রবিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২

'অর্থহীন পরাবাস্তবতা'

 (অর্থহীন পরাবাস্তবতা)


'....আজ খুব ভোরেই টিয়া'র ডাকে আমার ঘুম ভেঙেছে। খুব বিরক্তি নিয়ে আমি চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করলাম, ঠিক কোথায় এখন আমি! প্রচন্ড রকম বিরক্তিতে আমার কপাল কুঁচকে আছে। টিয়া তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট অনুযায়ী একঘেয়ে গলায় আমাকে ডেকেই যাচ্ছে, একটা প্রচন্ড লাথিতে টিয়া'কে ঘরের অন্যপাশে ছুড়ে ফেলার ইচ্ছেটাকে অতি কষ্টে দমন করে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। এরপর টিয়া কে কোলে নিয়ে একটু আদর করে ওকে বিস্কুট খেতে দিলাম। 'টিয়া' আমার অতি প্রিয় পোষা একটি মাঝ বয়সী বিড়াল! আমি দীর্ঘদিন ধরেই একা একা থাকতে শিখেছি; শিখে নিয়েছি একা পথ চলতে। তবে দিনের শেষে যখন চারিপাশ অন্ধকার করে নিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে, যখন সর্বত্র টিমটিম করে একটির পরে একটি আলো জ্বলে ওঠে; জানিনা ঠিক কেন- তখন প্রচন্ডরকম এক নিঃসঙ্গতাবোধ যেন অষ্টাঙ্গিক দৃঢ়তা নিয়ে অক্টোপাসের মতোই জড়িয়ে ধরে আমার ভেতরের নিজস্ব সত্তাটুকু! আর তাই সম্ভবত; নিঃসঙ্গতা আর নীরবতার এই একপেশে খুনসুটি কে উপেক্ষা করার জন্যেই আমার এই বিড়ালপ্রীতি! হ্যাঁ, যেটা বলছিলামঃ আজকাল ঘুমাতে বড্ডই দেরি করে ফেলছি, যার কারণে খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভীষণ অস্বস্তি হয়। সকালের আলোটুকু চোখে একবার পড়লে, নতুন করে ঘুমাতে যাওয়াও বেশ কষ্টকর! কি আর করা, চুলায় চায়ের পাত্র চাপিয়ে বসে আছি। একটু একটু করে ফুটন্ত বাষ্প জানালা দিয়ে বের হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে এই অস্থির জানুয়ারী'র মধ্য প্রহরের ধোঁয়াটে সাবলীল বাতাসে। বাইরে কি মুক্ত বাতাস! সকালের আকাশটাও তার সমস্তটুকু মুগ্ধতা ছড়াতেই যেন ব্যাস্ত। অথচ, আজ প্রায় দিন দশেক ধরে বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে সময়টা সত্যিই যেন খানিকটা থমকে আছে! জানিনা, আবার কবে বাইরে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবো; কবে আবারও গলা খুলে গাইবো! জানিনা, কিছুই জানিনা আমি। শুধু এটুকুই জানিঃ চলমান সংকট এখন কিছুটা বীভৎস কোনো সায়েন্স ফিকশনের মতোই  মনে হচ্ছে, যার সমাপ্তি অকারণেই যথেষ্ট দুর্বোদ্ধ; অথবা আমি আসলে এখন  ঘুমিয়েই আছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি; এই জানুয়ারী মাসের সকাল, চুলার ফুটন্ত বাষ্প কিংবা আমার গায়ে আলতো ছুঁয়ে লেজ বুলিয়ে যাওয়া আমার প্রিয় পোষা বিড়াল, সবই সেই দুঃস্বপ্নেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়তো একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠবো, উঠে দেখতে পাবো সব কিছুই খুব স্বাভাবিক অবস্থায় আছে; যেমনটি ছিলো আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগেই......!'


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১

'নিজস্ব এক্সপেরিমেন্ট'

 

প্রায় এগারো বছর ধরে ফেসবুক সহ সোশ্যাল মিডিয়ার আরও দু'একটা সাইটে যুক্ত থাকার কারণে অনেক দিন থেকেই একটি কথা বেশ জোরেশোরে শুনতে পাই। কথাটি হলোঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোন একটি মেয়েকে প্রতিনিয়তই আবশ্যিক ভাবে অনাকাঙ্খিত কিছু উপদ্রবের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু এই উপদ্রবের মাত্রা আসলে কতটা গুরুতর এবং এজাতীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিক একটি মানুষ হিসেবে একজন নারী  আসলে কতটুকু বিড়ম্বনার শিকার হন, এই বিষয়ে আমার কখনোই পরিষ্কার কোন ধারণা ছিলনা। যাইহোক, বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবার জন্য হঠাৎ করেই একটি এক্সপেরিমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অত্যন্ত সহজ এবং শতভাগ কার্যকরী পদ্ধতি ছিল এটা।

