প্রাচীণ লোকসংস্কৃতি এবং আবহমান বাংলার পুরনো দিনের বেশকিছু ঐতিহ্য এখন আধুনিকায়নের তীব্র স্রোতের তোড়ে ভেসে ভেসে হারিয়ে গেছে অজানায়, এমনই একটি প্রাচীণ সাংস্কৃতিক উৎসবের নাম পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ পার্বণ। এই প্রাচীণ উৎসবটির প্রতিটি পর্যায়ে জড়িয়ে আছে আগেকার দিনের গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের জীবন এবং জীবিকার প্রতিচ্ছবি। সৌভাগ্যক্রমে আমার জন্ম হয়েছিল আশির দশকের প্রথম ভাগে এবং আমার শৈশবের দিনগুলো কেটেছিল প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। এরজন্য আমি প্রাচীণ সেইসব দিনের প্রথাগত সামাজিক জীবন-জীবিকা এবং ঐতিহ্যবাহী সেইসব লোকসংস্কৃতি কে সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। পৌষের সেইসব দিনে বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদের মানুষের বাড়িতে নতুন আমন ধানের চালে গোলা ভর্তি হয়ে যেতো। প্রথমে ধানের জমি থেকে নতুন ফসল কেটে এনে উঠোনে স্তুপ করে রাখা হতো, এরপর উঠোনের মাঝখানে একটি খুঁটি পুঁতে একটা দড়ির সাহায্যে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি গরুকে বেঁধে সেই ধান মাড়াই করা হতো। ধান কাটা থেকে শুরু করে চাল বের করা পর্যন্ত প্রতিটি প্রক্রিয়া ছিল যেমন শ্রমসাধ্য, তেমনি এই প্রতিটি পর্যায় ছিল দারুণ উৎসবমুখর।
নতুন খাদ্যশস্য ঘরে তোলার পর এই সময়ে গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে আনন্দের ঢেউ খেলে যেতো। এরপর পৌষের শেষে জাঁকিয়ে শীত নামা শুরু হলে প্রতিটি বাড়ির বউঝি এবং অন্যান্য নারীরা চালের পাত্র নিয়ে ঢেঁকিতে পিষে চাল গুড়ো করতে যেতেন। আমি শৈশবে বেশ কয়েকবার মায়ের সঙ্গে চাল কুটতে গিয়েছি। গ্রামের নির্দিষ্ট একটি বাড়িতে ঢেঁকিঘরে আরও অনেক মহিলারা কোলের ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হতেন। সেটাও ছিল দারুণ উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। এরপর সন্ধ্যা বেলায় হাত-মুখে চালের গুঁড়ো মেখে সাদা ভূত হয়ে ঘরে ফিরতাম। শুরু হতো পিঠা তৈরির আয়োজন। চুলার আগুনে মাটির ছাঁচ রেখে চালের গুঁড়ো গুলে সেটা ছাঁচে ফেলে কিছুক্ষণ ঢেকে রাখা হতো। আমি উনুনের আঁচে বসে মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতাম। মা যথারীতি প্রথম বার পিঠা তুলে আমাকেই দিতেন। তীব্র শীতে সেই ধোঁয়া ছড়ানো গরম পিঠা হাতে নিয়ে যে সুখানুভূতি পেতাম, তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার জানা নেই। সেই সময়কার আমার সমবয়সী সকল শিশুর হাতেই থাকতো থালা ভর্তি পিঠা আর নতুন খেজুরের গুড়।
এরপর সময়ের আবর্তে চুরি যাওয়া রোদের মতোই সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে বহুদূরে। গ্রামীণ জনপদের সমাজব্যবস্থায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখন আমরা যন্ত্র নির্ভর সময়ে এসে পৌঁছে গিয়েছি। চারপাশে বিনোদনের অসংখ্য উপকরণ। এখন আর কেউ লাঙ্গলে হালচাষ করতে করতে টানা সুরে গান গায় না, এখন উঠোনে গোবর লেপে গরু দিয়ে ধান মাড়াই করা হয় না। এখন কেউ আর চাল নিয়ে ঢেঁকিঘরে যায় না। এখন ফসল উৎপাদনের গুরুদায়িত্ব মেশিনের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে। মেশিন হালচাষ করে, আর জমির মালিকেরা সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করে। সবকিছুই খুব বেশি শর্টকাট। এখন আর পিঠা বানানোর জন্য উৎসবের প্রয়োজন হয় না, এখনকার শিশুরা উনুনের আঁচে মায়ের পাশে বসে পিঠার জন্য বায়না করে না। শিশুদের হাতে তাদের বাবা-মা স্মার্টফোন তুলে দিয়েছেন। ওদের পিঠা খাওয়াতে গেলেও টিভিতে 'গোপাল ভাঁড়' কিংবা 'মোটু-পাতলু' দেখানো লাগে। নতুন ধানের চালের ঘ্রাণ ওদের কাছে অজানা, ওদের কাছে অজানা খেজুরের গুড়ের সেই আঠালো মিষ্টি স্বাদ। আধুনিকায়ন আর স্মার্টফোনের দৌরাত্ম্যে এখনকার সময়ের শিশুরা যে স্মার্টনেস বগলদাবা করে বেড়ে উঠছে, তাতে আগামী বিশ কিংবা পঁচিশ বছর পরের প্রজন্মের কাছে 'পৌষ পার্বণ' বিষয়টি হবে নেহাৎ একটি পঠিত বিষয়। এই খটখটে স্মার্টনেসে নেই মাটির ছোঁয়া, নেই নিজের আবহমান সংস্কৃতির প্রভাব। এখনকার দিনের একটাই টার্ম, ঘাড় সোজা রেখে আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দাও! তবুও শৈশবের যে সোনালী অধ্যায় পার করে এসেছিলাম, যে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের স্মৃতিতে এখনও নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই, এখনও কুয়াশায় ঢাকা পৌষ শেষের সন্ধ্যায় নতুন চালের একটা গরম পিঠার স্পর্শ আমাকে যতটা গভীর ভাবে আবেগে আপ্লুত করে- সেই দিন, সেই সময়গুলো, সেইসব স্মৃতিই আমাকে আবারও প্রতিবারের পৌষ সংক্রান্তিতে সেই পুরনো অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, যে দিনের কাছে কোনভাবেই আর ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সবার প্রতি পৌষ পার্বণের অনেক অনেক শুভকামনা!