শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪

'সাদি মহম্মদ এবং একটি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা'

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের আরও একটু ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। সত্যিকার অর্থেই এটা ভীষণ জরুরী। আজকাল আমরা নিজেদের কিছু মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সম্পর্কে অনেক কিছুই না বুঝে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিই এবং এর কারণে আমরা নিজেরা তো অতি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হই, সেই সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অসংখ্য মানুষ। ধরা যাক— আমি একজন প্রচণ্ড রকম অভিমানী এবং ভীষণভাবে অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। নিজেকে আমি সবসময় গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করি। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই আমি আমার চারপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হবো, তাই না? এর জন্যে আমি যদি দুঃখ নিয়ে চারপাশের মানুষদের দায়ী করে বলি, 'কেউ আমাকে পছন্দ করে না কিংবা আমার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ নেই!' তাহলে এটা কি আদৌ ঠিক হবে?


ধরা যাক— আমার কয়েকজন স্কুল জীবনের সহপাঠী এখন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অত্যন্ত চমৎকার। পক্ষান্তরে আমি একটি নিরেট ছাপোষা ধরনের নিম্নমানের জীবনযাপন করি। এক্ষেত্রে আমার নিম্নমানের জীবনযাপনের দায় কি আমার এই সমাজব্যবস্থার, আশেপাশের মানুষের, এই রাষ্ট্রের নাকি একান্তই আমার নিজের? এর দায়টা পুরোপুরিভাবেই আমার নিজের। কারণ আমি জোরালো ভাবে সেইসব চেষ্টাগুলো করিনি, যেটা আমার সফল বন্ধুটি করেছে। নিজেকে আমি সাহসী ভাবে সবক্ষেত্রে সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায় উপস্থাপন করতে পারিনি বলেই আজকে আমি ব্যর্থ। অধিকাংশ মানুষের মস্তবড় এক মনস্তাত্ত্বিক ঝামেলার জায়গা হলো— তারা নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতার দায়ভার এড়াবার কৌশল হিসেবে পারিপার্শ্বিকতা কে দায়ী করে এবং নিজের মনের কাছে নিজেকে স্বচ্ছ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ভ্রম তাদের অজ্ঞাতেই তাদের অবচেতনে তৈরি হয় নিজের কাছে নিজেকে ত্রুটিহীণ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু এটা ভীষণ ভুল একটি বিষয়, যা খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষ বুঝতেই পারে না।


ধরা যাক— আমার শিক্ষা জীবনের একজন সহপাঠীর নাম 'বন্যা'। ছাত্রজীবনে মেধার দিক থেকে আমি সবসময়ই বন্যার চেয়ে এগিয়ে ছিলাম। এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে বন্যা আমাকে টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল আমি সর্বক্ষেত্রে তার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছি। বন্যা একাগ্রতা নিয়ে প্রচুর চেষ্টা করে একটি ভালো চাকরি জোগাড় করেছে, নানান ধরনের সামাজিক কার্যক্রমের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছে, নিজের যতটুকু প্রতিভা আর যোগ্যতা ছিল— তার পুরোটাই সে ব্যবহার করেছে। ফলাফল হিসেবে সে তার চারপাশে নিজেকে চমৎকার ভাবে প্রকাশিত করতে সক্ষম হয়েছে। সবাই তাকে নিয়েই মেতে থাকে, তার প্রশংসা করে। নিজের সংসারেও বন্যা স্বামী-সন্তান নিয়ে একটি পরিপূর্ণ জীবনকে যাপন করে যাচ্ছে। আর অপরদিকে আমি পেশাগত জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ছোটাছুটি করিনি, আমি ভেবেছি আমার যোগ্যতা দেখে মানুষ আমাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যখন ডাকেনি, আমি নিজেও আর যাইনি। আমি সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে থেকেছি, বিয়েথা করিনি, সংসারে নিজেকে জড়াইনি। নিজের প্রতিভা আর যোগ্যতা নিজের মধ্যে আটকে রেখেছি। সবসময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থেকে সর্বক্ষণ প্রাণপণে ভেবেছি— 'আমার যোগ্যতা আছে, নিশ্চয়ই মানুষ আমাকে ডেকে নিয়ে যাবে।' কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ বাণীটি ভুলে গিয়েছিলাম— 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।' আমি সামনের দিকে একলা এগিয়ে যাইনি, আমি ভুল করে রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি কথা আঁকড়ে ধরে ছিলাম— 'আমার জনম গেল বৃথা কাজে, আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে।' সত্যিই আমি ঘরের মাঝে বসে থেকে চিন্তা করেছি— আমার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন টা করা হয়নি। আমাকে ঠকানো হয়েছে, আমার সাথে অবিচার করা হয়েছে। অতএব, আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি— এই জীবন আমি রাখবো না, আমি এবার গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করবো! কারণ আমি যে ভীষণ অভিমানী এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। ব্যাস— মিটে গেল সব!


