বুধবার, ২ মার্চ, ২০২২

'স্যাডিজম'

 'স্যাডিজম'

(মনস্তাত্ত্বিক ভুবনের এক ধ্বংসাত্মক রাজ্য)


গত কয়েকটি দিন ধরে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছিলাম। মানুষ হিসেবে আমাদের বলা হয় 'সৃষ্টির সেরা জীব', কারণ চিন্তাশীলতা প্রয়োগ করে এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে আমরা পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজেদের প্রতিভার সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছি, যেটা অন্যান্য পার্থিব প্রাণীর ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় হলো- আমাদের মধ্যে যেমন অসংখ্য চমৎকার গুণের সমন্বয় ঘটেছে, তেমনি আমাদের প্রায় প্রত্যেকের মনের গহীনেই লুকিয়ে রয়েছে বিশাল ভয়াবহ অন্ধকার রাজ্য! নিজেদের মনের গভীরের এই অন্ধকারাচ্ছন্নতা সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। এই ভয়াবহ অন্ধকার জগতের ছোট একটি রাজ্যের নামঃ 'স্যাডিজম'। হিউম্যান সাইকোলজিতে 'স্যাডিজম' নামক বিষয়টি নিয়ে বিশদভাবে বিশ্লেষণ এবং মানব সমাজে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা হয়। আসুন, এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে একটু আলোচনা করা যাক।


স্যাডিজমঃ

অন্যকে কষ্ট দিয়ে কিংবা অপরের দুঃখ–কষ্ট দেখে আত্মতুষ্টি লাভ করা কে এককথায় 'SADISM' বলা হয়। আর যে ব্যক্তির মধ্যে এই নেতিবাচক গুণটি অতিরিক্ত মাত্রায় দৃশ্যমান তাকে আমরা SADIST (স্যাডিস্ট) বলে থাকি। একটু অন্যভাবে যদি বলা হয়- তবে অন্যের ভালো সহ্য করতে না পারা, অপর'কে মানসিকভাবে নির্যাতন করে বিকৃত আনন্দ লাভ করাই স্যাডিজম। অর্থাৎ এক কথায় এই বিষয়টি একধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ততা ছাড়া কিছু নয়।

'স্যাডিজম' এর কোন সুনির্দিষ্ট প্রকারভেদ ও প্রকৃতি নেই। বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে এটি বিভিন্ন রূপে এবং বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পায়। যিনি এই মানসিক বিকারগ্রস্থতায় আক্রান্ত, তিনি অবচেতন মনেই রোগটি লালন করে থাকেন। 'স্যাডিস্ট' ব্যক্তিবর্গের সামাজিক অবস্থানভেদে এর প্রকৃতি এবং রূপও ভিন্ন হয়ে থাকে।

সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত বিরূপ প্রকৃতি, বনের হিংস্র জীব-জন্তুর সাথে লড়াই করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। চার্লস ডারউইনের 'সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট' থিওরী সেই আদিকাল থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজও প্রাসঙ্গিক এবং পরীক্ষীত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত। শুধু পার্থক্য হচ্ছে- এখন মানুষই মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্য কেউ নয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে মানুষকে টিকে থাকতে হচ্ছে বর্তমানের পৃথিবীতে। এই প্রতিযোগীতায় যিনি শক্তিমান তিনি সর্বদা দুর্বলকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, আর দুর্বল চেষ্টা করছেন শক্তি সঞ্চয় করে শক্তিমানকে ছাড়িয়ে যেতে। এভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বীতা এক সময় 'স্যাডিজম' এর দিকে মোড় নেয়। অর্থাৎ শক্তিমান বা উপরস্থ ব্যক্তি দুর্বল বা অধস্তনকে দাবিয়ে রাখার অস্ত্র হিসেবে তাকে পদে পদে হেনস্থা বা অপদস্থ করে মনে আত্মপ্রশান্তি অনুভব করেন। এক একজন মানুষের অবচেতনা কে সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে বেশির ভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এটার উপস্থিতি এতটাই কম যে, সেটা তার ব্যক্তিগত জীবন কে প্রভাবিত করার সুযোগ পায় না। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কিভাবে স্যাডিজম বিষয়টি রয়েছে, তা একটু সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করি।


