জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে এসে আজকাল নিজের মধ্যে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো— কোনো কিছুর প্রতি বিশেষ ভাবে আগ্রহ কিংবা উদ্দীপনা হ্রাস পাওয়া। একটি চুইংগামের প্যাকেট খুলে ওটা মুখে নিয়ে তিন-চার মিনিট রাখার পর মিষ্টি স্বাদটা হারিয়ে গেলেও সেটাকে বহুক্ষণ ধরে মুখে নিয়ে চিবানোর মতো একটি অর্থহীন জাবরকাটা টাইপের বিষয় মনে হচ্ছে ইদানীংকালের যাপিত জীবনটাকে। কী এমন সুমহান উদ্দেশ্য কে চরিতার্থ করার জন্য এতটা উৎসাহ-উদ্দীপনার সমন্বয় ঘটিয়ে জীবনকে টেনেটুনে আরও লম্বা বানাচ্ছি? যে দু-চারটে ছোট ছোট লোভ আর মোহ কে পুঁজি করে পিঁপড়ের সারির মতন সামনে এগিয়ে চলেছে এই মানবসম্প্রদায়, সেটাকে নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা করে কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। বিশাল কিছু প্রাপ্তি অথবা বড়সড় একটা ব্যর্থতার যে মানসিক অনুভূতি, অর্থাৎ তীব্র সুখে উথলে ওঠা কিংবা প্রচণ্ড বেদনায় ভেঙে যাওয়ার মতো এইসব ক্ষণিকের বিষয় গুলোকে একেবারে ঠুনকো মনে হচ্ছে। সেই কবেকার কোন প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষকে কিছু ছোটখাটো বুঝ দেওয়া হয়েছিল— সেগুলো নিয়ে এখনও পর্যন্ত মানুষেরা ঘানিটানা গরুর মতো একই চক্রের মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। চক্রের বাইরে গিয়ে ভাবার মতো ফুরসত কোথায় মানুষের? ঐ যে প্রচলিত দু-চারটে ছোট ছোট লোভ আর মোহ মানুষের মস্তিষ্কে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হয়েছে, ওগুলোই মগজের মধ্যে ক্রমাগত ভাবে একই সিগন্যাল দিয়ে যাচ্ছে। আহারে আমার একরত্তি জীবন!
আজকাল সকালে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার পরেও বেশ কিছুক্ষণ ধরে শরীর এবং মন ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে থাকে। এটা তো মোটেই বার্ধক্যজনিত কারণে হচ্ছে না, কারণ সেই পর্যায়ের বার্ধক্যে এখনো পর্যন্ত যাইনি। তাহলে উৎসাহ-উদ্দীপনা হঠাৎ করে এতটা তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে কেন? এই বিষয়ে একটা যুৎসই উদাহরণ দিচ্ছি। সপ্তাহ দেড়েক আগে আমার একজন পুরনো দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হঠাৎ ফোন করে বললেন— বিকেলে যেন তার সাথে দেখা করি। বন্ধুটি সদ্য কোলকাতা থেকে ফিরেছেন এবং তার কাছে একটি উন্নত মানের ওয়াইনের বোতল রয়েছে। অর্থাৎ বহুদিন পর দুই বন্ধু মিলে চুটিয়ে একটা আড্ডা হবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, আমি তার সাথে দেখা করতে গেলাম না। অযুহাত হিসেবে মিথ্যা কথা বললাম যে, আমার শরীর টা বেশ অসুস্থ। পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডার মোহ কিংবা অ্যালকোহলের লোভ আমাকে আমার অবস্থান থেকে নাড়াতে পারেনি। এভাবে জাগতিক বিষয় থেকে নির্মোহ হয়ে যাওয়া আমার কাছে স্বাভাবিক বিষয় মনে হচ্ছে না। যদিও স্বাভাবিক অথবা অস্বাভাবিকতার নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই। আমি এটা বললাম বেশিরভাগ মানুষ যে ফর্মুলায় বেঁচে আছে, সেটাকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে। খুব তীব্রতর একধরণের ঈর্ষা বোধ হচ্ছে বৃহৎ সংখ্যক মানুষের ওপর— যারা তীব্র দাবদাহে বৃষ্টির জন্যে চাতকের মতো হাপিত্যেশ করছে এবং বৃষ্টি নামার পর ভিজতে ভিজতে উদ্বাহু নৃত্য করছে, যারা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভিজে ভিজে তাদের প্রিয় নেতার জন্যে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট ভিক্ষা করছে, যারা লোন তুলে হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলছে, যারা সুখের ঘর বাঁধার স্বপ্নে নিজের সবটুকু মেধা উজাড় করে অপরিচিত একটি মেয়েকে পটাচ্ছে, যারা অসংখ্য মানুষকে বোকা বানিয়ে নিজের ব্যাংক-ব্যালেন্স বাড়াচ্ছে, যারা সারাদিন রোদে পুড়ে ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফেরার আগে বউয়ের জন্য ট্যালকম পাউডার কিনছে, যারা গাঁজা টেনে পথচারীদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নির্বিকার ভাবে স্টিয়ারিং ধরে ঝিমাচ্ছে, যারা বিয়েবাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে একটা পান চিবাতে চিবাতে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, যারা আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধান হিসেবে নানান রাষ্ট্রের পন্য বয়কট করে বেড়াচ্ছে, যারা গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে বাঁচার জন্যে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করছে, যারা সাধারণ একটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়েও নিত্যনতুন স্বপ্নে বিভোর হচ্ছে। এইসব মানুষের ভীড়ে মিশে গিয়ে তাদের স্রোতে ভেসে গিয়ে আজকাল বাঁচতে ইচ্ছে করে। দু-চারটি ছোট ছোট লোভ আর মোহ কে পুঁজি করে ক্ষুদ্র একটি বৃত্তের মধ্যে বারংবার ঘুরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ভেতরকার সমস্ত অনবদমিত আকাঙ্ক্ষা হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার কারণে সেটা কোনোভাবেই আর হচ্ছে না। এইসব সাত-পাঁচ ভেবে ভেবে খুবই অস্বস্তির মধ্যে আছি। আরিব্বাস, আজকের তারিখটাও দেখতে পাচ্ছি সেই সাত-পাঁচ!
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
০৭.০৫.২০২৪