শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৪

'সাদি মহম্মদ এবং একটি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা'

একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমাদের আরও একটু ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। সত্যিকার অর্থেই এটা ভীষণ জরুরী। আজকাল আমরা নিজেদের কিছু মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা সম্পর্কে অনেক কিছুই না বুঝে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিই এবং এর কারণে আমরা নিজেরা তো অতি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হই, সেই সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অসংখ্য মানুষ। ধরা যাক— আমি একজন প্রচণ্ড রকম অভিমানী এবং ভীষণভাবে অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। নিজেকে আমি সবসময় গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করি। তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই আমি আমার চারপাশের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হবো, তাই না? এর জন্যে আমি যদি দুঃখ নিয়ে চারপাশের মানুষদের দায়ী করে বলি, 'কেউ আমাকে পছন্দ করে না কিংবা আমার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ নেই!' তাহলে এটা কি আদৌ ঠিক হবে?


ধরা যাক— আমার কয়েকজন স্কুল জীবনের সহপাঠী এখন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি অত্যন্ত চমৎকার। পক্ষান্তরে আমি একটি নিরেট ছাপোষা ধরনের নিম্নমানের জীবনযাপন করি। এক্ষেত্রে আমার নিম্নমানের জীবনযাপনের দায় কি আমার এই সমাজব্যবস্থার, আশেপাশের মানুষের, এই রাষ্ট্রের নাকি একান্তই আমার নিজের? এর দায়টা পুরোপুরিভাবেই আমার নিজের। কারণ আমি জোরালো ভাবে সেইসব চেষ্টাগুলো করিনি, যেটা আমার সফল বন্ধুটি করেছে। নিজেকে আমি সাহসী ভাবে সবক্ষেত্রে সঠিক সময়ে এবং সঠিক জায়গায় উপস্থাপন করতে পারিনি বলেই আজকে আমি ব্যর্থ। অধিকাংশ মানুষের মস্তবড় এক মনস্তাত্ত্বিক ঝামেলার জায়গা হলো— তারা নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতার দায়ভার এড়াবার কৌশল হিসেবে পারিপার্শ্বিকতা কে দায়ী করে এবং নিজের মনের কাছে নিজেকে স্বচ্ছ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ভ্রম তাদের অজ্ঞাতেই তাদের অবচেতনে তৈরি হয় নিজের কাছে নিজেকে ত্রুটিহীণ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য। কিন্তু এটা ভীষণ ভুল একটি বিষয়, যা খুব বৃহৎ সংখ্যক মানুষ বুঝতেই পারে না।


ধরা যাক— আমার শিক্ষা জীবনের একজন সহপাঠীর নাম 'বন্যা'। ছাত্রজীবনে মেধার দিক থেকে আমি সবসময়ই বন্যার চেয়ে এগিয়ে ছিলাম। এমন কোনো জায়গা ছিল না, যেখানে বন্যা আমাকে টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল আমি সর্বক্ষেত্রে তার চেয়ে পিছিয়ে পড়েছি। বন্যা একাগ্রতা নিয়ে প্রচুর চেষ্টা করে একটি ভালো চাকরি জোগাড় করেছে, নানান ধরনের সামাজিক কার্যক্রমের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছে, নিজের যতটুকু প্রতিভা আর যোগ্যতা ছিল— তার পুরোটাই সে ব্যবহার করেছে। ফলাফল হিসেবে সে তার চারপাশে নিজেকে চমৎকার ভাবে প্রকাশিত করতে সক্ষম হয়েছে। সবাই তাকে নিয়েই মেতে থাকে, তার প্রশংসা করে। নিজের সংসারেও বন্যা স্বামী-সন্তান নিয়ে একটি পরিপূর্ণ জীবনকে যাপন করে যাচ্ছে। আর অপরদিকে আমি পেশাগত জীবনের লক্ষ্য নিয়ে ছোটাছুটি করিনি, আমি ভেবেছি আমার যোগ্যতা দেখে মানুষ আমাকে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ যখন ডাকেনি, আমি নিজেও আর যাইনি। আমি সামাজিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে থেকেছি, বিয়েথা করিনি, সংসারে নিজেকে জড়াইনি। নিজের প্রতিভা আর যোগ্যতা নিজের মধ্যে আটকে রেখেছি। সবসময় নিজের মধ্যে গুটিয়ে থেকে সর্বক্ষণ প্রাণপণে ভেবেছি— 'আমার যোগ্যতা আছে, নিশ্চয়ই মানুষ আমাকে ডেকে নিয়ে যাবে।' কিন্তু আমি রবীন্দ্রনাথের সেই অমোঘ বাণীটি ভুলে গিয়েছিলাম— 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।' আমি সামনের দিকে একলা এগিয়ে যাইনি, আমি ভুল করে রবীন্দ্রনাথের অন্য একটি কথা আঁকড়ে ধরে ছিলাম— 'আমার জনম গেল বৃথা কাজে, আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে।' সত্যিই আমি ঘরের মাঝে বসে থেকে চিন্তা করেছি— আমার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন টা করা হয়নি। আমাকে ঠকানো হয়েছে, আমার সাথে অবিচার করা হয়েছে। অতএব, আমি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি— এই জীবন আমি রাখবো না, আমি এবার গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করবো! কারণ আমি যে ভীষণ অভিমানী এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। ব্যাস— মিটে গেল সব!