মনে করুণঃ আপনি একটি রাস্তা থেকে যাচ্ছেন, হঠাৎ করে দূরে একটি বিকট শব্দ শুনলেন। লোকজনের চিৎকার শুনে বুঝলেন একটি দূর্ঘটনা ঘটেছে। আপনার মন কিন্তু তাৎক্ষণিক ভাবেই দূর্ঘটনার একটি বীভৎস ছবি তৈরি করে নিয়েছে আপনার মনের মধ্যে। আপনি ভেবে রেখেছেন দূর্ঘটনার স্থানে একাধিক মৃতদেহ, থেঁতলে যাওয়া মানুষের রক্তাক্ত শরীর এবং আরও অনেক বীভৎস দৃশ্য অপেক্ষা করছে যা দেখে আপনি শিউরে উঠবেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে আপনি সেখানে পৌঁছে গিয়ে যদি দেখতে পান দূর্ঘটনায় কারোই তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, আপনার মনটা তখনই আশাহত হবে। কারণ আপনি ভেবেছিলেন ওখানে কোন একটা বীভৎসতা অপেক্ষা করে আছে এবং সেই দৃশ্য দেখতেই আপনি উৎসুক। কিন্তু যখন দেখলেন সেখানে সবাই সুস্থ আর স্বাভাবিক রয়েছে, তখনই আপনি নিরাশ হলেন। এই নিরাশাজনক মানসিক অবস্থাই আপনার ভেতরের স্যাডিজম।

ধরুন, আপনার এলাকায় আবহাওয়া খুবই দুর্যোগপূর্ণ। আবহাওয়া অধিদপ্তর বারবার করে দশ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জানিয়ে ঘোষণা দিচ্ছে। আপনার এলাকার দিকে ধেয়ে আসছে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়। আপনি তাৎক্ষণিকভাবে আপনার মনের ভেতরে ধ্বংসযঞ্জের একটি কাল্পনিক চিত্র তৈরি করলেন এবং তার জন্য অগ্রীম ব্যথিত হয়ে সেই ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে ঘূর্ণিঝড়টি দূর্বল হতে হতে একটা সময় মিলিয়ে গেল এবং আপনার এলাকা সুরক্ষিত থেকে গেল। সেই মুহূর্তেও আপনি হতাশ হবেন, কারণ আপনি একটি ধ্বংসাত্মক ঘটনার মুখোমুখি হবার জন্য তৈরি হয়ে বসেছিলেন। একটি ধ্বংসাত্মক ঘটনা না ঘটার জন্য আপনার মনে যে হতাশার সৃষ্টি হয়, ওটাই আপনার স্যাডিজম।

মনে করুণ, আপনার শৈশবের সময়কার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু রয়েছে, যার সাথে আপনি সুখে-দুঃখে দীর্ঘ একটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। যার সাথে জড়িয়ে আছে আপনার অসংখ্য স্মৃতিময় অধ্যায়। হঠাৎ করেই সেই বন্ধুটি চমৎকার একটি চাকরি পেয়ে গেল কিংবা বড়সড় অর্থের মালিক হয়ে সমাজে একটি উচ্চতর জায়গায় পৌঁছে গেল, আপনি কিন্তু প্রিয় বন্ধুর এই সাফল্যের ঘটনায় মন থেকে খুশি হতে পারবেন না। সংগোপনে এই বন্ধুটির সাফল্য আপনাকে ঈর্ষান্বিত করবে। এই ঈর্ষা-ই আপনার ভেতরের স্যাডিজম। এইধরণের হাজারো উদাহরণ রয়েছে আমাদের মতো সকল মানুষের ভেতরকার স্যাডিজমের। যাইহোক, লেখাটি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম- গত কয়েকটি দিন ধরেই সারা পৃথিবীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষ একধরণের উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে যে, ঘটনার ফলশ্রুতিতে শেষমেশ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় কিনা! সবাই বাইরে থেকে এসব যুদ্ধংদেহী মনোভাবের বিপক্ষে সজোরে হেঁকে যাচ্ছে কিন্তু ট্রাস্ট মি- প্রায় পঁচানব্বুই শতাংশ মানুষই আশা করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাক। তারা সবাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হয়ে এর বীভৎসতা দেখতে চায়। এখানে কিন্তু কারোরই কোন দোষ কিংবা অপরাধ নেই। তার অবচেতন মনের স্যাডিজম তাকে এভাবে ভাবতে বাধ্য করে। কারণ মানুষ এই পৃথিবীর যতবড় সৃষ্টির সেরা জীব হোক না কেন, মানুষ- ই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী, যে কিনা সৃষ্টি ধ্বংসকারী!


