রবিবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

'বিড়াল বৃত্তান্ত'

 

একটা বিষয় নিয়ে অনেক দিন থেকে চিন্তা ভাবনা করে দেখলাম। এই পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম প্রাণের বিকাশ ঘটার দিনটি থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত সেইসব প্রাণী-ই এই গ্রহের বুকে দীর্ঘকাল যাবত সার্ভাইব করতে সক্ষম হয়েছে, যে সব প্রাণীরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগ করতে সফল হয়েছে। সেই প্রাগৈতিহাসিক জুরাসিক সময়ের অতিকায় ডাইনোসর পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে। সেই সময়ে কক্ষচ্যুত কিছু গ্রহাণু হঠাৎ করে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ঢুকে পড়েছিল, যার জন্য বেড়ে গিয়েছিল সালফার এবং ইরিডিয়ামের মাত্রা। কখনো কখনো সুনামির কারণে প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল বিস্তীর্ণ কোন ভূখণ্ড, এসবের ফলশ্রুতিতে হারিয়ে গিয়েছিল এক কালে পৃথিবীর বুকে দাপিয়ে বেড়ানো সেই অতিকায় প্রজাতিটি। তাদের বিলুপ্ত হবার প্রধান কারণ হলো তাদের কোন নিরাপদ আশ্রয় ছিল না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে তারা নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারেনি। অরক্ষিত অবস্থানে থাকার কারণে তারা স্রেফ ভেসে গিয়েছিল। আশ্চর্যজনক বিষয় হলো সেই জুরাসিক সময়ে আর্থ্রোপোডা পর্বের একটি ক্ষুদ্র প্রাণীও পৃথিবীতে বসবাস করত। এই ক্ষুদ্র প্রজাতিটি শুধুমাত্র নিজেদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করতে পারার জন্যই তখন বেঁচে গিয়েছিল নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগর হাত থেকে এবং এই পার্থিব পরিবেশে বিভিন্ন ভাবে বিবর্তিত হতে হতে এখনও পর্যন্ত তারা টিকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্ব। এই ক্ষুদ্র প্রজাতির প্রাণীটির নাম পিঁপড়া।

হ্যাঁ, যেটা শুরুতেই বললাম, এই পৃথিবীতে সেইসব প্রাণীরাই নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, যারা বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত। ডাইনোসরের চেয়ে এই জায়গায় হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটি অনেক অনেক এগিয়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটিয়ে আমাদের পুরোপুরি ভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়া যায় না, কারণ আমরা অন্য প্রজাতিদের টিকে থাকার প্রক্রিয়া কে নিখুঁতভাবে লক্ষ্য করে এবং নিজেদের বুদ্ধিমত্তার প্রসারের দ্বারা নতুন নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব কে রক্ষা করতে শিখেছি। পৃথিবীতে এখনো বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেও আমরা পিঁপড়ের মতন কোথাও না কোথাও নিজেদের ঠিকই সুরক্ষিত করতে পারি। আচ্ছা জানেন, বর্তমানে মানুষের পর কোন প্রাণীটি বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশল প্রয়োগের ক্ষমতায় খুবই দক্ষ? হ্যাঁ, বলছি। তবে সেটা বলার আগে একটি বিষয় বলে নেওয়া দরকার। এই পৃথিবীতে চিরায়ত একটি আত্মরক্ষার প্রাচীণ কৌশল রয়েছে। সেটা হলো- ক্ষমতাবানের সাথে আঁতাত করে চলার পদ্ধতি। বিষয় টা এমন- মনে করুণ, আপনি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে বেশ দূর্বল, তাহলে আপনি সহজেই কিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন? সেটা হলো ক্ষমতাবান কারো সংস্পর্শে যাওয়া এবং ক্ষমতাবানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা। এটা করতে পারলে আপনার নিজস্ব কোন যোগ্যতা না থাকলেও ক্ষমতাবান লোকটি আপনাকে রক্ষা করবেন। এই প্রক্রিয়ার সফল প্রয়োগ করে বর্তমান সময়ে একটি বৃহৎ সংখ্যক মানুষ বেঁচেবর্তে আছেন, যাদেরকে আমরা প্রচলিত ভাষায় চামচা, চাটুকার, তেলবাজ, মোসাহেব, তোষামোদকারী ইত্যাদি বলে অভিহিত করি।