কিছুদিন আগে মোটামুটি চেহারার অখ্যাত একজন নারী মডেলের কয়েকটি ছবি ব্যবহার করে একটি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করলাম, উক্ত প্রোফাইলে এমনভাবে সমস্ত তথ্য সংযোজন করলাম যাতে ওটা ভিজিট করতে গিয়ে কারোর মনে কোন প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। এরপর আরও একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমার কয়েকটি লেখা উক্ত এ্যাকাউন্টে সেই মেয়েটির নাম দিয়ে পোস্ট করে দিলাম। এবারে হাতেনাতে ফলাফল পেতে শুরু করলাম। অসংখ্য অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসতে শুরু করলো, বলাই বাহুল্য তাদের নিরানব্বই শতাংশই আমার জাতভাই একেকজন 'সিংহ পুরুষ'! তারা ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হয়েই ইনবক্সে এসে ইনিয়েবিনিয়ে নানান খুটিনাটি সস্তা ধরনের কথাবার্তা বলে অচেনা মেয়েটির মনোরঞ্জনে নিজেদের নিয়োজিত করলেন। দু'একজন তো একধাপ এগিয়ে গিয়ে নিজেদের পৌরুষ বিকৃত ভাবে প্রদর্শন করে বিভিন্ন কুৎসিত ছবি এবং অশ্লীল ভাষায় মন্তব্য প্রদান করলেন। আমি তাদের পাঠানো টেক্সটগুলো দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম! একটু কৌতূহলী হয়ে তাদের প্রোফাইল ঘুরে দেখে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি। যদিও বেশকিছু ফেইক এ্যাকাউন্ট ছিল, তবে যৌন বিকারগ্রস্থ সেইসব মানুষের অনেকেই নিজের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত প্রোফাইল ব্যবহার করেন। আমি ভীষণ রকম অবাক হয়ে দেখলাম তাদের কয়েকজন কিছুদিন আগেই 'ডটার্স ডে' উপলক্ষে নিজের ফুটফুটে কন্যা সন্তানটিকে কোলে নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে ছবি তুলে আপলোড দিয়েছেন, কয়েকজন নিজের ছোটবোনকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠার মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী করেছেন, কারো কারো ওয়ালে শোভা পাচ্ছে নিজের প্রেমিকা কে নিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাবার প্রেমময় মুহূর্ত, কেউ সস্ত্রীক নিজের সুখী দাম্পত্য জীবন কে বাহুল্য বর্ণনায় ভরিয়ে তুলেছেন! 

ওনারা প্রত্যেকেই এই সোসাইটিতে বসবাস করেন, প্রত্যেকেরই রয়েছে সুন্দর এনভায়রনমেন্টের একটি পারিবারিক জীবন। অথচ তারাই আবার সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যমে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে অপরিচিত একটি মেয়েকে গোপনে উত্যক্ত করে তীব্র মানসিক সুখ লাভ করছেন। এই পরীক্ষাটি করতে গিয়ে আমি সাংঘাতিক একটা ধাক্কা খেয়েছি, কারণ আমার বাস্তব জীবনে পরিচিত দুই-চারজন মানুষও আমার এই ফেইক এ্যাকাউন্টে এসে গদগদবচনে প্রোফাইলের মেয়েটির রূপের বন্দনা করে গেছেন! আমার জানতে ইচ্ছে করে- আমাদের বাঙালী সমাজের ম্যাক্সিমাম পুরুষেরাই কি নিজেদের অবচেতনে অবদমিত কামনা লালন করেন? ওনারা সংগোপনে প্রত্যেকেই কি যৌন বিকারগ্রস্ত? তাদের মধ্যে কি ব্যক্তিত্বের এতো বেশি স্খলন ঘটেছে? এর জবাব পেতে নিজেকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব গবেষণা করার দরকার পড়েনা। আমার ওই তিনটি প্রশ্নের প্রতিটির জবাবই 'হ্যাঁ'! দিন কে দিন নৈতিকতার এত বেশি অধঃপতন ঘটেছে যে- ওনাদের কারণে অনেক মেয়েরা এখন 'ফেসবুকের ইনবক্স কিভাবে বন্ধ করা যায়' লিখে গুগলে সার্চ করে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পন্থা কি নেই?! অথচ এভাবে কি চিন্তা করা যায় না- আপনি একজন পুরুষ। আপনার মেধা মনন, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব আর মার্জিত আচরণ দেখে একজন নারী আপনার প্রতি মুগ্ধ হবে!