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

০১.০৩.২০২২ খ্রিঃ

রবিবার, ১৬ জানুয়ারি, ২০২২

'অর্থহীন পরাবাস্তবতা'

 (অর্থহীন পরাবাস্তবতা)


'....আজ খুব ভোরেই টিয়া'র ডাকে আমার ঘুম ভেঙেছে। খুব বিরক্তি নিয়ে আমি চোখ খুলে বুঝতে চেষ্টা করলাম, ঠিক কোথায় এখন আমি! প্রচন্ড রকম বিরক্তিতে আমার কপাল কুঁচকে আছে। টিয়া তার স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট অনুযায়ী একঘেয়ে গলায় আমাকে ডেকেই যাচ্ছে, একটা প্রচন্ড লাথিতে টিয়া'কে ঘরের অন্যপাশে ছুড়ে ফেলার ইচ্ছেটাকে অতি কষ্টে দমন করে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। এরপর টিয়া কে কোলে নিয়ে একটু আদর করে ওকে বিস্কুট খেতে দিলাম। 'টিয়া' আমার অতি প্রিয় পোষা একটি মাঝ বয়সী বিড়াল! আমি দীর্ঘদিন ধরেই একা একা থাকতে শিখেছি; শিখে নিয়েছি একা পথ চলতে। তবে দিনের শেষে যখন চারিপাশ অন্ধকার করে নিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে, যখন সর্বত্র টিমটিম করে একটির পরে একটি আলো জ্বলে ওঠে; জানিনা ঠিক কেন- তখন প্রচন্ডরকম এক নিঃসঙ্গতাবোধ যেন অষ্টাঙ্গিক দৃঢ়তা নিয়ে অক্টোপাসের মতোই জড়িয়ে ধরে আমার ভেতরের নিজস্ব সত্তাটুকু! আর তাই সম্ভবত; নিঃসঙ্গতা আর নীরবতার এই একপেশে খুনসুটি কে উপেক্ষা করার জন্যেই আমার এই বিড়ালপ্রীতি! হ্যাঁ, যেটা বলছিলামঃ আজকাল ঘুমাতে বড্ডই দেরি করে ফেলছি, যার কারণে খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ভীষণ অস্বস্তি হয়। সকালের আলোটুকু চোখে একবার পড়লে, নতুন করে ঘুমাতে যাওয়াও বেশ কষ্টকর! কি আর করা, চুলায় চায়ের পাত্র চাপিয়ে বসে আছি। একটু একটু করে ফুটন্ত বাষ্প জানালা দিয়ে বের হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে এই অস্থির জানুয়ারী'র মধ্য প্রহরের ধোঁয়াটে সাবলীল বাতাসে। বাইরে কি মুক্ত বাতাস! সকালের আকাশটাও তার সমস্তটুকু মুগ্ধতা ছড়াতেই যেন ব্যাস্ত। অথচ, আজ প্রায় দিন দশেক ধরে বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে সময়টা সত্যিই যেন খানিকটা থমকে আছে! জানিনা, আবার কবে বাইরে বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবো; কবে আবারও গলা খুলে গাইবো! জানিনা, কিছুই জানিনা আমি। শুধু এটুকুই জানিঃ চলমান সংকট এখন কিছুটা বীভৎস কোনো সায়েন্স ফিকশনের মতোই  মনে হচ্ছে, যার সমাপ্তি অকারণেই যথেষ্ট দুর্বোদ্ধ; অথবা আমি আসলে এখন  ঘুমিয়েই আছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোন একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি; এই জানুয়ারী মাসের সকাল, চুলার ফুটন্ত বাষ্প কিংবা আমার গায়ে আলতো ছুঁয়ে লেজ বুলিয়ে যাওয়া আমার প্রিয় পোষা বিড়াল, সবই সেই দুঃস্বপ্নেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়তো একটু পরেই ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠবো, উঠে দেখতে পাবো সব কিছুই খুব স্বাভাবিক অবস্থায় আছে; যেমনটি ছিলো আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগেই......!'


© কৃষ্ণেন্দু দাস/

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...