে হবে। এদিন আর সেই বাড়তি চাপ টুকুও মনের ওপর প্রভাব ফেলেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি কোথায় যেন তলিয়ে যেতে শুরু করলাম। এখন সচেতন অবস্থায় আমি সেই মুহূর্তের বিচিত্র অনুভূতি লিখে প্রকাশ করতে পারবো না, কিন্তু সেটা ছিল আমার এযাবৎকালে জন্মানো বোধের বাইরের এক অনুভব। পুরোপুরি ভাবে চিন্তাশূন্য এক অবিশ্বাস্য জীবন্ত অনুভূতি। ঠিক কতক্ষণ এভাবে মোহাবিষ্ট হয়ে ছিলাম জানি না, তবে যখন আবারও আমার মাথায় ভাবনা অনুপ্রবেশ করলো— আমি লক্ষ্য করলাম বাইরে তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে এবং আমার পোষা বিড়াল টা চিৎকার করে ডাকছে। দরজা খুলে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া বিড়ালটিকে ঘরে এনে এক কাপ চা বানিয়ে কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া বিষয়টি ভাবতে বসলাম। এটা ছিল আমার জীবনের চল্লিশ বছর পার করার পরের সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটি, যখন আমি জীবনে প্রথম বারের মতো সত্যিকার অর্থে চিন্তাশূন্য স্থিরাবস্থায় প্রবেশ করে ধ্যানস্থ হলাম। প্রত্যাশা করি— প্রক্রিয়াটির আরও উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হবো।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

'সার্কেল অফ লাইফ'

 সবকিছুই সেই পূর্বের অবস্থানে বারবার করে ফিরে ফিরে আসে, এভাবেই একটি চক্র পূর্ণ হয়। জীবনের চক্র কিংবা সময়ের চক্র। সুপ্রাচীণ এক মহাজাগতিক মহাবিস্ফোরণের ফলে সৃষ্টি হয়ে চতুর্পাশে ছড়িয়ে পড়েছিল যে অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ড— কালের আবর্তে একদিন সেটাও মহা সংকোচনের মাধ্যমে পরিনত হবে ক্ষুদ্রতম একটি বিন্দুতে, এক সময় সেই বিন্দুটিও অদৃশ্য হয়ে যাবে। অবশিষ্ট থাকবে না কিছুই, শুরু হবার সেই আগেকার অবস্থার মতো। এভাবেই পূর্ণ হবে সময়ের চক্র। বায়োলজিক্যাল প্রাণী হিসেবে প্রাচীনকালে এই গ্রহেও শুরু হয়েছিল আমাদের লাইফের জার্নি। একটু একটু করে মেরুদণ্ড সোজা করে আমাদের চলতে শেখা, হাত-পায়ের সুষম ব্যবহার করতে শেখা, এরপর আগুন আবিষ্কার, গুহা থেকে বেরিয়ে মুক্ত স্থানে বসতি স্থাপন, চাকা আবিষ্কার এবং বহুদূর পর্যন্ত নিজেদের কে চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া।


বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সেই প্রাচীনতম নিয়ম মেনে আমরাও ক্রমাগত ভাবে নিজেদের ছড়িয়ে দিতে শিখলাম চতুর্পাশে। নিজেকে জানা এবং নিজের গ্রহটিকে এক্সপ্লোর করার সেই বুনো উল্লাসে ভেসে আমরা জন্ম দিলাম আধুনিকতা নামের একটি পারিপার্শ্বিক আচ্ছাদন। এরপর থেকে শুধুই ছুটে চলা। এভাবে সভ্যতার পথে ছুটতে ছুটতে একটি পর্যায়ে গিয়ে আমরা, অর্থাৎ মানুষেরা লক্ষ্য করলাম যে— সবকিছুই কেমন জানি একঘেয়ে হয়ে গেছে। কোনকিছুর মধ্যে আর সেভাবে আগ্রহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই শুরু হলো পুরনো দিনের জীবনের স্পর্শ নিয়ে নতুনত্ব সৃষ্টির এক অদ্ভুত ফর্মুলা। ওল্ড লাইফস্টাইলের বৈচিত্র্যে মোড় নিল জীবনের নতুন গতিপথ। জংধরা পুরনো আমলের ফ্যাশন নতুন ভাবে বিক্রি করে কিছুদিন কেটে গেল ঠিকই, কিন্তু এরপর আবারও সেই একঘেয়ে জীবন। অতীত-বর্তমান এবং বর্তমান-অতীত কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে আর কতকাল চলে! জীবনচর্চার মধ্যে অভিনব কিছুই তো আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যা কিছুই নতুন হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে, তার পুরোটাই যান্ত্রিকতার অবয়বে মোড়া। 