তাহলে বিষয় টা কি দাঁড়াচ্ছে? একজন মানুষ যদি এভাবে নিজের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং তারপর একটি হঠকারী সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তার ফলাফল কি তার জন্য সুন্দর হয়? তার এই কার্যক্রম তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরও অসংখ্য মানুষ, এমন কি গোটা সমাজের জন্য কতটা ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করতে পারে— এটা কি ঘুণাক্ষরেও তার ভাবনায় আসে? আমরা মানুষেরা জন্মগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ। প্রবাদে বলা হয়, 'মানুষ মাত্রই ভুল আছে।' কিন্তু সেই ভুলটা যতটুকু সম্ভব কম করার দায়িত্ব তো আমাদের নিজেদেরই, কারণ চিন্তাভাবনা করে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো বোধবুদ্ধি তো আমাদের আছে। তাহলে কেন আমাদের নিজস্ব বোধের সঠিক প্রয়োগ টা ঘটবে না? কেন শুধুমাত্র আমার নিজস্ব আত্মনিমগ্নতার দায় সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের এবং আশেপাশের সমস্ত মানুষের কাছে নিজেকে আরও ভুলভাবে রিপ্রেজেন্ট করবো? আমরা বরাবরই একটি কমন ব্যাপার ভুলে যাই, তা হলো— আমাদের যার যার নিজস্ব ব্যর্থতার দায়ভার কিন্তু অন্য সব মানুষের নয়। তারাও এক একজন স্বতন্ত্র মানুষ, তাদের নিজেদেরও আলাদা আলাদা জীবন আছে। তাদের জীবনেও কিন্তু সফলতা কিংবা ব্যর্থতা জড়িত আছে। তাদের ব্যর্থতার দায়ভার যদি আমি না গ্রহণ করি, তাহলে আমিও কিন্তু আমার নিজস্ব ব্যর্থতার জন্যে অন্যকে দায়ী করতে পারি না। কোনভাবেই এটা পারি না। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

১৬.০৩.২০২৪ খ্রিঃ

সোমবার, ১১ মার্চ, ২০২৪

'আত্মতত্ত্ব'

 সৌরজগতের এই তৃতীয় গ্রহটিতে যেদিন সর্বপ্রথম প্রাণের স্পন্দন শুরু হয়েছিল, সেই প্রাচীণ সময় থেকে শুরু করে আজকের এই দিন পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের অনেক কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হয়েছে। জলবায়ুগত কারণ এবং অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করার স্বার্থে অসংখ্য প্রাণী নিজেদের নানান ভাবে বিবর্তিত করে তাদের অস্তিত্ব দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, আবার বিশাল সংখ্যক প্রাণী এই পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে প্রাণীদের জন্যে আদি ও অকৃত্রিম নিয়ম-ই হলো সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।


'সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট' কথাটি দিয়ে বোঝানো হয়েছিল— যোগ্যতম দলই তাদের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারে। মূল বিষয় হলো টিকে থাকাটা ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হারিয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়া টাইপের বিষয়গুলো অনেকটা হেরে যাবার নামান্তর। হেরে গেলে বেশিদিন কেউ আর মনে রাখে না। জিতে যাওয়া কিংবা টিকে থাকাটাই হচ্ছে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে নিজেকে জানান দেবার আদিমতম সত্য। পোস্টমডার্নিজমের এই মুহূর্তে এসে ভীষণ প্রকটভাবে একটি বিষয় চোখে পড়ে। বিষয়টি হলো— এখনকার দিনে মানুষ খুব অল্পতেই মারাত্মক রকম হতাশ। খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছি যে, একেবারে সামান্য বিষয় নিয়েই মানুষ আজকাল নিজেকে শেষ করে দিতেও দ্বিধা করছে না। তারচেয়ে অবাক বিষয় হলো এই স্বেচ্ছামৃত্যুর পক্ষেও কেউ কেউ আজকাল যুক্তি দাঁড় করিয়ে বিষয়টিকে বৈধতা দেবার চেষ্টা করে। কাউকে কাউকে এখন জোরেশোরে বলতে শুনি— নিজেকে নিজে ধ্বংস করে দেওয়া যার যার নিজস্ব ব্যক্তিস্বাধীনতা। এসব কুযুক্তির ওপরে দাঁড়িয়ে লাগামহীন ভাবে প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলেছে স্বেচ্ছামৃত্যুর মিছিল। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আসেনি, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। ভালো ইন্সটিটিউশনে চান্স হয়নি, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। ভালোবাসার মানুষটি ছেড়ে চলে গেছে, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। দাম্পত্য জীবনে অশান্তি হচ্ছে, তাহলে সুইসাইড করতে হবে। কেন রে ভাই, জীবন টা কি এতটাই বেশি ঠুনকো! অন্য রকম কিছু কি ভাবা যায় না? আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে না গিয়ে বরং নিজের ক্ষমতার ওপর আস্থা রেখে নতুন কিছু বের করার চেষ্টা করা যায় না?


আমরা মানুষেরা অত্যন্ত চিন্তাশীল প্রাণী। উদ্ভাবনী ক্ষমতার জন্যেই আমাদের আজকের বিকাশ। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর সেই আদিম যুগ থেকে আস্তে আস্তে নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে আজ আমরা মহাকাশে পাড়ি জমাচ্ছি নতুন নতুন গ্রহের সন্ধানে। তাহলে সেই চমৎকার উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ হয়ে এই ধরণের হঠকারী সিদ্ধান্তের পেছনে কেন দৌড়াচ্ছি আমরা? আমাদের আবারও সেই পেছনের দিনগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হবে। আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে নিজেদের মস্তিষ্কের ক্ষমতার ওপর। ছোটখাটো আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে। পৃথিবীতে একটি স্বতন্ত্র প্রাণী হিসেবে সেই আদিমতম সত্যটি মাথায় রাখতে হবে। তা হলো— সমস্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করে নিজেকে টিকিয়ে রাখা। কারণ একটি প্রাণী হিসেবে নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করার চেয়ে শ্রেষ্ঠতম বিষয় পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

রবিবার, ১০ মার্চ, ২০২৪

'জেমস বোয়েন এবং তার বব'

দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডের 'সারে' নামক কাউন্টি শহরে জেমস বোয়েন নামে একজন গৃহহীন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বাস করতেন। তার সম্পূর্ণ নাম জেমস অ্যান্থনি বোয়েন। শৈশবে তার বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং সেই সময়ে তিনি তার মায়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ব্যায়বহুল শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিজের মনঃসংযোগের ঘাটতির কারণে মাঝপথে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর মাত্র সতেরো বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষনে তিনি আবারও তার জন্মভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডের সারে রাজ্যে ফিরে তিনি নানান পেশায় যুক্ত হবার চেষ্টা করার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা শুরু করেছিলেন। চলমান জীবনের নানান খুটিনাটি অসংগতি এবং জটিলতা তার মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে দিয়েছিল সেই সময়। ফলশ্রুতিতে তিনি অসৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হেরোইনে আসক্ত হয়ে যান। মাদকাসক্ত হবার কারণে তার সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ ছিল না। তিনি মাঝেমধ্যে রাতের বেলা কোন নির্জন পার্কে কিংবা রাস্তার পাশের যাত্রীছাউনিতে ঘুমিয়ে থাকতেন। নানান ধরনের ছোটখাটো কাজ করে এভাবেই একটি মানবেতর জীবন কেটে যাচ্ছিল জেমস বোয়েনের।