যাইহোক, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় একটি বিশেষ প্রজাতির প্রাণীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল যে, মানুষ খুবই ক্ষমতাবান একটি প্রজাতি। তাই তারা একটু একটু করে মানুষের সান্নিধ্যে যাওয়া শুরু করেছিল। তারা মানুষ কে খুবই ভালোভাবে লক্ষ্য করার পর মানুষের মেজাজ-মর্জি বুঝে এরপর নিজেদের পেশ করা শুরু করল। তাদের এই মিশুক আচরণ দেখে একটা সময় মানুষেরাও তাদের কে কাছে টেনে নিতে বাধ্য হলো। এই বিশেষ প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নাম 'ফেলিস ক্যাটাস', আমরা ওদেরকে প্রচলিত ভাষায় বিড়াল বলি। এই ক্ষুদ্রকায় প্রাণীটি বহুকাল আগে জঙ্গলের অনিরাপদ পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে ছিল, তাদের খাবার এবং নিরাপদ আশ্রয়ের সংকটময় পরিস্থিতি তাদেরকে একটা সময়ে নতুন ভাবে নিজেদের বিকশিত করার পন্থা সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়, যখন তাদের সাথে মানুষের দেখা হয়েছিল। বিড়ালেরা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, মানুষ নামের এই বিচিত্র প্রাণীটি-ই হবে তাদের তুরুপের টেক্কা, তাদের সাবলীলভাবে বেঁচে থাকার অবলম্বন। এরপর তারা তাদের ভূতপূর্ব জঙ্গলের সেই কঠোর জীবন ছেড়ে মানুষের সাথে হেঁটে হেঁটে একটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে লোকালয়ে চলে আসে। মানুষ যদিও প্রাথমিকভাবে বিড়াল কে নিয়ে এসেছিল নিজস্ব কিছু স্বার্থসিদ্ধির জন্য, মানুষের জীবনের কিছু চরম উপদ্রবের মধ্যে অন্যতম ছিল সাপখোপ, ইঁদুর, তেলাপোকা থেকে শুরু করে বেশকিছু ক্ষতিকর পোকামাকড়। এইসব অযাচিত উপদ্রবের বিনাশের লক্ষ্যে ওদের প্রথম নিয়ে আসা হয়। কিন্তু মানুষ একটা সময়ে নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে যখন সেইসব ক্ষতিকর উপদ্রব কে কৃত্রিম ভাবে দমন করতে সক্ষম হয়েছে, তখন বিড়ালের আর মানুষের জন্য বিশেষ কিছু করার ছিল না। তারা তখন মানুষের সাথে স্রেফ বন্ধুত্ব করে টিকে থাকল। একটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়, মানুষ নিজের প্রয়োজনে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কুকুর, ঘোড়া, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি অসংখ্য গৃহপালিত পশু লালন-পালন করে। এইসব পশুদের প্রত্যেকেরই কিছু নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে এবং সেইসব কাজের জন্যেই মানুষের কাছে এদের গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম হলো বিড়াল, যার মানুষের জন্য বিশেষ কিছু করার নেই। বেশ আগে থেকেই বহুবিধ কীটনাশক এবং যাঁতাকল ব্যবহার করে ইঁদুর এবং পোকামাকড় নিধন করা হয়। তাহলে মানুষের জীবনে বিড়ালের ভূমিকা কি? এর উত্তর আগেই বলেছি, এই প্রাণীটি মানুষের সাথে স্রেফ বন্ধুত্ব করে টিকে আছে। এরা নিঃসঙ্গ মানুষের জীবনে চমৎকার একজন সঙ্গী হিসেবে অবস্থান করে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি অদ্ভুত তথ্য জেনেছিলাম। জেলখানায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের দীর্ঘদিন ধরে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের থেকে দূরে থাকতে হয় বলে তারা জেল কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি নিয়ে তাদের সাথে এক বা একাধিক বিড়াল রাখে। তাদের দীর্ঘ দিনের নিঃসঙ্গ জীবনে বিড়ালগুলো তাদের ঘনিষ্ঠ আপনজনের মতন পাশে থাকে। বিড়াল-ই একমাত্র প্রাণী, মানুষের খাবারঘর থেকে বিছানা পর্যন্ত যাদের অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে। মানুষের সাথে দীর্ঘকাল সহাবস্থানের জন্য এরা ভালোভাবে মানুষের মনস্তত্ব বুঝতে পারে এবং সেভাবেই নিজেদের রিপ্রেজেন্ট করে।
মানুষের পরে এরাই হলো সেই প্রাণী, যারা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি প্রজাতির সাথে সার্বক্ষণিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রেখেছে, এটা নিঃসন্দেহে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সফল প্রয়োগ। দিন কে দিন মানুষের কাছে এদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। একটি বিষয় মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়- মানুষ যতদিন পর্যন্ত এই গ্রহে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে, এই মার্জারগোষ্ঠীও ততদিন পর্যন্ত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হবে। যদি কোনদিন পৃথিবীর আবহাওয়া মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং মানুষ যদি কখনও অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কোনো অজানা গ্রহে গিয়ে বসতি স্থাপন করে, নিশ্চিত থাকুন- মানুষ তার সাথে করে এই 'জিনিস' সেই গ্রহেও টেনে নিয়ে যাবে। কারণ ঘনিষ্ঠ সহাবস্থান খুবই সিরিয়াস একটি বিষয়। ভালো থাকুক প্রতিটি মানুষ এবং তাদের পার্থিব পোষ্যবর্গ!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
১১.০২.২০২৩ খ্রিঃ

বুধবার, ২ মার্চ, ২০২২

'স্যাডিজম'

 'স্যাডিজম'

(মনস্তাত্ত্বিক ভুবনের এক ধ্বংসাত্মক রাজ্য)


গত কয়েকটি দিন ধরে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলাম। মানুষ হিসেবে আমাদের বলা হয় 'সৃষ্টির সেরা জীব', কারণ চিন্তাশীলতা প্রয়োগ করে এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেদের প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছি, যেটা অন্যান্য পার্থিব প্রাণীর ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- আমাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য চমৎকার গুণের সমন্বয় ঘটেছে, তেমনি আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মনের গহীনেই লুকিয়ে রয়েছে বিশাল ভয়াবহ অন্ধকার রাজ্য! নিজেদের মনের গভীরের এই অন্ধকারাচ্ছন্নতা সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। এই ভয়াবহ অন্ধকার জগতের ছোট একটি রাজ্যের নামঃ 'স্যাডিজম'। হিউম্যান সাইকোলজিতে 'স্যাডিজম' নামক বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে বিশ্লেষণ এবং মানব সমাজে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়। আসুন, এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে একটু আলোচনা করা যাক।


স্যাডিজমঃ

অন্যকে কষ্ট দিয়ে কিংবা অপরের দুঃখ–কষ্ট দেখে আত্মতুষ্টি লাভ করা কে এককথায় 'SADISM' বলা হয়। আর যে ব্যক্তির মধ্যে এই নেতিবাচক গুণটি অতিরিক্ত মাত্রায় দৃশ্যমান তাকে আমরা SADIST (স্যাডিস্ট) বলে থাকি। একটু অন্যভাবে যদি বলা হয়- তবে অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা, অপর'কে মানসিকভাবে নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ লাভ করাই স্যাডিজম। অর্থাৎ এক কথায় এই বিষয়টি একধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ততা ছাড়া কিছু নয়।

'স্যাডিজম' এর কোন সুনির্দিষ্ট প্রকারভেদ ও প্রকৃতি নেই। বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে এটি বিভিন্ন রূপে এবং বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পায়। যিনি এই মানসিক বিকারগ্রস্থতায় আক্রান্ত, তিনি অবচেতন মনেই রোগটি লালন করে থাকেন। 'স্যাডিস্ট' ব্যক্তিবর্গের সামাজিক অবস্থানভেদে এর প্রকৃতি এবং রূপও ভিন্ন হয়ে থাকে।