তাহলে বিষয় টা কি দাঁড়াচ্ছে? একজন মানুষ যদি এভাবে নিজের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং তারপর একটি হঠকারী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তার ফলাফল কি তার জন্য সুন্দর হয়? তার এই কার্যক্রম তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরও অসংখ্য মানুষ, এমন কি গোটা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করতে পারে— এটা কি ঘুণাক্ষরেও তার ভাবনায় আসে? আমরা মানুষেরা জন্মগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। প্রবাদে বলা হয়, 'মানুষ মাত্রই ভুল আছে।' কিন্তু সেই ভুলটা যতটুকু সম্ভব কম করার দায়িত্ব তো আমাদের নিজেদেরই, কারণ চিন্তাভাবনা করে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো বোধবুদ্ধি তো আমাদের আছে। তাহলে কেন আমাদের নিজস্ব বোধের সঠিক প্রয়োগ টা ঘটবে না? কেন শুধুমাত্র আমার নিজস্ব আত্মনিমগ্নতার দায় সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের এবং আশেপাশের সমস্ত মানুষের কাছে নিজেকে আরও ভুলভাবে রিপ্রেজেন্ট করবো? আমরা বরাবরই একটি কমন ব্যাপার ভুলে যাই, তা হলো— আমাদের যার যার নিজস্ব ব্যর্থতার দায়ভার কিন্তু অন্য সব মানুষের নয়। তারাও এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ, তাদের নিজেদেরও আলাদা আলাদা জীবন আছে। তাদের জীবনেও কিন্তু সফলতা কিংবা ব্যর্থতা জড়িত আছে। তাদের ব্যর্থতার দায়ভার যদি আমি না গ্রহণ করি, তাহলে আমিও কিন্তু আমার নিজস্ব ব্যর্থতার জন্যে অন্যকে দায়ী করতে পারি না। কোনভাবেই এটা পারি না। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১৬.০৩.২০২৪ খ্রিঃ

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

'আত্মতত্ত্ব'

 সৌরজগতের এই তৃতীয় গ্রহটিতে যেদিন সর্বপ্রথম প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়েছিল, সেই প্রাচীণ সময় থেকে শুরু করে আজকের এই দিন পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের অনেক কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। জলবায়ুগত কারণ এবং অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার স্বার্থে অসংখ্য প্রাণী নিজেদের নানান ভাবে বিবর্তিত করে তাদের অস্তিত্ব দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, আবার বিশাল সংখ্যক প্রাণী এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে প্রাণীদের জন্যে আদি ও অকৃত্রিম নিয়ম-ই হলো সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।


'সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' কথাটি দিয়ে বোঝানো হয়েছিল— যোগ্যতম দলই তাদের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারে। মূল বিষয় হলো টিকে থাকাটা ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া টাইপের বিষয়গুলো অনেকটা হেরে যাবার নামান্তর। হেরে গেলে বেশিদিন কেউ আর মনে রাখে না। জিতে যাওয়া কিংবা টিকে থাকাটাই হচ্ছে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে নিজেকে জানান দেবার আদিমতম সত্য। পোস্টমডার্নিজমের এই মুহূর্তে এসে ভীষণ প্রকটভাবে একটি বিষয় চোখে পড়ে। বিষয়টি হলো— এখনকার দিনে মানুষ খুব অল্পতেই মারাত্মক রকম হতাশ। খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, একেবারে সামান্য বিষয় নিয়েই মানুষ আজকাল নিজেকে শেষ করে দিতেও দ্বিধা করছে না। তারচেয়ে অবাক বিষয় হলো এই স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষেও কেউ কেউ আজকাল যুক্তি দাঁড় করিয়ে বিষয়টিকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করে। কাউকে কাউকে এখন জোরেশোরে বলতে শুনি— নিজেকে নিজে ধ্বংস করে দেওয়া যার যার নিজস্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা। এসব কুযুক্তির ওপরে দাঁড়িয়ে লাগামহীন ভাবে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে স্বেচ্ছামৃত্যুর মিছিল। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আসেনি, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। ভালো ইন্সটিটিউশনে চান্স হয়নি, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। ভালোবাসার মানুষটি ছেড়ে চলে গেছে, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। দাম্পত্য জীবনে অশান্তি হচ্ছে, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। কেন রে ভাই, জীবন টা কি এতটাই বেশি ঠুনকো! অন্য রকম কিছু কি ভাবা যায় না? আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে না গিয়ে বরং নিজের ক্ষমতার ওপর আস্থা রেখে নতুন কিছু বের করার চেষ্টা করা যায় না?