২০০৭ সালের এক সন্ধ্যা বেলায় নির্জন একটি রাস্তা দিয়ে আপনমনে গানের সুর ভাজতে ভাজতে জেমস বোয়েন তার বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিনি রাস্তার পাশে একটি বিড়াল কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেন। তিনি স্বাভাবিক ভাবে বিড়ালটির পাশ কাটিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। পরদিন যথারীতি তিনি তার নানাবিধ ছোটখাটো কাজ করে সন্ধ্যা বেলায় হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন। আর্থিক অনটনের জন্যে ট্যাক্সি ধরার সুযোগ তার ছিল না। তখনও তার ডিনার হয়নি, অথচ পকেটে পড়ে আছে সর্বসাকুল্যে মাত্র কুড়ি পাউন্ড! আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি রাস্তার পাশে তাকালেন এবং গতকালের সেই বিড়ালটিকে আবারও একই জায়গায় বসে থাকতে দেখলেন। এবার তিনি খানিকটা কৌতূহলী হয়ে বিড়ালটির কাছে গিয়ে দেখলেন— ওটার গলায় কোন বেল্ট কিংবা ট্যাগ নেই, বিড়ালটি কিছুটা রুগ্ন এবং ওর মুখে আঁচড়ের দাগ। এসব দেখে জেমস বোয়েনের মন খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি নিজেও একজন গৃহহীন ধরনের রাস্তার মানুষ। তিনি বিড়ালটিকে তুলে নিয়ে আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে বিড়ালটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— এটা কারো হারিয়ে যাওয়া বিড়াল কিনা, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিড়ালটির কোন মালিক খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি তখন অসুস্থ বিড়ালটিকে নিয়ে একজন পশু চিকিৎসকের দারস্থ হলেন। চিকিৎসার খরচ বাবদ তিনি তার কাছে থাকা বিশ পাউন্ডের পুরোটাই দিয়ে দিলেন। এরপর বিড়ালটি কিছুটা সুস্থ হলে তিনি বিড়ালটিকে নিয়ে ঠিক সেই জায়গায় হাজির হলেন— যেখানে তিনি বিড়ালটিকে পেয়েছিলেন। তিনি ওটাকে ওখানে ছেড়ে দিলেন, যাতে বিড়ালটি তার ঠিকানায় নিজে নিজে ফিরে যেতে পারে। জেমস বোয়েন ওটাকে রেখে নিজের ঘরের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন এবং একটা সময় হঠাৎ খেয়াল করলেন যে, বিড়ালটি তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তিনি তখন বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। তিনি বিড়ালটির নাম রাখলেন 'বব'।


জেমস বোয়েন অনেকদিন ধরে মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কেন জানি কোনভাবেই এটা সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ করে এই বিড়ালটিকে নিজের কাছে এনে রাখার পর তার মনে আবারও সুস্থভাবে বাঁচার ইচ্ছে জাগ্রত হলো। তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নেওয়া শুরু করলেন এবং আবারও নিজের মতো করে পুনরায় সঙ্গীতচর্চা শুরু করলেন। দৃঢ়ভাবে মনঃসংযোগ ঘটিয়ে এরপর একটা সময়ে তিনি মাদকদ্রব্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। এরপর তিনি একটা গীটার নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইতেন এবং বব নামের বিড়ালটি তার পাশে চুপচাপ বসে থাকতো। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন, তাতে তার এবং ববের জীবন মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল। প্রায়ই জেমস বোয়েন কে হাতে গীটার এবং কাঁধে পোষা বিড়াল নিয়ে রাস্তায় চলতে দেখা যেতো। স্থানীয় মানুষদের কাছে আস্তে আস্তে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এভাবেই একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার গান শুনতে আসা একজন শ্রোতা তাকে একটি বই লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন— যিনি ছিলেন একজন প্রকাশক। জেমস বোয়েন সেই প্রকাশকের কথা বিবেচনা করে নিজের জীবন এবং বব নামের বিড়ালটির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে 'এ স্ট্রিট ক্যাট নেমড বব' নামে একটি বই লিখলেন। বইটি ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বইটি 'বেস্টসেলার বুক' হবার কৃতিত্ব অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে এই বইটি নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি হয়, যেটা ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে একসাথে থাকার পর ২০২০ সালে বব নামের এই বিড়ালটি রাস্তায় একটি গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। তখন বিড়ালটির বয়স হয়েছিল আনুমানিক পনের বছর।