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত বিরূপ প্রকৃতি, বনের হিংস্র জীব-জন্তুর সাথে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। চার্লস ডারউইনের 'সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট' থিওরী সেই আদিকাল থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজও প্রাসঙ্গিক এবং পরীক্ষীত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত। শুধু পার্থক্য হচ্ছে- এখন মানুষই মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্য কেউ নয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে মানুষকে টিকে থাকতে হচ্ছে বর্তমানের পৃথিবীতে। এই প্রতিযোগীতায় যিনি শক্তিমান তিনি সর্বদা দুর্বলকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, আর দুর্বল চেষ্টা করছেন শক্তি সঞ্চয় করে শক্তিমানকে ছাড়িয়ে যেতে। এভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বীতা এক সময় 'স্যাডিজম' এর দিকে মোড় নেয়। অর্থাৎ শক্তিমান বা উপরস্থ ব্যক্তি দুর্বল বা অধস্তনকে দাবিয়ে রাখার অস্ত্র হিসেবে তাকে পদে পদে হেনস্থা বা অপদস্থ করে মনে আত্মপ্রশান্তি অনুভব করেন। এক একজন মানুষের অবচেতনা কে সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এটার উপস্থিতি এতটাই কম যে, সেটা তার ব্যক্তিগত জীবন কে প্রভাবিত করার সুযোগ পায় না। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিভাবে স্যাডিজম বিষয়টি রয়েছে, তা একটু সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করি।


মনে করুণঃ আপনি একটি রাস্তা থেকে যাচ্ছেন, হঠাৎ করে দূরে একটি বিকট শব্দ শুনলেন। লোকজনের চিৎকার শুনে বুঝলেন একটি দূর্ঘটনা ঘটেছে। আপনার মন কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবেই দূর্ঘটনার একটি বীভৎস ছবি তৈরি করে নিয়েছে আপনার মনের মধ্যে। আপনি ভেবে রেখেছেন দূর্ঘটনার স্থানে একাধিক মৃতদেহ, থেঁতলে যাওয়া মানুষের রক্তাক্ত শরীর এবং আরও অনেক বীভৎস দৃশ্য অপেক্ষা করছে যা দেখে আপনি শিউরে উঠবেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে আপনি সেখানে পৌঁছে গিয়ে যদি দেখতে পান দূর্ঘটনায় কারোই তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, আপনার মনটা তখনই আশাহত হবে। কারণ আপনি ভেবেছিলেন ওখানে কোন একটা বীভৎসতা অপেক্ষা করে আছে এবং সেই দৃশ্য দেখতেই আপনি উৎসুক। কিন্তু যখন দেখলেন সেখানে সবাই সুস্থ আর স্বাভাবিক রয়েছে, তখনই আপনি নিরাশ হলেন। এই নিরাশাজনক মানসিক অবস্থাই আপনার ভেতরের স্যাডিজম।

ধরুন, আপনার এলাকায় আবহাওয়া খুবই দুর্যোগপূর্ণ। আবহাওয়া অধিদপ্তর বারবার করে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জানিয়ে ঘোষণা দিচ্ছে। আপনার এলাকার দিকে ধেয়ে আসছে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়। আপনি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার মনের ভেতরে ধ্বংসযঞ্জের একটি কাল্পনিক চিত্র তৈরি করলেন এবং তার জন্য অগ্রীম ব্যথিত হয়ে সেই ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে ঘূর্ণিঝড়টি দূর্বল হতে হতে একটা সময় মিলিয়ে গেল এবং আপনার এলাকা সুরক্ষিত থেকে গেল। সেই মুহূর্তেও আপনি হতাশ হবেন, কারণ আপনি একটি ধ্বংসাত্মক ঘটনার মুখোমুখি হবার জন্য তৈরি হয়ে বসেছিলেন। একটি ধ্বংসাত্মক ঘটনা না ঘটার জন্য আপনার মনে যে হতাশার সৃষ্টি হয়, ওটাই আপনার স্যাডিজম।

মনে করুণ, আপনার শৈশবের সময়কার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে, যার সাথে আপনি সুখে-দুঃখে দীর্ঘ একটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। যার সাথে জড়িয়ে আছে আপনার অসংখ্য স্মৃতিময় অধ্যায়। হঠাৎ করেই সেই বন্ধুটি চমৎকার একটি চাকরি পেয়ে গেল কিংবা বড়সড় অর্থের মালিক হয়ে সমাজে একটি উচ্চতর জায়গায় পৌঁছে গেল, আপনি কিন্তু প্রিয় বন্ধুর এই সাফল্যের ঘটনায় মন থেকে খুশি হতে পারবেন না। সংগোপনে এই বন্ধুটির সাফল্য আপনাকে ঈর্ষান্বিত করবে। এই ঈর্ষা-ই আপনার ভেতরের স্যাডিজম। এইধরণের হাজারো উদাহরণ রয়েছে আমাদের মতো সকল মানুষের ভেতরকার স্যাডিজমের। যাইহোক, লেখাটি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম- গত কয়েকটি দিন ধরেই সারা পৃথিবীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ একধরণের উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে যে, ঘটনার ফলশ্রুতিতে শেষমেশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় কিনা! সবাই বাইরে থেকে এসব যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বিপক্ষে সজোরে হেঁকে যাচ্ছে কিন্তু ট্রাস্ট মি- প্রায় পঁচানব্বুই শতাংশ মানুষই আশা করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাক। তারা সবাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে এর বীভৎসতা দেখতে চায়। এখানে কিন্তু কারোরই কোন দোষ কিংবা অপরাধ নেই। তার অবচেতন মনের স্যাডিজম তাকে এভাবে ভাবতে বাধ্য করে। কারণ মানুষ এই পৃথিবীর যতবড় সৃষ্টির সেরা জীব হোক না কেন, মানুষ- ই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যে কিনা সৃষ্টি ধ্বংসকারী!