আমরা মানুষেরা অত্যন্ত চিন্তাশীল প্রাণী। উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্যেই আমাদের আজকের বিকাশ। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর সেই আদিম যুগ থেকে আস্তে আস্তে নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আজ আমরা মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছি নতুন নতুন গ্রহের সন্ধানে। তাহলে সেই চমৎকার উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ হয়ে এই ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্তের পেছনে কেন দৌড়াচ্ছি আমরা? আমাদের আবারও সেই পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হবে। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে নিজেদের মস্তিষ্কের ক্ষমতার ওপর। ছোটখাটো আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। পৃথিবীতে একটি স্বতন্ত্র প্রাণী হিসেবে সেই আদিমতম সত্যটি মাথায় রাখতে হবে। তা হলো— সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করে নিজেকে টিকিয়ে রাখা। কারণ একটি প্রাণী হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করার চেয়ে শ্রেষ্ঠতম বিষয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪

'জেমস বোয়েন এবং তার বব'

দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডের 'সারে' নামক কাউন্টি শহরে জেমস বোয়েন নামে একজন গৃহহীন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বাস করতেন। তার সম্পূর্ণ নাম জেমস অ্যান্থনি বোয়েন। শৈশবে তার বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং সেই সময়ে তিনি তার মায়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ব্যায়বহুল শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিজের মনঃসংযোগের ঘাটতির কারণে মাঝপথে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর মাত্র সতেরো বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষনে তিনি আবারও তার জন্মভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডের সারে রাজ্যে ফিরে তিনি নানান পেশায় যুক্ত হবার চেষ্টা করার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা শুরু করেছিলেন। চলমান জীবনের নানান খুটিনাটি অসংগতি এবং জটিলতা তার মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে দিয়েছিল সেই সময়। ফলশ্রুতিতে তিনি অসৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হেরোইনে আসক্ত হয়ে যান। মাদকাসক্ত হবার কারণে তার সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ ছিল না। তিনি মাঝেমধ্যে রাতের বেলা কোন নির্জন পার্কে কিংবা রাস্তার পাশের যাত্রীছাউনিতে ঘুমিয়ে থাকতেন। নানান ধরনের ছোটখাটো কাজ করে এভাবেই একটি মানবেতর জীবন কেটে যাচ্ছিল জেমস বোয়েনের।


