সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

"হাইলাইট অফ হিরোইজম"

বহুদিন ধরে দেখে আসছি একটা বিশেষ শ্রেণির মানুষ নিজেদের সম্পর্কে বিশাল বিশাল পজিটিভ কথাবার্তা চারপাশের মানুষের মধ্যে চাউর করে দিয়ে সোসাইটির সকল মানুষের কাছে নিজেদেরকে হিরো হিসেবে প্রমাণ করে। তাদের এই হিরো হয়ে ওঠার নেপথ্যে থাকে একটা চাটুকার গোষ্ঠী। তেলবাজ এইসব চামচাগণ চতুর্পাশে ঘুরে ঘুরে তাদের হিরোর গুণাগুণ এবং অসাধারণ বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে থাকে। অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হলো— বাংলাদেশি সমাজব্যবস্থায় খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষেরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং সরল। তারা খুব সহজেই মুখরোচক কথাবার্তা শুনে সেটাকে সরল মনে বিশ্বাস করে ফেলে। তারা একটা বারের জন্যেও বিষয়টির উদ্দেশ্য কিংবা ভিত্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে যায় না। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে একটি রমরমা ব্যবসা চালু রয়েছে, যার নাম 'চ্যারিটি ফাউন্ডেশন' বা দাতব্য সংস্থা। বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে নিঃসন্দেহে এটি একটি অলাভজনক কিংবা সেবামূলক কার্যক্রম। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি কি আদৌ তেমন?


মনে করুণ, আমার কাছে কিছু নগদ অর্থ আছে। আমি সেই টাকা ইনভেস্ট করে কয়েক বালতি ঠান্ডা শরবত তৈরি করে কাঠফাটা রোদের মধ্যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বিনামূল্যে অসংখ্য তৃষ্ণার্ত মানুষকে সেটা খেতে দিলাম। আবেগপ্রবণ বাঙালি জাতি সাথে সাথে আমার মহান পরোপকারী মানসিকতা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা বলতে শুরু করবে। প্রাথমিক ভাবে আমি মানুষের থেকে একটা পজিটিভ অ্যাটেনশন পেয়ে যাবো। এভাবে আরও দুই দিন এই একই কাজ আমি পার্শ্ববর্তী এলাকায় করবো, ততক্ষণে আমার সাথে আরও দুই-একজনকে জুটিয়ে নেবো, যারা আমার এই মহৎ উদ্যোগ মানুষের কাছে প্রচার করবে। এরপর আমি সমাজের কিছু বিত্তবান মানুষের সাথে আমার এই 'মহৎ' চিন্তা টা শেয়ার করে তাদের কাছে অর্থনৈতিক হেল্প চাইবো। দশজন বিত্তবানের কাছে গেলে তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন আমার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে আমার জন্য ছোট একটা ফান্ড বরাদ্দ দেবে। এরপর আমি কিছু টাকা খরচ করে দুই-একজন সাংবাদিক দিয়ে আমার কাজটিকে নিয়ে কয়েকটি ফিচার করাবো, এর সাথে সাথে আমার নিজস্ব চাটুকার বাহিনী তো নিয়মিত ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি সহ আমার গুণগান করতে থাকবে। পরবর্তী সময়ে আমার জন্য ডোনেশন পাওয়া খুব বেশি কঠিন হবে না। এভাবেই গ্রীষ্মে মানুষের পাশে দাঁড়াবো, তীব্র শীতে পাশে দাঁড়াবো, বন্যায় পাশে দাঁড়াবো, ধর্মীয় উৎসবের দিনে পাশে দাঁড়াবো। আমার এই পাশে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া বারোমাস ধরে চলতেই থাকবে। ততদিনে আমার একাউন্টের স্বাস্থ্যও অনেক সুন্দর হয়ে যাবে। দুই লাখ টাকা ডোনেশন পেলে পঁচিশ হাজার প্রচারের জন্য, পঁচিশ হাজার চাটুকার গোষ্ঠীকে দিয়ে এরপর পঞ্চাশ হাজার রাস্তার ছিন্নমূল মানুষের জন্য ব্যায় করলেও আমার পকেটে এক লাখ থেকে যাচ্ছে। এই হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়ার সাদামাটা বিষয়। কিন্তু আমি সর্বোচ্চ লাভবান হবো কিভাবে জানেন? সেটার নাম 'পাবলিক সিম্প্যাথি'। আমি রাতারাতি গণমানুষের চোখে একজন জনদরদী মহান মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবো।