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

০১.০৩.২০২২ খ্রিঃ

রবিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২

'অর্থহীন পরাবাস্তবতা'

 (অর্থহীন পরাবাস্তবতা)


'....আজ খুব ভোরেই টিয়া'র ডাকে আমার ঘুম ভেঙেছে। খুব বিরক্তি নিয়ে আমি চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করলাম, ঠিক কোথায় এখন আমি! প্রচন্ড রকম বিরক্তিতে আমার কপাল কুঁচকে আছে। টিয়া তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট অনুযায়ী একঘেয়ে গলায় আমাকে ডেকেই যাচ্ছে, একটা প্রচন্ড লাথিতে টিয়া'কে ঘরের অন্যপাশে ছুড়ে ফেলার ইচ্ছেটাকে অতি কষ্টে দমন করে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। এরপর টিয়া কে কোলে নিয়ে একটু আদর করে ওকে বিস্কুট খেতে দিলাম। 'টিয়া' আমার অতি প্রিয় পোষা একটি মাঝ বয়সী বিড়াল! আমি দীর্ঘদিন ধরেই একা একা থাকতে শিখেছি; শিখে নিয়েছি একা পথ চলতে। তবে দিনের শেষে যখন চারিপাশ অন্ধকার করে নিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে, যখন সর্বত্র টিমটিম করে একটির পরে একটি আলো জ্বলে ওঠে; জানিনা ঠিক কেন- তখন প্রচন্ডরকম এক নিঃসঙ্গতাবোধ যেন অষ্টাঙ্গিক দৃঢ়তা নিয়ে অক্টোপাসের মতোই জড়িয়ে ধরে আমার ভেতরের নিজস্ব সত্তাটুকু! আর তাই সম্ভবত; নিঃসঙ্গতা আর নীরবতার এই একপেশে খুনসুটি কে উপেক্ষা করার জন্যেই আমার এই বিড়ালপ্রীতি! হ্যাঁ, যেটা বলছিলামঃ আজকাল ঘুমাতে বড্ডই দেরি করে ফেলছি, যার কারণে খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভীষণ অস্বস্তি হয়। সকালের আলোটুকু চোখে একবার পড়লে, নতুন করে ঘুমাতে যাওয়াও বেশ কষ্টকর! কি আর করা, চুলায় চায়ের পাত্র চাপিয়ে বসে আছি। একটু একটু করে ফুটন্ত বাষ্প জানালা দিয়ে বের হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে এই অস্থির জানুয়ারী'র মধ্য প্রহরের ধোঁয়াটে সাবলীল বাতাসে। বাইরে কি মুক্ত বাতাস! সকালের আকাশটাও তার সমস্তটুকু মুগ্ধতা ছড়াতেই যেন ব্যাস্ত। অথচ, আজ প্রায় দিন দশেক ধরে বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে সময়টা সত্যিই যেন খানিকটা থমকে আছে! জানিনা, আবার কবে বাইরে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবো; কবে আবারও গলা খুলে গাইবো! জানিনা, কিছুই জানিনা আমি। শুধু এটুকুই জানিঃ চলমান সংকট এখন কিছুটা বীভৎস কোনো সায়েন্স ফিকশনের মতোই  মনে হচ্ছে, যার সমাপ্তি অকারণেই যথেষ্ট দুর্বোদ্ধ; অথবা আমি আসলে এখন  ঘুমিয়েই আছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি; এই জানুয়ারী মাসের সকাল, চুলার ফুটন্ত বাষ্প কিংবা আমার গায়ে আলতো ছুঁয়ে লেজ বুলিয়ে যাওয়া আমার প্রিয় পোষা বিড়াল, সবই সেই দুঃস্বপ্নেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়তো একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠবো, উঠে দেখতে পাবো সব কিছুই খুব স্বাভাবিক অবস্থায় আছে; যেমনটি ছিলো আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগেই......!'


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

শুক্রবার, ২২ অক্টোবর, ২০২১

'নিজস্ব এক্সপেরিমেন্ট'

 

প্রায় এগারো বছর ধরে ফেসবুক সহ সোশ্যাল মিডিয়ার আরও দু'একটা সাইটে যুক্ত থাকার কারণে অনেক দিন থেকেই একটি কথা বেশ জোরেশোরে শুনতে পাই। কথাটি হলোঃ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোন একটি মেয়েকে প্রতিনিয়তই আবশ্যিক ভাবে অনাকাঙ্খিত কিছু উপদ্রবের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু এই উপদ্রবের মাত্রা আসলে কতটা গুরুতর এবং এজাতীয় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে স্বাভাবিক একটি মানুষ হিসেবে একজন নারী  আসলে কতটুকু বিড়ম্বনার শিকার হন, এই বিষয়ে আমার কখনোই পরিষ্কার কোন ধারণা ছিলনা। যাইহোক, বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবার জন্য হঠাৎ করেই একটি এক্সপেরিমেন্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অত্যন্ত সহজ এবং শতভাগ কার্যকরী পদ্ধতি ছিল এটা।