ভাই, আপনি একজন পুরুষ। এই প্রকৃতি আপনাকে উদার হিসেবে, সুন্দর হিসেবে, শক্তিশালী হিসেবে, দায়িত্বশীল হিসেবে সৃষ্টি করেছে। নিজের প্রতি একটু তো সুবিচার করুণ! আপনার সামান্য কিছু ভুলের জন্য বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের কাছে আমাদের সবাই কে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার কোন অধিকার আপনার নেই। ঠিক যেভাবে পারিবারিক জীবনে আপনি একজন অনুগত সন্তান, প্রেমময় প্রেমিক, দায়িত্বশীল স্বামী এবং স্নেহময় পিতা এবং বড়ভাই, ঠিক সেভাবেই নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পেশ করুণ। কারণ আপনার পরিবার এবং আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে যেমন সমাজ ব্যবস্থা গঠিত হয়েছে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়াও আপনার সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজেকে পাল্টান, পাল্টে যাবে আপনার চতুর্পাশের পরিবেশ। আপনার সামান্য একটু সচেতনতাই আমাদের আগামী প্রজন্ম কে একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিতে পারে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১০.১০.২০২১ খ্রিঃ

শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

"গল্প এবং বাস্তবতা"

 "ইনফার্নো এবং চলমান করোনা পরিস্থিতি"


অনেক দিন আগে ড্যান ব্রাউনের লেখা 'ইনফার্নো' বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ আবারও পড়লাম, এই উপন্যাসটি সত্যিই মাথা খানিকটা হলেও এলোমেলো করে দেয়। বিশেষতঃ ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি তত্ত্ব এবং তার থেকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পরিত্রাণ লাভের যে সংগতি উপস্থাপিত হয়েছে, সেটা সত্যিই অনবদ্য। তাতে হোক সেটা অসীম ক্ষমতাধর কোন অদৃশ্য মহাশক্তির অঙ্গুলিহেলনে কিংবা প্রাকৃতিক নিয়মে অথবা অতি প্রতিভাবান কোন মানুষের উদ্ভাবিত পন্থায়।

ম্যালথাসের তত্ত্বটি দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিতঃ

ক) মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন।

খ) নারী ও পুরুষের পারস্পারিক আকর্ষন ও সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল।

ম্যালথাসের বক্তব্য হলোঃ স্ত্রী পুরুষের মধ্যে পারস্পারিক আকর্ষনে জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি ২৫ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। অর্থাৎ খাদ্য শস্যের উৎপাদন যদি গানিতিক হারে বৃদ্ধি পায়, জনসংখ্যা তখন বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। তাহলে এর থেকে প্রতিকারের উপায় কি? শুনতে অত্যন্ত অমানবিক নিষ্ঠুর মনে হলেও এর সহজ প্রতিকার কিন্তু ঠিকই আছে। হ্যাঁ, এই সমস্যা থেকে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে কোন একটি অদ্ভুত উপায়ে বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যা কে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সেটা হোক নিউক্লিয়ার ওয়েপন ব্যবহার করে কিংবা 'বিশেষ' কোন জীবাণুর সংক্রমণ ঘটিয়ে। অতঃপর যে জনসংখ্যা টিকে যাবে, তারাই আবার পৃথিবীর সাথে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এবারে আসা যাক গল্পের অংশে। ড্যান ব্রাউনের 'ইনফার্নো' উপন্যাসে দেখা যায় একজন বিপথগামী মেধাবী বিজ্ঞানীর গবেষণায় সৃষ্ট 'জোবরিস্ট' ভাইরাস এর বাহক হলো নিরীহ মানবগোষ্ঠী। মানবদেহের কোষে অনুপ্রবিষ্ট এই ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেধাবী বিজ্ঞানীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় নায়ক রবার্ট ল্যাংডন ইতালির ফ্লোরেন্সের একটি হাসপাতালের ঘরে জেগে ওঠার পর আবিষ্কার করেছিলেন যে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা- 'দ্য কনসোর্টিয়াম' এর লক্ষ্যবস্তু। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন ফ্লোরেন্সে তিনি কী করছেন? তিনি এখানে কীভাবে এলেন? কে তাকে হত্যার চেষ্টা করছে? ইত্যাদি। তাকে বত্তিচেলি'লা মাপা হেল' 'ইনফর্নো' অবলম্বনে সৃষ্ট এই মানচিত্র বোঝাতে হবে। চিকিৎসক সিয়েনাসহ ক্লু উন্মোচন করার সাথে সাথে ল্যাংডন আবিষ্কার করলেন যে একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী বিশ্বের বেশি জনসংখ্যার সমস্যা সমাধানের জন্য ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুছে ফেলার এক অন্যতম ধ্বংসাত্মক দুর্ঘটনা "ব্ল্যাক ডেথ" এর মতন প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তবে ধরা পড়ল যে বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছেন এবং ভাইরাসটি অজানা স্থানে লুকিয়ে রেখে গেছেন। অবস্থানটির সংকেতগুলি দান্তে এবং ইনফার্নোর সাথে সম্পর্কিত সমস্ত চিহ্নগুলির অনুক্রমের মধ্যে এনক্রিপ্ট করা হয়েছে, যা ল্যাংডন ক্রমান্বয়ে উন্মোচন করেন। কিন্তু তার আগেই 'জোবরিস্ট ভাইরাস' ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। বর্তমানের করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ও নিরীহ মানুষের মৃত্যুর সময়ে 'ইনফার্নো' আমাদের একটি বিষয়ে দারুণ ভাবে সাদৃশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে, তা হলোঃ ম্যালথাসের থিওরী অনুযায়ী পার্থিব জনসংখ্যার বিস্ফোরণ থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করার জন্য প্রকৃতি কিভাবে তার সাম্যাবস্থা বজায় রাখে!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/  