২০০৭ সালের এক সন্ধ্যা বেলায় নির্জন একটি রাস্তা দিয়ে আপনমনে গানের সুর ভাজতে ভাজতে জেমস বোয়েন তার বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিনি রাস্তার পাশে একটি বিড়াল কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেন। তিনি স্বাভাবিক ভাবে বিড়ালটির পাশ কাটিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। পরদিন যথারীতি তিনি তার নানাবিধ ছোটখাটো কাজ করে সন্ধ্যা বেলায় হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন। আর্থিক অনটনের জন্যে ট্যাক্সি ধরার সুযোগ তার ছিল না। তখনও তার ডিনার হয়নি, অথচ পকেটে পড়ে আছে সর্বসাকুল্যে মাত্র কুড়ি পাউন্ড! আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি রাস্তার পাশে তাকালেন এবং গতকালের সেই বিড়ালটিকে আবারও একই জায়গায় বসে থাকতে দেখলেন। এবার তিনি খানিকটা কৌতূহলী হয়ে বিড়ালটির কাছে গিয়ে দেখলেন— ওটার গলায় কোন বেল্ট কিংবা ট্যাগ নেই, বিড়ালটি কিছুটা রুগ্ন এবং ওর মুখে আঁচড়ের দাগ। এসব দেখে জেমস বোয়েনের মন খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি নিজেও একজন গৃহহীন ধরনের রাস্তার মানুষ। তিনি বিড়ালটিকে তুলে নিয়ে আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে বিড়ালটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— এটা কারো হারিয়ে যাওয়া বিড়াল কিনা, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিড়ালটির কোন মালিক খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি তখন অসুস্থ বিড়ালটিকে নিয়ে একজন পশু চিকিৎসকের দারস্থ হলেন। চিকিৎসার খরচ বাবদ তিনি তার কাছে থাকা বিশ পাউন্ডের পুরোটাই দিয়ে দিলেন। এরপর বিড়ালটি কিছুটা সুস্থ হলে তিনি বিড়ালটিকে নিয়ে ঠিক সেই জায়গায় হাজির হলেন— যেখানে তিনি বিড়ালটিকে পেয়েছিলেন। তিনি ওটাকে ওখানে ছেড়ে দিলেন, যাতে বিড়ালটি তার ঠিকানায় নিজে নিজে ফিরে যেতে পারে। জেমস বোয়েন ওটাকে রেখে নিজের ঘরের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন এবং একটা সময় হঠাৎ খেয়াল করলেন যে, বিড়ালটি তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তিনি তখন বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। তিনি বিড়ালটির নাম রাখলেন 'বব'।


জেমস বোয়েন অনেকদিন ধরে মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কেন জানি কোনভাবেই এটা সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ করে এই বিড়ালটিকে নিজের কাছে এনে রাখার পর তার মনে আবারও সুস্থভাবে বাঁচার ইচ্ছে জাগ্রত হলো। তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নেওয়া শুরু করলেন এবং আবারও নিজের মতো করে পুনরায় সঙ্গীতচর্চা শুরু করলেন। দৃঢ়ভাবে মনঃসংযোগ ঘটিয়ে এরপর একটা সময়ে তিনি মাদকদ্রব্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। এরপর তিনি একটা গীটার নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইতেন এবং বব নামের বিড়ালটি তার পাশে চুপচাপ বসে থাকতো। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন, তাতে তার এবং ববের জীবন মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল। প্রায়ই জেমস বোয়েন কে হাতে গীটার এবং কাঁধে পোষা বিড়াল নিয়ে রাস্তায় চলতে দেখা যেতো। স্থানীয় মানুষদের কাছে আস্তে আস্তে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এভাবেই একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার গান শুনতে আসা একজন শ্রোতা তাকে একটি বই লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন— যিনি ছিলেন একজন প্রকাশক। জেমস বোয়েন সেই প্রকাশকের কথা বিবেচনা করে নিজের জীবন এবং বব নামের বিড়ালটির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে 'এ স্ট্রিট ক্যাট নেমড বব' নামে একটি বই লিখলেন। বইটি ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বইটি 'বেস্টসেলার বুক' হবার কৃতিত্ব অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে এই বইটি নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি হয়, যেটা ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে একসাথে থাকার পর ২০২০ সালে বব নামের এই বিড়ালটি রাস্তায় একটি গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। তখন বিড়ালটির বয়স হয়েছিল আনুমানিক পনের বছর।


আমি কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি বিচ্ছিন্ন ছবি দেখে সেটাকে নিজের প্রোফাইলের স্টোরি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম— যেখানে একজন লোক রাস্তার পাশে গলায় গীটার ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং তার পায়ের কাছে একটি বিড়াল চুপচাপ বসে ছিল। গতকাল রাতে হঠাৎ কি মনে করে 'স্ট্রিট মিউজিশিয়ান উইথ ক্যাট' লিখে গুগলে সার্চ দেবার পর জেমস বোয়েন সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানতে পারলাম। অনেক সময় একটি চতুষ্পদ প্রাণীও যে একজন মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং ভীষণ আপনজন হয়ে উঠতে পারে, তার জলন্ত উদাহরণ হলেন জেমস বোয়েন।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

 ১০.০৩.২০২৪ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...