কিছুদিন আগে মোটামুটি চেহারার অখ্যাত একজন নারী মডেলের কয়েকটি ছবি ব্যবহার করে একটি ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ক্রিয়েট করলাম, উক্ত প্রোফাইলে এমনভাবে সমস্ত তথ্য সংযোজন করলাম যাতে ওটা ভিজিট করতে গিয়ে কারোর মনে কোন প্রকার সন্দেহের সৃষ্টি না হয়। এরপর আরও একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমার কয়েকটি লেখা উক্ত এ্যাকাউন্টে সেই মেয়েটির নাম দিয়ে পোস্ট করে দিলাম। এবারে হাতেনাতে ফলাফল পেতে শুরু করলাম। অসংখ্য অসংখ্য ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসতে শুরু করলো, বলাই বাহুল্য তাদের নিরানব্বই শতাংশই আমার জাতভাই একেকজন 'সিংহ পুরুষ'! তারা ফ্রেন্ডলিস্টে যুক্ত হয়েই ইনবক্সে এসে ইনিয়েবিনিয়ে নানান খুটিনাটি সস্তা ধরনের কথাবার্তা বলে অচেনা মেয়েটির মনোরঞ্জনে নিজেদের নিয়োজিত করলেন। দু'একজন তো একধাপ এগিয়ে গিয়ে নিজেদের পৌরুষ বিকৃত ভাবে প্রদর্শন করে বিভিন্ন কুৎসিত ছবি এবং অশ্লীল ভাষায় মন্তব্য প্রদান করলেন। আমি তাদের পাঠানো টেক্সটগুলো দেখে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম! একটু কৌতূহলী হয়ে তাদের প্রোফাইল ঘুরে দেখে সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হয়েছি। যদিও বেশকিছু ফেইক এ্যাকাউন্ট ছিল, তবে যৌন বিকারগ্রস্থ সেইসব মানুষের অনেকেই নিজের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সম্বলিত প্রোফাইল ব্যবহার করেন। আমি ভীষণ রকম অবাক হয়ে দেখলাম তাদের কয়েকজন কিছুদিন আগেই 'ডটার্স ডে' উপলক্ষে নিজের ফুটফুটে কন্যা সন্তানটিকে কোলে নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে ছবি তুলে আপলোড দিয়েছেন, কয়েকজন নিজের ছোটবোনকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠার মুহূর্ত ফ্রেমবন্দী করেছেন, কারো কারো ওয়ালে শোভা পাচ্ছে নিজের প্রেমিকা কে নিয়ে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাবার প্রেমময় মুহূর্ত, কেউ সস্ত্রীক নিজের সুখী দাম্পত্য জীবন কে বাহুল্য বর্ণনায় ভরিয়ে তুলেছেন! 

ওনারা প্রত্যেকেই এই সোসাইটিতে বসবাস করেন, প্রত্যেকেরই রয়েছে সুন্দর এনভায়রনমেন্টের একটি পারিবারিক জীবন। অথচ তারাই আবার সামাজিক যোগাযোগের একটি মাধ্যমে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে অপরিচিত একটি মেয়েকে গোপনে উত্যক্ত করে তীব্র মানসিক সুখ লাভ করছেন। এই পরীক্ষাটি করতে গিয়ে আমি সাংঘাতিক একটা ধাক্কা খেয়েছি, কারণ আমার বাস্তব জীবনে পরিচিত দুই-চারজন মানুষও আমার এই ফেইক এ্যাকাউন্টে এসে গদগদবচনে প্রোফাইলের মেয়েটির রূপের বন্দনা করে গেছেন! আমার জানতে ইচ্ছে করে- আমাদের বাঙালী সমাজের ম্যাক্সিমাম পুরুষেরাই কি নিজেদের অবচেতনে অবদমিত কামনা লালন করেন? ওনারা সংগোপনে প্রত্যেকেই কি যৌন বিকারগ্রস্ত? তাদের মধ্যে কি ব্যক্তিত্বের এতো বেশি স্খলন ঘটেছে? এর জবাব পেতে নিজেকে ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব গবেষণা করার দরকার পড়েনা। আমার ওই তিনটি প্রশ্নের প্রতিটির জবাবই 'হ্যাঁ'! দিন কে দিন নৈতিকতার এত বেশি অধঃপতন ঘটেছে যে- ওনাদের কারণে অনেক মেয়েরা এখন 'ফেসবুকের ইনবক্স কিভাবে বন্ধ করা যায়' লিখে গুগলে সার্চ করে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের পন্থা কি নেই?! অথচ এভাবে কি চিন্তা করা যায় না- আপনি একজন পুরুষ। আপনার মেধা মনন, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিত্ব আর মার্জিত আচরণ দেখে একজন নারী আপনার প্রতি মুগ্ধ হবে!

ভাই, আপনি একজন পুরুষ। এই প্রকৃতি আপনাকে উদার হিসেবে, সুন্দর হিসেবে, শক্তিশালী হিসেবে, দায়িত্বশীল হিসেবে সৃষ্টি করেছে। নিজের প্রতি একটু তো সুবিচার করুণ! আপনার সামান্য কিছু ভুলের জন্য বিপরীত লিঙ্গের একজন মানুষের কাছে আমাদের সবাই কে এভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার কোন অধিকার আপনার নেই। ঠিক যেভাবে পারিবারিক জীবনে আপনি একজন অনুগত সন্তান, প্রেমময় প্রেমিক, দায়িত্বশীল স্বামী এবং স্নেহময় পিতা এবং বড়ভাই, ঠিক সেভাবেই নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পেশ করুণ। কারণ আপনার পরিবার এবং আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে যেমন সমাজ ব্যবস্থা গঠিত হয়েছে, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়াও আপনার সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজেকে পাল্টান, পাল্টে যাবে আপনার চতুর্পাশের পরিবেশ। আপনার সামান্য একটু সচেতনতাই আমাদের আগামী প্রজন্ম কে একটি সুস্থ সমাজ ব্যবস্থা উপহার দিতে পারে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১০.১০.২০২১ খ্রিঃ

শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

"গল্প এবং বাস্তবতা"

 "ইনফার্নো এবং চলমান করোনা পরিস্থিতি"


অনেক দিন আগে ড্যান ব্রাউনের লেখা 'ইনফার্নো' বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ আবারও পড়লাম, এই উপন্যাসটি সত্যিই মাথা খানিকটা হলেও এলোমেলো করে দেয়। বিশেষতঃ ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি তত্ত্ব এবং তার থেকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পরিত্রাণ লাভের যে সংগতি উপস্থাপিত হয়েছে, সেটা সত্যিই অনবদ্য। তাতে হোক সেটা অসীম ক্ষমতাধর কোন অদৃশ্য মহাশক্তির অঙ্গুলিহেলনে কিংবা প্রাকৃতিক নিয়মে অথবা অতি প্রতিভাবান কোন মানুষের উদ্ভাবিত পন্থায়।