২৯.০৪.২০২১ খ্রিঃ

"এলোমেলো ভাবনা"


একটা অদ্ভুত ব্যাপার নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে খুব করেই ভাবছি। বিষয়টা যে নিতান্তই হাস্যকর, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবুও এটাকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারছিনা, বলেই এই লেখা। আমি যখন হুমায়ূন আহমেদের লেখা বই পড়া শুরু করি, তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। আর “হিমু” ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়- যখন সবে কলেজে ভর্তি হলাম। তখনকার সময়ে আমার বয়েসী অনেক ছেলেকেই দেখেছি হলুদ পাঞ্জাবী পরে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে, সমস্ত সময়ই এই ব্যাপারটা আমার কাছে যথেষ্টই হাস্যকর মনে হয়েছে। তবে “হিমু” চরিত্রটি যে অসম্ভব রকমের আকর্ষনীয়; এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।  কারণ হুমায়ূন আহমেদ বলেছেনঃ হিমুর বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলেকে মহাপুরুষ হিসাবে গড়ে তুলতে, যদিও কাজটি তার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে হিমু যে অস্বাভাবিক ধরনের একজন মানুষ, তা এক বাক্যেই স্বীকার করে নিতে হয়। যাইহোক, মুল কথায় ফেরা যাক। তিন/চারদিন আগে আমার পরিচিত একজন আমাকে ডেকে নিয়ে বললঃ দাদা, আপনাকে একটা কথা বলি- "কথাটা সিরিয়াস", এরপর আমি তার সিরিয়াস কথা শুনে নিজেও বেশ সিরিয়াস ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছি! সে বলেছিলো, আমি নাকি “হিমু” দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত। আর এই কারনেই আমার স্বাভাবিক জীবন ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরে একাকী বসে অনেক সময় নিয়ে ভেবেছি এই বিষয়টি নিয়ে। আসলেই কি তার কথা সত্য? হিমু বলতে আমরা যে চরিত্রটি'কে চিনি, তার আসলে প্রচলিত নিয়মে কোন কাজ নেই। তার কাজ হল রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা-হাঁটি করা আর নানা প্রকারের অস্বাভাবিক কর্মকান্ডের দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করা। হিমুর টাকা-পয়সার প্রতি বিশেষ কোন মোহ নেই, আর সেই কারনেই সে কখনও কোন প্রকারের চাকুরী কিংবা অন্য কাজের সাথে যুক্ত হয়না।  তার পোষাক পরিচ্ছদও নিতান্ত ছাপোষা। কারন মহাপুরুষদের অর্থের প্রয়োজন নেই কিংবা তাঁদের পোষাক হতে হয় বাহুল্যবর্জিত। এছাড়া হিমু কখনও কোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়না, সে চীর ব্রক্ষ্মচারী পুরুষ, কারন সংসারের প্রতি মোহ থাকলে মহাপুরুষ হওয়া যায়না। হিমুর অনেক আত্মীয়-স্বজন কিংবা কাছের বন্ধুরা তাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকে। হিমুর থাকার জায়গাটা হতে হয় যথেষ্ট অপরিচ্ছন্ন আর এলোমেলো, যেকোন মানুষ হিমুর ঘরে গিয়ে চমকে উঠে ভাবে এখানে মানুষ থাকে কিভাবে? অথচ হিমুর এসব নিয়েও কোন চিন্তা ভাবনার অবকাশ থাকেনা। শহরের দাগী সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ফুটপাতের চা বিক্রেতা, রিক্সাওয়ালা,  ভিখারী কিংবা ভ্রাম্যমান পতিতা, সবার সাথেই হিমুর পরিচয় থাকে। হিমুর অন্যতম আর একটা উল্লেখযোগ্য কাজ হল পূর্নিমা রাত্রে জোৎস্না উপভোগ। এক কথায় বলা যায় তার জীবন যাপন পদ্ধতি খুবই বিচিত্র, আর সত্যিকার অর্থেই এই ধরনের মানুষের প্রতি সবারই এক ধরনের আগ্রহ থাকে। আমরা সমাজে প্রতিনিয়ত একঘেয়ে জীবন যাত্রা দেখে দেখে অভ্যস্ত, তাই হঠাৎ করে কিছু ব্যাতিক্রমতা আমাদের স্বভাবতই এক ধরনের ঘোরে আচ্ছন্ন করে। এটাই চীরায়ত দৃষ্টিতে আমাদের হিমু দর্শন। এখন নিজের কথা বলি- হ্যাঁ, অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে, আমিও প্রথাগত জীবন যাপন পদ্ধতির অনেকটা বাইরে থেকে থেকে অভ্যস্ত। যেমন আমার কোন টাকা-পয়সার প্রতি মোহ নেই, কোন বিশেষ খাবার অথবা পোষাক আমাকে টানেনা। আমার ব্যক্তিগত থাকার জায়গাটা ভীষন অগোছালো আর অপরিচ্ছন্ন থাকে, যেকোন সমস্যার কারনে এখনও পর্যন্ত আমি কোন চাকরী অথবা ব্যাবসার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারিনি। হ্যাঁ, উটকো দার্শনিক টাইপের কথা বলে আমিও মানুষকে বিভ্রান্ত করে মজা পাই। সমাজের অতি নিম্নশ্রেনীর মানুষের সাথেও আমার এক ধরনের গভীর সখ্যতা আছে। আমি এখনও পর্যন্ত কোন নারীর সাথে নিজেকে জড়াইনি, আর আপতদৃষ্টিতে সংসার করারও কোন ইচ্ছে নেই। আর সবচেয়ে অবাক বিষয় হল- পূর্নিমার চাঁদের প্রতি আমি বিশেষ ভাবে দুর্বল। সবকিছু মিলিয়ে এক কথায় বলে দেওয়া যায় যে, আমি হিমুকে ফলো করতে করতে এমনটা হয়েছে। অথচ সত্যিটা আদৌ তা নয়। “হিমু” জাষ্ট আমার কাছে উপন্যাসের একটা চরিত্র মাত্র, যা হুমায়ূন আহমেদ স্যার অনেক যত্নে সৃষ্টি করেছেন। মহাপুরুষ হবার বাসনাও আমার নেই। যেটা আমার সাথে ঘটেছে তা নিতান্তই কাকতালীয়। তবে পুরো বিষয়টা গভীর ভাবে চিন্তা করে আমি সত্যিকার অর্থে “খাম্বিত” অর্থাৎ যাকে বলে স্তম্ভিত! 