আমি কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি বিচ্ছিন্ন ছবি দেখে সেটাকে নিজের প্রোফাইলের স্টোরি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম— যেখানে একজন লোক রাস্তার পাশে গলায় গীটার ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং তার পায়ের কাছে একটি বিড়াল চুপচাপ বসে ছিল। গতকাল রাতে হঠাৎ কি মনে করে 'স্ট্রিট মিউজিশিয়ান উইথ ক্যাট' লিখে গুগলে সার্চ দেবার পর জেমস বোয়েন সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানতে পারলাম। অনেক সময় একটি চতুষ্পদ প্রাণীও যে একজন মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং ভীষণ আপনজন হয়ে উঠতে পারে, তার জলন্ত উদাহরণ হলেন জেমস বোয়েন।


© কৃষ্ণেন্দু দাস ||

 ১০.০৩.২০২৪ খ্রিঃ

বুধবার, ২৪ জানুয়ারি, ২০২৪

'যাপিত এইসব দিন'


কুয়াশাচ্ছন্ন শীতার্ত দিনগুলোতে অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু দেরি করেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে। শরীরের মাঝে কিংবা অবচেতনে কোথায় যেন একটা আড়ষ্টতা বেশ ভালোভাবেই থাবা গেড়ে বসে থাকে। কম্বল টা আরও খানিকটা টেনে কান এবং গলা ঢেকেঢুকে দিব্যি বেলা এগারোটা পর্যন্ত পড়ে থাকতে ভালোই লাগে আমার। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই বিচিত্র অভ্যাস টা যদিও আমার আগে কখনও ছিল না, বছর দুয়েক ধরে এভাবে থেকে আরাম বোধ করি। এটাই বয়স হয়ে যাবার সেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। বুড়ো হচ্ছি আমি। ইদানীং চিন্তাভাবনার মধ্যেও আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে নিজেই কিছুক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে থাকি। শরীরের মধ্যেও এসেছে শ্লথ হয়ে যাবার সুক্ষ্ম অনুভূতি। একটি বিষয় খুব নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করতে পারি আজকাল। মানুষের পুরোটা জীবনকালে দুটো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় আসে। একটি হলো তার বাল্য থেকে যৌবনে পদার্পণের সেই বিশেষ সন্ধিক্ষণ, যাকে বলে বয়ঃসন্ধিকাল, আর দ্বিতীয়টি হলো তার যৌবন থেকে বার্ধক্যে পদার্পণের বিশেষ সন্ধিক্ষণ। আমরা আমাদের প্রচলিত জীবনে শুধুমাত্র বাল্য থেকে যৌবনে যাবার সময়টা নিয়েই বেশি আলোচনা করি। এই স্টেজে থাকা কিশোর-কিশোরীদের মনো-দৈহিক অবস্থার বিবিধ বর্ণনা করে থাকি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ছুটি' গল্পে লেখক লিখেছিলেন, তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।' রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'সমাপ্তি' গল্পে লিখেছিলেন, 'কখন বিধাতা তাঁর নিপুণ অস্ত্র দ্বারা মৃন্ময়ীর বাল্য ও যৌবনের মাঝখানে আঘাত করিয়াছিলেন সে জানিতে পারে নাই।'