ম্যালথাসের তত্ত্বটি দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিতঃ

ক) মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন।

খ) নারী ও পুরুষের পারস্পারিক আকর্ষন ও সম্পর্ক অপরিবর্তনশীল।

ম্যালথাসের বক্তব্য হলোঃ স্ত্রী পুরুষের মধ্যে পারস্পারিক আকর্ষনে জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি ২৫ বছরে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে। অর্থাৎ খাদ্য শস্যের উৎপাদন যদি গানিতিক হারে বৃদ্ধি পায়, জনসংখ্যা তখন বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। তাহলে এর থেকে প্রতিকারের উপায় কি? শুনতে অত্যন্ত অমানবিক নিষ্ঠুর মনে হলেও এর সহজ প্রতিকার কিন্তু ঠিকই আছে। হ্যাঁ, এই সমস্যা থেকে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে কোন একটি অদ্ভুত উপায়ে বিরাট সংখ্যক জনসংখ্যা কে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সেটা হোক নিউক্লিয়ার ওয়েপন ব্যবহার করে কিংবা 'বিশেষ' কোন জীবাণুর সংক্রমণ ঘটিয়ে। অতঃপর যে জনসংখ্যা টিকে যাবে, তারাই আবার পৃথিবীর সাথে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রত্যক্ষভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এবারে আসা যাক গল্পের অংশে। ড্যান ব্রাউনের 'ইনফার্নো' উপন্যাসে দেখা যায় একজন বিপথগামী মেধাবী বিজ্ঞানীর গবেষণায় সৃষ্ট 'জোবরিস্ট' ভাইরাস এর বাহক হলো নিরীহ মানবগোষ্ঠী। মানবদেহের কোষে অনুপ্রবিষ্ট এই ভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেধাবী বিজ্ঞানীদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। উপন্যাসের শুরুতে দেখা যায় নায়ক রবার্ট ল্যাংডন ইতালির ফ্লোরেন্সের একটি হাসপাতালের ঘরে জেগে ওঠার পর আবিষ্কার করেছিলেন যে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা- 'দ্য কনসোর্টিয়াম' এর লক্ষ্যবস্তু। তিনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন ফ্লোরেন্সে তিনি কী করছেন? তিনি এখানে কীভাবে এলেন? কে তাকে হত্যার চেষ্টা করছে? ইত্যাদি। তাকে বত্তিচেলি'লা মাপা হেল' 'ইনফর্নো' অবলম্বনে সৃষ্ট এই মানচিত্র বোঝাতে হবে। চিকিৎসক সিয়েনাসহ ক্লু উন্মোচন করার সাথে সাথে ল্যাংডন আবিষ্কার করলেন যে একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী বিশ্বের বেশি জনসংখ্যার সমস্যা সমাধানের জন্য ইউরোপের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মুছে ফেলার এক অন্যতম ধ্বংসাত্মক দুর্ঘটনা "ব্ল্যাক ডেথ" এর মতন প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তবে ধরা পড়ল যে বিজ্ঞানী আত্মহত্যা করেছেন এবং ভাইরাসটি অজানা স্থানে লুকিয়ে রেখে গেছেন। অবস্থানটির সংকেতগুলি দান্তে এবং ইনফার্নোর সাথে সম্পর্কিত সমস্ত চিহ্নগুলির অনুক্রমের মধ্যে এনক্রিপ্ট করা হয়েছে, যা ল্যাংডন ক্রমান্বয়ে উন্মোচন করেন। কিন্তু তার আগেই 'জোবরিস্ট ভাইরাস' ছড়িয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। বর্তমানের করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ও নিরীহ মানুষের মৃত্যুর সময়ে 'ইনফার্নো' আমাদের একটি বিষয়ে দারুণ ভাবে সাদৃশ্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে, তা হলোঃ ম্যালথাসের থিওরী অনুযায়ী পার্থিব জনসংখ্যার বিস্ফোরণ থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করার জন্য প্রকৃতি কিভাবে তার সাম্যাবস্থা বজায় রাখে!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/  

২৯.০৪.২০২১ খ্রিঃ

"এলোমেলো ভাবনা"