(বিঃদ্রঃ স্তম্ভের অপর নাম খাম্বা, তাই স্তম্ভিত হওয়া মানেই খাম্বিত হওয়া- (হিমু)

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

জুলাই, ২০২০ খ্রিঃ

"সহমত ভাই"

'সহমত ভাই'

হাইস্কুলে পড়ার সময় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা অসাধারণ একটি কবিতা পড়েছিলাম। তখনকার বাংলা পাঠ্যপুস্তকে 'তোষামোদ' বিষয় নিয়ে লিখিত উক্ত কবিতা'টি ছিল নিঃসন্দেহে একজন কিশোর কিংবা কিশোরীর চরিত্র গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত। কবিতা'র শুরুটা ছিল এইরকমঃ

সাহেব কহেন, “চমৎকার ! সে চমৎকার !”

মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে !

হুজুরের মতে অমত কার ?”

পুরো কবিতা'টি নিশ্চয়ই অনেকেরই পড়া রয়েছে। এই বিশেষ কবিতার মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমস্ত মানুষ কে চাটুকারিতার ঘৃণ্য প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। অথচ সচেতনতা তো আদৌ সৃষ্টিই হয়নি, বরং সময়ের আবর্তে সেই ঘৃণ্য বিষয়'টি এখনকার একটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড এ রূপান্তরিত হয়েছে! আমাদের প্রচলিত ভাষায় তোষামোদ'কে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমনঃ তেলবাজী, তৈলমর্দন, স্তাবকতা, চাটুকারিতা, মোসাহেবি, চামচাগিরি ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায় যে, তোষামোদ খুবই জঘন্য এবং কলুষিত একটি বিষয়। কারনে বা অকারনে কারও কোন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যখন কোন অনৈতিক সুবিধা লাভ করার জন্য যদি কোন মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রশংসা তোষামোদ বা চাটুকারিতায় রূপান্তরিত হয়। এর প্রভাব সত্যিই অত্যন্ত মারাত্মক। কারণ শুধুমাত্র এই তোষামোদির মাধ্যমে একজন মানুষের নৈতিকতার যতখানি স্খলন ঘটে, অন্যান্য অনৈতিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ততখানি দৃশ্যমান হয়না। 