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে আরও অসংখ্য অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র কৈশোরের এই বয়ঃসন্ধিকালের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিধ বর্ণনা করে গেছেন। অথচ একজন মানুষ যখন তার যৌবনকাল অতিক্রান্ত করে বার্ধক্যের দরজায় কড়া নাড়তে শুরু করে, সেই সময়কার একজন মানুষের মনো-দৈহিক পরিবর্তন কিংবা সেই মুহূর্তে দাঁড়ানো একজন মানুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেভাবে আলোচনা করতে তেমন কেউ আগ্রহী হননি। ঠিক যেভাবে তোরো-চৌদ্দ বছরের একজন মানুষ তার আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন দেখে চমকে যায়, সেটার সঠিক ব্যাখ্যা করতে না পেরে একধরণের হীনমন্যতায় ভোগে, একইভাবে চল্লিশ বা একচল্লিশ বছর পার করা একজন মানুষের জন্যেও তার ব্যক্তিগত জীবনের আকষ্মিক কিছু পরিবর্তন দেখে বিষ্মিত হওয়া এবং এটার সঠিক কোন ব্যাখ্যা না পেয়ে নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়ার কষ্টকর অনুভূতি হয়। এই বিশেষ স্টেজ টা অনেকেই পার করে গেছেন এবং আরও অনেকেই পার করে যাবেন। যারা এটা পার হয়ে গেছেন, তারা প্রত্যেকেই জানেন এই সময়টিতে তাদের কেমন আকষ্মিক অনুভূতি হয়েছিল। আমি এখন এই স্টেজে দাঁড়িয়ে এটাকে বুঝতে চেষ্টা করছি। এই মুহূর্তের সবচেয়ে খারাপ মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব হলো কোনকিছুতে আগ্রহ না পাওয়া এবং মাঝেমধ্যে সবকিছুকেই অর্থহীন মনে হওয়া। এই সময়েই সম্ভবত একজন মানুষ তার জীবনে 'কি পেলাম আর কি হারালাম' টাইপের বিষয় টা প্রথম ভাবতে শুরু করে, আস্তে আস্তে এই ভাবনা টা আরও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে বিশাল মহীরুহ হয়ে দাঁড়ায়। এই স্টেজে দাঁড়িয়েই মানুষের মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতির প্রথম জন্ম হয়, সেটা হলো চারপাশে অনেক মানুষজন থাকার পরেও অকারণে নিঃসঙ্গতার এক অদ্ভুত অনুভূতি। আমি অসংখ্য অসংখ্য পুরোদস্তুর সংসারী মানুষের সাথে কথা বলে দেখেছি, তাদের এই সময়ে এসে এই বিশেষ অনুভূতি তৈরি হয়েছে। এই স্টেজে এসেই একজন মানুষ হঠাৎ করে শারীরিক ক্লান্তিকে প্রথম বার প্রচ্ছন্ন ভাবে অনুভব করতে শুরু করে, যেটা দুই-এক বছর আগেও তার ছিল না। এই সময়ে এসে একজন মানুষ হঠাৎ করেই অকারণে কিছুটা খিটখিটে আচরণ শুরু করে, অল্পতেই তার মেজাজ হারাতে শুরু করে। এটা যদিও পরে ব্যালান্স করে নেয়, কিন্তু এই সময়ের এই হঠাৎ ক্ষিপ্ততা তার নিজের জন্যেও অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এই বয়সে এসে একজন মানুষের মধ্যে ধৈর্যের আকষ্মিক একটা অভাব এসে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিনের যাপিত জীবনে তার সেই ধারণ করা মনোযোগে ঘাটতি এসে যায়। দীর্ঘদিনের একজন বাচাল মানুষও এই সময়ে খানিকটা চুপচাপ হয়ে যায়। তোরো-চৌদ্দ বছর বয়সে একজন মানুষ একটু একটু করে নিজেকে চারপাশে ছড়িয়ে দিতে প্রস্তুত হয়, কিন্তু এই চল্লিশ-একচল্লিশ বছর বয়সে এসে মানুষ হঠাৎ করে খানিকটা গুটিয়ে যেতে শুরু করে। সহজে বলতে গেলে বাহুল্যটুকু ঝেড়ে ফেলে নিজের নিরেট টুকুকে আশ্রয় করে সে আগামীর জন্য প্রস্তুত হয়। এই সময়ে এসে একজন মানুষ হঠাৎ করে অনেক অপ্রকাশিত বিষয় বুঝে ফেলতে শুরু করে। তার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন টা হয় তার বোধের।


শ্লথ হয়ে যাওয়া চেতনার সাথে নিজের এই আলাপনের মাঝে কখন জানি দুপুর গড়িয়ে গেছে। আজকেও রোদের দেখা মেলেনি। চারপাশে কেমন একটা কুয়াশায় ভেজা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ, অকারণে মনটা খানিকটা ডাউন করে দেয়। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু শরীরে কোথায় যেন চিরাচরিত সেই উৎসাহ টা খুঁজে পাচ্ছি না। বিড়ালগুলো গতকাল রাত থেকে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের নিজস্ব প্রাকৃতিক চাহিদার কাছে আমার মতো তুচ্ছ একজন মানুষের কাছে নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়া ওদের কাছে গৌন। সবাই আছে যার যার নিজস্ব প্রয়োজন আর মানিয়ে চলার প্রথাগত অভ্যাসের টানে। পৃথিবীও ঘুরে বেড়াচ্ছে অচিন সেই মহাকর্ষ সূত্র ধরে। দিন ফুরিয়ে রাত আসছে, আবারও রাত ফুরিয়ে দিন। এই কুয়াশায় মোড়া শীতের সময় বিদায় নিয়ে সামনেই আসবে মাঠঘাট চৌচির হওয়া চৈত্রের দাবদাহ। নানান আয়োজনে পূর্ণ হবে সবার জীবন কিংবা উজাড় হবে কেউ কেউ। আহা! কতটাই না তুচ্ছ এই জীবন! অথচ আমরা টেনেটুনে, ফুলিয়ে-ফালিয়ে এটাকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করি। এখন কষ্টেসৃষ্টে চারটে মুখে দিতে হবে, মহিমান্বিত না হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাটাই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কী আর করবো, আমার সময়টাই যে এখন গোলমেলে! ঠাকুরদা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে বলতাম, শুধু তোরো-চৌদ্দ বছর-ই বালাই নয় ঠাকুর মশাই, চল্লিশ-একচল্লিশ বছরও খুব বড় একটা বালাই। যে বালাইনাশক খুঁজতে গিয়ে আজকাল নিজেকে নিয়ে খুব বেশি বিপত্তির মধ্যে আছি। 