একটা অদ্ভুত ব্যাপার নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে খুব করেই ভাবছি। বিষয়টা যে নিতান্তই হাস্যকর, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবুও এটাকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারছিনা, বলেই এই লেখা। আমি যখন হুমায়ূন আহমেদের লেখা বই পড়া শুরু করি, তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। আর “হিমু” ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়- যখন সবে কলেজে ভর্তি হলাম। তখনকার সময়ে আমার বয়েসী অনেক ছেলেকেই দেখেছি হলুদ পাঞ্জাবী পরে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে, সমস্ত সময়ই এই ব্যাপারটা আমার কাছে যথেষ্টই হাস্যকর মনে হয়েছে। তবে “হিমু” চরিত্রটি যে অসম্ভব রকমের আকর্ষনীয়; এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।  কারণ হুমায়ূন আহমেদ বলেছেনঃ হিমুর বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলেকে মহাপুরুষ হিসাবে গড়ে তুলতে, যদিও কাজটি তার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে হিমু যে অস্বাভাবিক ধরনের একজন মানুষ, তা এক বাক্যেই স্বীকার করে নিতে হয়। যাইহোক, মুল কথায় ফেরা যাক। তিন/চারদিন আগে আমার পরিচিত একজন আমাকে ডেকে নিয়ে বললঃ দাদা, আপনাকে একটা কথা বলি- "কথাটা সিরিয়াস", এরপর আমি তার সিরিয়াস কথা শুনে নিজেও বেশ সিরিয়াস ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছি! সে বলেছিলো, আমি নাকি “হিমু” দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত। আর এই কারনেই আমার স্বাভাবিক জীবন ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হচ্ছে। পরে একাকী বসে অনেক সময় নিয়ে ভেবেছি এই বিষয়টি নিয়ে। আসলেই কি তার কথা সত্য? হিমু বলতে আমরা যে চরিত্রটি'কে চিনি, তার আসলে প্রচলিত নিয়মে কোন কাজ নেই। তার কাজ হল রাস্তায় রাস্তায় হাঁটা-হাঁটি করা আর নানা প্রকারের অস্বাভাবিক কর্মকান্ডের দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করা। হিমুর টাকা-পয়সার প্রতি বিশেষ কোন মোহ নেই, আর সেই কারনেই সে কখনও কোন প্রকারের চাকুরী কিংবা অন্য কাজের সাথে যুক্ত হয়না।  তার পোষাক পরিচ্ছদও নিতান্ত ছাপোষা। কারন মহাপুরুষদের অর্থের প্রয়োজন নেই কিংবা তাঁদের পোষাক হতে হয় বাহুল্যবর্জিত। এছাড়া হিমু কখনও কোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়না, সে চীর ব্রক্ষ্মচারী পুরুষ, কারন সংসারের প্রতি মোহ থাকলে মহাপুরুষ হওয়া যায়না। হিমুর অনেক আত্মীয়-স্বজন কিংবা কাছের বন্ধুরা তাকে নিয়ে খুবই চিন্তিত থাকে। হিমুর থাকার জায়গাটা হতে হয় যথেষ্ট অপরিচ্ছন্ন আর এলোমেলো, যেকোন মানুষ হিমুর ঘরে গিয়ে চমকে উঠে ভাবে এখানে মানুষ থাকে কিভাবে? অথচ হিমুর এসব নিয়েও কোন চিন্তা ভাবনার অবকাশ থাকেনা। শহরের দাগী সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে ফুটপাতের চা বিক্রেতা, রিক্সাওয়ালা,  ভিখারী কিংবা ভ্রাম্যমান পতিতা, সবার সাথেই হিমুর পরিচয় থাকে। হিমুর অন্যতম আর একটা উল্লেখযোগ্য কাজ হল পূর্নিমা রাত্রে জোৎস্না উপভোগ। এক কথায় বলা যায় তার জীবন যাপন পদ্ধতি খুবই বিচিত্র, আর সত্যিকার অর্থেই এই ধরনের মানুষের প্রতি সবারই এক ধরনের আগ্রহ থাকে। আমরা সমাজে প্রতিনিয়ত একঘেয়ে জীবন যাত্রা দেখে দেখে অভ্যস্ত, তাই হঠাৎ করে কিছু ব্যাতিক্রমতা আমাদের স্বভাবতই এক ধরনের ঘোরে আচ্ছন্ন করে। এটাই চীরায়ত দৃষ্টিতে আমাদের হিমু দর্শন। এখন নিজের কথা বলি- হ্যাঁ, অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে, আমিও প্রথাগত জীবন যাপন পদ্ধতির অনেকটা বাইরে থেকে থেকে অভ্যস্ত। যেমন আমার কোন টাকা-পয়সার প্রতি মোহ নেই, কোন বিশেষ খাবার অথবা পোষাক আমাকে টানেনা। আমার ব্যক্তিগত থাকার জায়গাটা ভীষন অগোছালো আর অপরিচ্ছন্ন থাকে, যেকোন সমস্যার কারনে এখনও পর্যন্ত আমি কোন চাকরী অথবা ব্যাবসার সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারিনি। হ্যাঁ, উটকো দার্শনিক টাইপের কথা বলে আমিও মানুষকে বিভ্রান্ত করে মজা পাই। সমাজের অতি নিম্নশ্রেনীর মানুষের সাথেও আমার এক ধরনের গভীর সখ্যতা আছে। আমি এখনও পর্যন্ত কোন নারীর সাথে নিজেকে জড়াইনি, আর আপতদৃষ্টিতে সংসার করারও কোন ইচ্ছে নেই। আর সবচেয়ে অবাক বিষয় হল- পূর্নিমার চাঁদের প্রতি আমি বিশেষ ভাবে দুর্বল। সবকিছু মিলিয়ে এক কথায় বলে দেওয়া যায় যে, আমি হিমুকে ফলো করতে করতে এমনটা হয়েছে। অথচ সত্যিটা আদৌ তা নয়। “হিমু” জাষ্ট আমার কাছে উপন্যাসের একটা চরিত্র মাত্র, যা হুমায়ূন আহমেদ স্যার অনেক যত্নে সৃষ্টি করেছেন। মহাপুরুষ হবার বাসনাও আমার নেই। যেটা আমার সাথে ঘটেছে তা নিতান্তই কাকতালীয়। তবে পুরো বিষয়টা গভীর ভাবে চিন্তা করে আমি সত্যিকার অর্থে “খাম্বিত” অর্থাৎ যাকে বলে স্তম্ভিত! 

(বিঃদ্রঃ স্তম্ভের অপর নাম খাম্বা, তাই স্তম্ভিত হওয়া মানেই খাম্বিত হওয়া- (হিমু)

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

জুলাই, ২০২০ খ্রিঃ

"সহমত ভাই"

'সহমত ভাই'

হাইস্কুলে পড়ার সময় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা অসাধারণ একটি কবিতা পড়েছিলাম। তখনকার বাংলা পাঠ্যপুস্তকে 'তোষামোদ' বিষয় নিয়ে লিখিত উক্ত কবিতা'টি ছিল নিঃসন্দেহে একজন কিশোর কিংবা কিশোরীর চরিত্র গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত। কবিতা'র শুরুটা ছিল এইরকমঃ

সাহেব কহেন, “চমৎকার ! সে চমৎকার !”

মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে !

হুজুরের মতে অমত কার ?”