একুশ শতকের আজকের এই আধুনিক সময়ে যখন পৃথিবী ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির সুউচ্চ চূড়ায়, ঠিক সেই সময়েও বৃহৎ সংখ্যক মানুষ নিজের স্বতঃস্ফূর্ত মেধা ও মননের ব্যবহার কে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে দূর্বল একটি পোষা প্রাণীর মতোই নিজের প্রভুর মনোরঞ্জনে নিয়োজিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এই কারণে ক্রমবর্ধমান ভাবে নিজের অজান্তেই তারা সামাজিক স্তরে নিজের অস্তিত্ব কে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে এবং নিজেদের কালিমালিপ্ত চরিত্র কে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে!

আচ্ছা, এত জটিল বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে এসে বরং একটু সহজ কথায় বলি। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কিছু মানুষ রয়েছে যারা সর্বক্ষণ নিজের অবস্থান নিয়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। নিজেকে কিভাবে চটজলদি 'জাতে' তোলা যায়, এই চিন্তা থেকেই তারা কুলীন শ্রেণীর চারপাশে গিয়ে কুলীনত্ব নিজের গায়ে মেখে নিতে চায়। ঠিক যেভাবে কুৎসিত কাক ময়ূরের পালক ধারণ করে নিজেকে রূপবান আর অভিজাত প্রমাণের চেষ্টা করেছিল! কিন্তু এটা করে নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করার চেয়ে যে হাসির পাত্র হিসেবে প্রমাণ করা হচ্ছে, মুর্খ কাকের মগজে সেই তথ্য কখনও ঢোকেনি। আজকাল ফেসবুক সহ প্রায় সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলে নিশ্চিত ভাবেই এই প্রাচীণ কাকের আধুনিক উত্তরসূরীদের দেখতে পাবেন, যারা গাঁটের পয়সা খুইয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গায় গিয়ে দামী ক্যামেরায় ছবি তুলে, আরও দশজন কে ট্যাগ করে নিজের টাইমলাইন ভরিয়ে দিচ্ছে। বাপ-মায়ের ঘাড় ভেঙে একটি দামী ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে গলায় ঝুলিয়ে সোনামুখ করে এরা নিজেদের 'ফটোগ্রাফার' বলে পরিচয় দেয়। যে ছেলেটি শুদ্ধ বানানে একটা প্যারা লিখতে গিয়ে এর ওর প্রোফাইলে হাতা পিতা করে, সে নিজেকে 'রাইটার' হিসেবে পরিচয় দেয়! মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এদের দু'একটা কে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, পরে ভাবি- না, থাকুক। কী দরকার এদের বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে!

এই পর্যন্ত বিষয়টি মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু যখনই চোখে পড়ে কেউ একজন নিজের পরিচয় হিসাবে পিতৃদত্ত তথ্য এবং নিজস্ব যোগ্যতা কে বাদ দিয়ে কোন একজন রাজনৈতিক কিংবা বিখ্যাত একজন ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজেকে হাইলাইট করার চেষ্টা করে! উদাহরণ দিচ্ছিঃ ভাই, আপনি কে? এর উত্তর হলো- 'আমি অমুক ভাইয়ের লোক কিংবা তমুক স্যারের সমর্থক!' এটা আদৌ কি কারো ব্যক্তিগত পরিচিতি হতে পারে? আচ্ছা, বিখ্যাত ব্যক্তির পাশে সেজেগুজে দাঁড়ালে কেউ কি বিখ্যাত হয়? ময়ূরের পাশে দাঁড়ানো কাক কি ময়ূরের মর্যাদা পেয়েছে কখনও?! আমার মনেহয় কোন একজন ক্ষমতাবান মানুষের সাথে ছবি তুলে কেউ যখন সেটা প্রকাশ করে- তখন সে সম্ভবত সমস্ত মানুষকে এটা বলতে চায়, 'দ্যাখো, আমি কতবড় একজন হনু!' এখানে 'হনু' শব্দটি সবচেয়ে যুৎসই, কারণ 'হনুমান' ছিল রামচন্দ্রের অনুগত পোষ্যজীব। রাম যেখানে যেতেন, হনুও তাঁর পিছুপিছু ছুটে যেতো! রামের ক্ষমতার দাপটে হনুও নিজেকে 'হ্যাডাম' মনে করতো। আধুনিক সময়ের এইসব হনু'র সংখ্যাটা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুরুতেই যেটা বলতে চেয়েছিলাম- তোষামোদ করতে করতে এইসমস্ত 'হনু'দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এতো এতো বেশি ত্রুটি দেখা যাচ্ছে যে, আগামী প্রজন্মের মানুষ এগুলো দেখে কি শিক্ষা পাবে সেটা ভেবেই শিহরিত হতে হয়! চার্লস ডারউইন তাঁর বিবর্তনতত্ত্বে বলেছিলেন- বানর থেকে বেরিয়ে এসে কিভাবে হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এখন মনেহচ্ছে বিবর্তন হয়তো উল্টো দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীজুড়ে বিরাট সংখ্যক 'হনুস্যাপিয়েন্স' অর্থাৎ মানুষরূপী এইসব হনুদের দল লম্ফঝম্প করে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নিজেদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করবে! 