© কৃষ্ণেন্দু দাস/ 🍂

২১.০১.২০২৪ খ্রিঃ

মঙ্গলবার, ২৯ আগস্ট, ২০২৩

'প্রিয় চল্লিশ বছর'

 

সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে এই প্ল্যানেটে জন্ম নেবার পরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখা এবং অনেক অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ধীরেসুস্থে জীবনটাকে টেনেটুনে আরও খানিকটা দীর্ঘায়িত করা। একটি বহুকোষী প্রাণী হিসেবে আমাদের লাইফের জার্নি টা সত্যিই ভীষণ কঠিন। জন্ম প্রক্রিয়ার শুরুতেই মিলিয়ন মিলিয়ন স্পার্মের সাথে প্রাণপণে দৌড়ের প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে নিষিক্ত হবার পুরষ্কার প্রাপ্তি শেষে নিজেকে ভ্রূণের রূপে কনভার্ট করা, এরপর একটি ফিটাস হিসেবে আত্মপ্রকাশ, তারপর... আস্তে আস্তে মাতৃগর্ভে প্রবল ধৈর্য্য সহকারে নিজের পূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে একটি বিশেষ দিনে প্রকৃতির অপার মায়ায় ঘেরা এই পৃথিবীতে প্রথম বারের মতো বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া কিংবা প্রথম বারের জন্যে ঠিকরে ওঠা তীব্র আলোর বিচ্ছুরণে চোখ মেলে বিস্মিত হওয়ার প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে পরম সৌভাগ্যের বিষয়। জন্ম নেবার আগেই অসংখ্য শিশু মাতৃগর্ভে তার লাইফের জার্নি শেষ করে, অপূর্ব সুন্দর এই পৃথিবীকে আর তাদের দেখার সৌভাগ্য হয় না!
একজন মানব শিশুর জন্ম নেবার পর থেকে তার বেড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটি আরও অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং একটি বিষয়। শিশুকালেই তার চারপাশে মারাত্মক কিছু রোগব্যাধি হুমকি হয়ে বিচরণ করে, সেসব রোগের সাথে মোকাবিলা করতে হয়, শরীরে পর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করতে হয়। এছাড়া খাবারের বিষক্রিয়া, মায়ের অসচেতনতার কারণে হঠাৎ দূর্ঘটনার শিকার হওয়া, ক্ষতিকর প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হওয়া, জলাশয়ে পড়ে ডুবে যাওয়া, ছেলেধরা কর্তৃক ধৃত হওয়া, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া সহ আরও অনেক ধরনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শৈশব থেকে একজন মানুষ কে বেড়ে উঠতে হয়। পরবর্তী সময়ে তার জীবনের দুর্গম পথে প্রতিটি মুহূর্তেই তাকে খুব বেশি সতর্কতার সাথে এগিয়ে চলতে হয়। এই যাত্রা বড়ই দুরূহ। কারণ তার চলার পথে ওঁৎ পেতে থাকে প্রাণঘাতী বিভিন্ন রোগ, প্রতিটি দিনে থাকে সড়ক দুর্ঘটনায় নেই হয়ে যাবার সংশয়, থাকে নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, থাকে শত্রু দ্বারা নিহত হবার সম্ভাবনা, এছাড়াও থাকে নিজের মধ্যে জেঁকে বসা তীব্র হতাশার কারণে আত্মঘাতী হবার সম্ভাবনা। এতো এতো বৈপরীত্য অতিক্রম করে একজন মানুষ যখন নিজেকে গভীর যত্নে দীর্ঘদিন ধরে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়, এর চেয়ে চমৎকার ব্যাপার আর কী-ই বা থাকতে পারে!