পুরো কবিতা'টি নিশ্চয়ই অনেকেরই পড়া রয়েছে। এই বিশেষ কবিতার মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমস্ত মানুষ কে চাটুকারিতার ঘৃণ্য প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। অথচ সচেতনতা তো আদৌ সৃষ্টিই হয়নি, বরং সময়ের আবর্তে সেই ঘৃণ্য বিষয়'টি এখনকার একটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড এ রূপান্তরিত হয়েছে! আমাদের প্রচলিত ভাষায় তোষামোদ'কে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমনঃ তেলবাজী, তৈলমর্দন, স্তাবকতা, চাটুকারিতা, মোসাহেবি, চামচাগিরি ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায় যে, তোষামোদ খুবই জঘন্য এবং কলুষিত একটি বিষয়। কারনে বা অকারনে কারও কোন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যখন কোন অনৈতিক সুবিধা লাভ করার জন্য যদি কোন মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রশংসা তোষামোদ বা চাটুকারিতায় রূপান্তরিত হয়। এর প্রভাব সত্যিই অত্যন্ত মারাত্মক। কারণ শুধুমাত্র এই তোষামোদির মাধ্যমে একজন মানুষের নৈতিকতার যতখানি স্খলন ঘটে, অন্যান্য অনৈতিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ততখানি দৃশ্যমান হয়না। 

একুশ শতকের আজকের এই আধুনিক সময়ে যখন পৃথিবী ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির সুউচ্চ চূড়ায়, ঠিক সেই সময়েও বৃহৎ সংখ্যক মানুষ নিজের স্বতঃস্ফূর্ত মেধা ও মননের ব্যবহার কে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে দূর্বল একটি পোষা প্রাণীর মতোই নিজের প্রভুর মনোরঞ্জনে নিয়োজিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এই কারণে ক্রমবর্ধমান ভাবে নিজের অজান্তেই তারা সামাজিক স্তরে নিজের অস্তিত্ব কে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে এবং নিজেদের কালিমালিপ্ত চরিত্র কে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে!

আচ্ছা, এত জটিল বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে এসে বরং একটু সহজ কথায় বলি। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কিছু মানুষ রয়েছে যারা সর্বক্ষণ নিজের অবস্থান নিয়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। নিজেকে কিভাবে চটজলদি 'জাতে' তোলা যায়, এই চিন্তা থেকেই তারা কুলীন শ্রেণীর চারপাশে গিয়ে কুলীনত্ব নিজের গায়ে মেখে নিতে চায়। ঠিক যেভাবে কুৎসিত কাক ময়ূরের পালক ধারণ করে নিজেকে রূপবান আর অভিজাত প্রমাণের চেষ্টা করেছিল! কিন্তু এটা করে নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করার চেয়ে যে হাসির পাত্র হিসেবে প্রমাণ করা হচ্ছে, মুর্খ কাকের মগজে সেই তথ্য কখনও ঢোকেনি। আজকাল ফেসবুক সহ প্রায় সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলে নিশ্চিত ভাবেই এই প্রাচীণ কাকের আধুনিক উত্তরসূরীদের দেখতে পাবেন, যারা গাঁটের পয়সা খুইয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গায় গিয়ে দামী ক্যামেরায় ছবি তুলে, আরও দশজন কে ট্যাগ করে নিজের টাইমলাইন ভরিয়ে দিচ্ছে। বাপ-মায়ের ঘাড় ভেঙে একটি দামী ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে গলায় ঝুলিয়ে সোনামুখ করে এরা নিজেদের 'ফটোগ্রাফার' বলে পরিচয় দেয়। যে ছেলেটি শুদ্ধ বানানে একটা প্যারা লিখতে গিয়ে এর ওর প্রোফাইলে হাতা পিতা করে, সে নিজেকে 'রাইটার' হিসেবে পরিচয় দেয়! মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এদের দু'একটা কে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, পরে ভাবি- না, থাকুক। কী দরকার এদের বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে!

এই পর্যন্ত বিষয়টি মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু যখনই চোখে পড়ে কেউ একজন নিজের পরিচয় হিসাবে পিতৃদত্ত তথ্য এবং নিজস্ব যোগ্যতা কে বাদ দিয়ে কোন একজন রাজনৈতিক কিংবা বিখ্যাত একজন ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজেকে হাইলাইট করার চেষ্টা করে! উদাহরণ দিচ্ছিঃ ভাই, আপনি কে? এর উত্তর হলো- 'আমি অমুক ভাইয়ের লোক কিংবা তমুক স্যারের সমর্থক!' এটা আদৌ কি কারো ব্যক্তিগত পরিচিতি হতে পারে? আচ্ছা, বিখ্যাত ব্যক্তির পাশে সেজেগুজে দাঁড়ালে কেউ কি বিখ্যাত হয়? ময়ূরের পাশে দাঁড়ানো কাক কি ময়ূরের মর্যাদা পেয়েছে কখনও?! আমার মনেহয় কোন একজন ক্ষমতাবান মানুষের সাথে ছবি তুলে কেউ যখন সেটা প্রকাশ করে- তখন সে সম্ভবত সমস্ত মানুষকে এটা বলতে চায়, 'দ্যাখো, আমি কতবড় একজন হনু!' এখানে 'হনু' শব্দটি সবচেয়ে যুৎসই, কারণ 'হনুমান' ছিল রামচন্দ্রের অনুগত পোষ্যজীব। রাম যেখানে যেতেন, হনুও তাঁর পিছুপিছু ছুটে যেতো! রামের ক্ষমতার দাপটে হনুও নিজেকে 'হ্যাডাম' মনে করতো। আধুনিক সময়ের এইসব হনু'র সংখ্যাটা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুরুতেই যেটা বলতে চেয়েছিলাম- তোষামোদ করতে করতে এইসমস্ত 'হনু'দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এতো এতো বেশি ত্রুটি দেখা যাচ্ছে যে, আগামী প্রজন্মের মানুষ এগুলো দেখে কি শিক্ষা পাবে সেটা ভেবেই শিহরিত হতে হয়! চার্লস ডারউইন তাঁর বিবর্তনতত্ত্বে বলেছিলেন- বানর থেকে বেরিয়ে এসে কিভাবে হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এখন মনেহচ্ছে বিবর্তন হয়তো উল্টো দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীজুড়ে বিরাট সংখ্যক 'হনুস্যাপিয়েন্স' অর্থাৎ মানুষরূপী এইসব হনুদের দল লম্ফঝম্প করে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নিজেদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করবে! 

© কৃষ্ণেন্দু দাস/

০৯.০৯.২০২১ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...