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

০৯.০৯.২০২১ খ্রিঃ

বৃহস্পতিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০

"হ্যাপি নিউ ইয়ার"

 “হ্যাপি নিউ ইয়ার”

ডিসেম্বর শেষের সেই ক্লান্তিকর আর চরম একঘেয়েমির মাঝে কাটানো সারাটা বিকেল, যেখানে তৃপ্তি বলতে শুধুমাত্র চায়ের কাপে তৃষিতের মত চুমুক দিয়ে সামান্য একটু উষ্ণতা খুঁজে নেওয়া। এই তো সব, কী দরকার এত বেশি ব্যতিক্রমতার বেড়াজালে নিজের পরিনত, বয়স্ক মনটাকে লাগাম পরাবার ব্যর্থ চেষ্টা করে? জীবন তো থেমে নেই, এই তীব্র শীতের মাঝেও থেমে থাকেনা সে কখনও। কখনও সে অভিজাত পাড়ার বার কাম ক্লাবে হুইস্কির গ্লাসে ঠিকরে পড়া হ্যালোজেনের মদিরতা কিংবা কখনও ফুটপাতের পাশে লাইটপোষ্টের নীচে’র ক্ষুদ্র দোকানে ভাপা পিঠের মধ্যকার গরম ধোঁয়া। চলমান ব্যাস্ততার ধারাবাহিকতায় কখনও কখনও আমরা তাকে খানিকটা ব্যতিক্রমতার রঙ্গীন কাগজে মুড়ে নিয়ে একটু অন্যভাবে দেখতে ভালবাসি। তবে আক্ষরিক অর্থে তো সবই এক, এক এবং অদ্বিতীয় আর অবিকৃত। কারণ সেই একই নিয়মে চলে যায় সবকিছু, মানুষ জন্ম নেয়, ধীরে ধীরে বড় হয়, স্বপ্ন আর বাস্তবের দোলাচলে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিয়ে একসময় হয় বৃদ্ধ। তারপর, সেই অমোঘ নিয়তি যার থেকে নিস্কৃতি নেই। অর্থাৎ মৃত্যুর কোলে চীরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়া। সবকিছু তো এভাবেই প্রোগ্রাম করাই রয়েছে অসীম ক্ষমতাধর একজনের দ্বারা। তাই তো শীত চলে যায়- আসে বসন্ত, রাতের আঁধার কেটে গিয়ে উদ্ভাসিত হয় নতুন সূর্যালোক, ডিসেম্বর শেষ হয়ে আসে আবার এক অদেখা জানুয়ারি, আসে নতুন একটি বছর। সেই বছরটিকে আরো একটু গতিশীলতা কিংবা নতুনত্বে সাঁজিয়ে তুলতে সবার হৃদয় টানটান করে উত্তেজনায়। সত্যিই কী অদ্ভূত বিচিত্র এই মানব জীবন! কত সরল এই জীবনের পরিব্যাপ্তি, গভীরভাবে একটু চিন্তা করলেই মনেহয় যেন ভীষণ অর্থহীন আর ছেলেমানুষি এইসব। তবুও যে বেঁচে আছি, আর বেঁচে থাকা মানেই নিজের মনকে নিত্যদিন অদেখা সুন্দর সুন্দর সব স্বপ্ন দেখানো। নিজের সাথেই এক প্রকারের লুকোচুরি লুকোচুরি খেলা, যে খেলার ফলাফল জেনেও না জানার ভান করে একটু কল্পনাবিলাশী হওয়া, সচারচর মিথ্যেভাষণে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে হাসি হাসি মুখে বলা- এই তো ভাই, ভালোই আছি। আপনি ভালো তো?

বাই দ্য্ ওয়ে- “হ্যাপি নিউ ইয়ার”...!!