আজ থেকে একশো কিংবা দেড়শো বছর আগেও মানুষের প্রতি মানুষের এক নিবিড় আত্মিক টান লক্ষ্য করা গেছে। পরিচিত কেউ মারা গেলে আশেপাশের অসংখ্য মানুষের মধ্যে গভীর বিষাদ নেমে আসতো। হারিয়ে যাওয়া মানুষটির অভাব ভুলতে বাকি মানুষদের কয়েক বছর লেগে যেতো। আর আজকাল খুব ঘনিষ্ঠ আপনজন মারা গেলেও মানুষের মধ্যে তেমন কোনো ভাবান্তর ঘটেনা। মৃত মানুষটিকে ভুলে যেতেও সময় লাগে না এখন। আবেগ-অনুভূতির জায়গায় সবাই খুব বেশি নির্লিপ্ত। আগেকার দিনের মানুষের প্রতিটি পরিবারে একগাদা সন্তান থাকার নেপথ্যেও ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তখনকার সময়ে ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি নিয়ে মানুষের মধ্যে তুমুল আগ্রহ এবং এই বিষয়টিকে উপভোগ করার বিষয় ছিল। সত্যিই তারা এটা থেকে দুর্দান্ত ফিজিক্যাল প্লেজার লাভ করতেন। আর এখনকার সময়ের মানুষের মধ্যে থেকে সেই প্রাকৃতিক বুনো আনন্দ হারিয়ে গেছে। বর্তমান সময়ের অর্গাজমে সম্ভবত সেই পুরনো দিনের মতো শিহরণ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন ধরে বলতে হয়— 'কাঁচা লঙ্কায় এখন আর তেমন ঝাল নেই!' আজকাল সবকিছুর মধ্যে একটা কৃত্রিমতার ছোঁয়া। প্রকৃতি এখন মানুষের মধ্যে থেকে অনেক জৈবিক অনুভূতি লুপ্ত করে দিচ্ছে। মানুষ আজকাল এক মুহূর্তের নোটিশে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে দেয়। কেউ আজকাল বাড়তি পেইন নিতে পছন্দ করে না।  


কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার রেশ ধরে সারাদেশের ইন্টারনেট সিস্টেম বন্ধ করে দেওয়া হলো। এবারই প্রথম অসংখ্য মানুষ একটি বিষয় বুঝতে পেরেছে যে— কোনো কিছুর সাথে অতিরিক্ত রকম অভ্যস্ততা তৈরির পর সেই বিষয়টির অনুপস্থিতির প্রতিক্রিয়া কতখানি মারাত্মক হতে পারে। যুগের হাল-হকিকত মেনে নিয়ে আমরা সবাই এখন খুব বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। তবে এটাও আমাদের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা দরকার যে, হঠাৎ করেই প্রযুক্তি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর বর্তমান যে পরিস্থিতি, সবখানেই যেরকম যুদ্ধংদেহী মনোভাব, তাতে অদূর ভবিষ্যতে গোটা পৃথিবীতে ভয়ংকর কোনো সংঘাত ঘটে গিয়ে সমস্ত পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা যদি পুরোপুরি মুখ থুবড়ে পড়ে, তাতে আমি খুব বেশি অবাক হবো না। হয়তো একটা সময় আবারও আমাদের পায়ে হেঁটে মাইলের পর মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে আর একজন মানুষের খোঁজে, হয়তো আবারও আমাদের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠি লিখে পাঠাতে হবে দূরের একজন প্রিয় মানুষের কাছে। হয়তো সুসজ্জিত দালান-কোঠা ছেড়ে আমাদের আবারও গুহাবাসী হতে হবে। ভবিষ্যতের কথা যদিও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যায় না, তবে— সবকিছুই সেই পূর্বের অবস্থানে বারবার করে ফিরে ফিরে আসে, এভাবেই একটি চক্র পূর্ণ হয়। জীবনের চক্র কিংবা সময়ের চক্র।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

২৯.০৭.২০২৪ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...