এবারে বাস্তব সত্যি টা নিয়ে নির্মোহ আলোচনা করা যাক। আমরা যে আমাদের চারপাশে এতো এতো মহানুভব তথাকথিত মহাপুরুষদের দেখতে পাই, এরা কেউ কি সত্যিকার অর্থে তাই? স্বতন্ত্র একটি সত্তা হিসেবে হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির মধ্যে অসংখ্য অসংখ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পৃথিবীতে কেউ-ই বাস্তবতার ভিত্তিতে মহাপুরুষ নয়। 'মহাপুরুষ' ব্যাপারটির কনসেপ্ট মূলত বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে এসেছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। একটি বায়োলজিক্যাল প্রাণী হিসেবে মানুষ খুবই ত্রুটিযুক্ত। মানুষের মধ্যে লোভ, আকাঙ্খা, স্বার্থ, জাগতিক চাহিদা থাকাটাই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কেউ যদি আপনাকে নিজের থেকে ঘোষণা দিয়ে বলে যে— সে এইসব জাগতিক মোহ থেকে মুক্ত কিংবা তার মধ্যে এইসব প্রথাগত লোভ-লালসা কিংবা আকাঙ্ক্ষা কাজ করে না, তাহলে ধরে নেবেন লোকটি মিথ্যে বলছে অথবা তার সিরিয়াস ধরনের মানসিক সমস্যা আছে। একটি ত্রিমাত্রিক প্রাণী হিসেবে একজন মানুষের পক্ষে তার শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ড কে অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। আর তার শরীরবৃত্তীয় সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের অংশই হলো তার ক্ষুধাতৃষ্ণা, ঘুম, বিশ্রাম, যৌনতা, মানবিক আবেগ, লোভ, মোহ, জাগতিক চাহিদা ইত্যাদি। এই থার্ড ডাইমেনশনাল প্ল্যানেটে বেঁচে থেকে মোহমুক্ত হয়ে বাঁচা কিংবা গণমানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দেবার বিষয়টি নিছক হিপোক্রেসি। যারা এই সিম্পল বিষয়টি বুঝতে পারে না, তারাই কথিত এইসব হিরোদের হিরোগিরি নিয়ে অষ্টপ্রহর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকে, আর চারপাশে এদেরকে নিয়ে জয়গান করতে করতে নিজেদের ধন্য মনে করে। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

"নিত্যানন্দ: এক প্রাচীণ বাটপারের ইতিকথা"



আমরা বাঙালিরা যে পৃথিবীর নিকৃষ্টতর একটি জাতি, এটা সন্দেহাতীত ভাবেই প্রমাণিত। বাঙালি মানে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের কথা বলছি। বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো— এরা নিজেরা তেমন একটা পড়াশোনা করে না, ঐতিহাসিক বিষয়াবলী সম্পর্কেও এরা ন্যূনতম খোঁজখবর রাখে না। এরা কি পারে জানেন? কেউ একটা কথা চালু করে দিলে এরা চোখকান বুঁজে সেই কথাটিকে ধরে অন্ধের মতো এগিয়ে যায়, তাদের দেখাদেখি আরও অনেক মানুষ 'ঝাঁকের কৈ' হয়ে হুজুগে মেতে গিয়ে বিষয়টিকে নিয়ে একেবারে হুলস্থুল করে ফেলে। দুঃখজনক বিষয় হলো— এরা কেউ-ই একটা বারের জন্যেও যাচাই করতে যায় না বিষয়টির সত্যতা কতটুকু! এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি ভুল মতবাদ বাঙালি সমাজে সত্যের মতো প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আমি শৈশবে বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের মূর্তির পাশে এক্সট্রা দুটি মূর্তি লক্ষ্য করতাম, যারা দুইপাশে দাঁড়িয়ে থেকে  নিজেদের দুই বাহু তুলে রেখেছেন। এদের নাম একত্রে গৌর-নিতাই। এদের মধ্যে গৌর কিংবা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু কিংবা শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। ১৫০০ শতকের প্রথমার্ধে তিনি 'বৈষ্ণব আন্দোলন' গড়ে তুলেছিলেন। এটা ছিল ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন, যা ‘ভক্তি আন্দোলন’ নামেও পরিচিত। তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। চৈতন্য দেবের সঙ্গে অদ্বৈতাচার্য নামের একজন বৈষ্ণব দার্শনিক সেই সময়ে মানবতাবাদী এই আন্দোলন কে বেগবান করেছিলেন। গৌরাঙ্গ কিংবা শ্রীচৈতন্য এরপর সন্ন্যাস গ্রহণ করে নবদ্বীপ থেকে উড়িষ্যা রাজ্যের অন্তর্গত পুরী নামক স্থানে গিয়ে অবস্থান করেন। আমি শ্রীচৈতন্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের অথেনটিক ইতিহাস এবং নানান ধরনের সোর্স অনুসন্ধান করে যে বিষয় টা দেখে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছি, সেটা ছিল— শ্রীচৈতন্য দেবের বিখ্যাত এই বৈষ্ণব আন্দোলনে নিতাই কিংবা নিত্যানন্দ নামের মানুষটির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে কম, অথচ পাঁচশো বছরের বেশি সময় ধরে এই মানুষটিকে শ্রীচৈতন্যের প্রধান পার্শ্বনায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে।