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

(পুরনো দিনের নোটবুক থেকে)

মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০

"সবার ওপরে ধর্ম সত্য"

 "সবার ওপরে ধর্ম সত্য"

   

একটি জাতি হিসেবে আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশীরা এখন যথেষ্টই উন্নত। আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, চেতনা বোধের সাথে ঐতিহাসিক বাস্তবতা মিলেমিশে বিশ্বের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে আমাদের অবস্থান এখন অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু আদৌ কি তাই? একটি সভ্য জাতি হিসেবে আমরা কি সত্যিই অনেক সুসংহত? একজন সত্যিকারের বাংলাদেশী হিসেবে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করুণ তো! আচ্ছা, একটি ভুল প্রথা ভেঙে বেরিয়ে আসার সৎসাহস আমাদের বর্তমানের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠিক কতটা উপস্থিত? আমরা সঠিক ইতিহাস কিংবা তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনের জন্য কতটা আগ্রহী? একটি ভুল পথে এগিয়ে যাওয়া বৃহত্তর সংখ্যার জনগোষ্ঠীকে সঠিক দিক নির্দেশনা দিতে আমরা কতটুকু উদ্যোগী? হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর চিন্তা করতে গিয়ে আমরা প্রত্যেকেই খানিকটা হলেও বিমর্ষ হয়ে যাই। কারণটা সবার কাছেই পরিষ্কার। গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখেছি সমস্ত নিউজ পোর্টাল আর অসংখ্য মানুষের টাইমলাইন জুড়ে একটি সংবাদ ঘুরে বেড়িয়েছে, সেই সাথে প্রচুর মানুষের আনন্দ ও উচ্ছ্বাস সংবলিত কথাবার্তা। যদিও সংবাদটি ছিলো একটি মৃত্যুসংবাদ! জনৈক পীর সৈয়দ মাহবুব এ খোদা দেওয়ানবাগী মৃত্যুবরণ করেছেন, এটা শুনেই বৃহৎ সংখ্যক মানুষের মধ্যে সেকি বিজয়োল্লাস! আচ্ছা, ঠিক কেন এই মানুষটি এতটা ঘৃণিত? তার সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আমরা কয়জন ঠিকঠাক জানি? এর উত্তর দিতে গেলেও খানিকটা ঝিম ধরে থাকতে হবে। হ্যাঁ, তিনি ঘৃণিত ছিলেন তার ভুলভাল ধর্মীয় ব্যাখ্যার কারণে। অথচ, ভুল ভাবে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেওয়া আরো কিন্তু প্রচুর সংখ্যক মানুষ ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছেন। নিজস্ব নীতিতে ধর্মচর্চা করার অধিকার সবারই আছে, কথায় আছে- "নানা মুনির নানা মত"! যাইহোক, তাহলে উদ্ভট ধর্মপালন পদ্ধতির জন্য একটি মানুষ এতটাই ঘৃণিত হয়ে যান যে, তার মৃত্যুসংবাদ শুনে চরমভাবে উল্লাস প্রকাশ করা যায়। আমরা যারা নব্য প্রজন্মের মানুষ, তারা নানান ভাবেই সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ। তার মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এই ঘৃণিত ভন্ড মানুষটিই ১৯৭১' এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিন নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টারে তিনি কর্মরত ছিলেন। ৩ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল কে.এম.শফিউল্লাহ এই মানুষটিকে পরে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। উল্লেখ্য যে, সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কে.এম.শফিউল্লাহ (বীর উত্তম) এখনো জীবিত আছেন। তৎকালীন তিন নম্বর সেক্টরের অধিকাংশ অফিসার এবং সৈনিকের অত্যন্ত পছন্দের একজন মানুষ ছিলেন তরুণ মাওলানা সৈয়দ মাহবুব এ খোদা। বেশ কয়েকজন বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা তাদের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বইয়ে এই মানুষটির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। অথচ, নতুন প্রজন্মের একজন মানুষ হিসেবে আপনি মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দ মাহবুব এ খোদার ভুমিকা লিখে গুগলে সার্চ দিন, কোন তথ্যই খুঁজে পাবেন না। কেন বলুন তো? ওই যে, উক্ত ব্যক্তিটি ধর্মীয় ভাবে বিতর্কিত! আর এই কারণেই মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার ভুমিকা নিয়ে লেখার মতো ন্যূনতম আগ্রহই সবাই হারিয়ে ফেলেছেন। তার মানে কি দাঁড়ায়? একজন মানুষ কে  বিচারের মানদণ্ড হলো একমাত্র ধর্ম! মনুষ্যত্ব, বিচারবোধ, ব্যক্তি গুণাবলী থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পর্যন্ত ধূলিসাৎ হয়ে যায়, যদি ধর্মবোধে সামান্যতম টান পড়ে। এটাই যখন এখনকার প্রতিষ্ঠিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন এক বাক্যেই স্বীকার করে নিতে হয়- "সবার ওপর ধর্ম সত্য, তাহার ওপর নাই!"


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...