শ্রীচৈতন্য নবদ্বীপে থাকাকালীন সময়ে অদ্বৈতাচার্যের সঙ্গে বৈষ্ণব ভক্তি মতবাদ সংক্রান্ত বিশদ দার্শনিক চিন্তাভাবনা শেয়ার করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তিনি এককভাবে সেই আন্দোলন কে উড়িষ্যা রাজ্য পর্যন্ত বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। নবদ্বীপ এবং উড়িষ্যার পুরীধামে শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন যে বিশেষ মানুষটি— তার নাম ছিল স্বরূপ দামোদর। শ্রীচৈতন্য দেব কে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা যখন হত্যা করেছিল, তখনও শ্রীচৈতন্যের কাছাকাছি স্বরূপ দামোদর উপস্থিত ছিলেন। স্বরূপ দামোদর নিজেও নিহত হয়েছিলেন জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডাদের হাতে। আমার ভীষণ ভাবে জানার আগ্রহ ছিল যে, নিতাই কিভাবে শ্রীচৈতন্যের প্রধান পার্ষদ হলেন? কোন জাদুমন্ত্র বলে অদ্বৈতাচার্য এবং স্বরূপ দামোদর কে টপকে গিয়ে নিত্যানন্দ শীর্ষে চলে গেলেন? এর উত্তর খুঁজে পেলাম সহজেই। নিত্যানন্দের জন্ম হয়েছিল বীরভূম জেলার একচক্রা গ্রামে। তিনি যৌবনকালে নানান জায়গা ঘুরে নবদ্বীপে গেলে, সেখানে শ্রীচৈতন্যের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এরপর তিনি কিছুদিন সেখানে চৈতন্য দেবের সঙ্গে নগর কীর্তণ করেন। হরিনাম সংকীর্তন করার সময়ে একবার নবদ্বীপের দুইজন নগরকোটাল জগন্নাথ এবং মাধব দাস (জগাই-মাধাই) মদ্যপ অবস্থায় নিত্যানন্দ কে প্রহার করেছিল। মূলত এই মার খেয়ে নিতাই পরিচিতি লাভ করেন। এরপর শ্রীচৈতন্য দেব নবদ্বীপ ছেড়ে পুরী চলে গেলে নিতাই কুঞ্জবাটীতে গিয়ে অবস্থান করেন। নিত্যানন্দ বর্ধমান জেলার সূর্যদাস সরখেলের দুই কন্যা বসুধা ও জাহ্নবী কে বিয়ে করেছিলেন। এই পত্নী দ্বয়ের সন্তানেরা পরবর্তীকালে সবখানে ঘুরে ঘুরে নিতাইয়ের মাহাত্ম্য প্রচার করেছে এবং নির্বোধ বাঙালিরা সেটাই ভক্তিভরে বিশ্বাস করেছে। আমি বলছিনা যে— বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলনে নিত্যানন্দের কোন ভূমিকা নেই, নিশ্চয়ই ভূমিকা আছে, তবে সেটা ক্ষীণ। তাকে যেভাবে শ্রীচৈতন্য দেবের প্রধান পার্ষদ হিসেবে সবখানে দেখানো হয়, এটা একটা জোচ্চুরি। কয়েকদিন আগে আমি একটি পদাবলী কীর্তণ গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে কীর্তনগায়ক কিছুক্ষণ পরপর 'জয় নিতাই' 'জয় নিতাই' বলে আওয়াজ করছিলেন। তার গান শেষ হবার পর আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম— 'আপনি কি স্বরূপ দামোদর সম্পর্কে জানেন?' তিনি বিনীতভাবে আমাকে জানালেন যে, তিনি স্বরূপ দামোদর সম্পর্কে কিছু জানেন না। আমার তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিষয় মনে হয়েছিল তখন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পাননি, কিন্তু চারপাশে বিরাট সংখ্যক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পাওয়া যায়— যারা ক্ষমতাসীন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের সাথে লবিং করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন। শ্রী নিত্যানন্দ হলেন তেমনই একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, আর স্বরূপ দামোদর হলেন কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া শ্রীচৈতন্য দেবের সেই বিশ্বস্ত, হতভাগ্য সার্বক্ষণিক সঙ্গী।


— কৃষ্ণেন্দু দাস ||

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...