আজ ২৯ শে আগষ্ট ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ। এই প্রতিকূলতার পৃথিবীতে আজ আমি আমার জীবনের চল্লিশটি বছর পূর্ণ করলাম। একজন মানুষের জীবনে চল্লিশ বছর যথেষ্ট দীর্ঘ একটি সময়। এতো লম্বা একটি সময় ধরে নিজের অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখতে পেরে আজ আমি ভীষণ আনন্দিত। এই দীর্ঘ চল্লিশটি বছরের হিসেব মেলাতে গিয়ে আজ মনেহলো, আমার প্রাপ্তির ঝুলিতে পূর্ণতার তেমন কমতি নেই। কারণ পৃথিবী নামক এই গ্রহে কোটি কোটি প্রাণীর ভীড়ে বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন, সুস্থ-স্বাভাবিক একজন মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে পারা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে স্বীয় বোধের দ্বারা এর উদ্দেশ্য সমূহের কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারা'টা কি কম সৌভাগ্যের বিষয়! প্রতিটি দিনের কাকডাকা ভোরের সূর্যোদয় থেকে শুরু করে ঝিঁঝিঁডাকা নীরব রাতের মধ্যপ্রহর পর্যন্ত প্রত্যেকটি মুহূর্ত কে নিজের মতো করে উপলব্ধি করেছি, জীবন কে বুঝতে চেয়েছি একান্তই ব্যক্তিগত দর্শনের আলোকে। গিনিপিগের মতো নিজেকে অসংখ্য বার ছিঁড়েখুঁড়ে বুঝতে চেয়েছি এই জীবনের অর্থ কি, কেন বেঁচে থাকে মানুষ? কোন তীব্র স্বপ্ন কে সাকার করার জন্য চারিদিকে এতো এতো দাঙ্গা হাঙ্গামা? মোহগ্রস্তের মতন এতো এতো মানুষ প্রতিনিয়ত কোথায় ছুটে যাচ্ছে? এইসব প্রশ্নের ভীড়ে আমার আজও জানা হয়নি অনেক কিছুই, খোঁজা হয়নি নিজেকে একান্ত নিজের সত্তার গভীরে। তবুও নিত্যকার যাপিত জীবনের খুটিনাটি নিয়ে আরও খানিকটা ভাবালুতা পেয়ে বসবে আমাকে, বেলা শেষে প্রতিটি দিন ফুরাবে নীরব রাতের জঠরে। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে বয়ে যাবে সময়, আর এর রেশ ধরেই একদিন বাজবে চীর বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি। এইতো সব! তবুও সর্বসাকুল্যে ক্ষুদ্র এই জীবনের কাছ থেকে যতটুকু যা পেয়েছি তাতেই আমি খুশি। এই পর্যন্ত যাপন করা জীবনে কি পাইনি বা কতটুকু হারিয়েছি, সেইসব নিয়ে অযথা আক্ষেপের চেয়ে এটা ভাবতেই এখন ঢের আনন্দ হচ্ছে যে, আজ থেকে উনচল্লিশ বছর আগে ঠিক এমনই একটি দিনে এই নীল-সবুজের গ্রহে জন্মেছিলাম আমি!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
২৯.০৮.২০২৩ খ্রিঃ

বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩

'নির্লিপ্ত স্মৃতিচারণ'

 

কেন জানি আজ খুব করে মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব দিনগুলোর কথা। তখন সবেমাত্র এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি, সেটা ছিল ২০০০ সালের কথা। পড়াশোনার সমস্ত চাপ হঠাৎ করে শেষ হবার পর নির্লিপ্ত সময় কিছুতেই কাটছিল না। একে তো কিশোর বয়স, তার ওপর অদেখা আগামীর বর্নিল হাতছানি। সবকিছু মিলিয়ে খানিকটা দিশেহারা আমি তখন। ঠিক সেই সময় তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা। আসলে ওই সময় গুলোকে এখন ব্যাখ্যা করতে পারবনা। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় যদিও স্কুলে। আমরা দুজনেই সহপাঠী ছিলাম। খুবই চুপচাপ ধরনের ছেলে ছিল সে। স্কুল জীবনে কখনও তার সাথে কথা বলেছি বলে তো মনে পড়েনা। তবে এস.এস.সি পরীক্ষার আগে তিন মাস আমাদের স্কুল টিচার অরুন স্যারের কাছে কেমিস্ট্রি পড়েছিলাম। অরুন স্যারের ব্যাচে গিয়েই ওর সাথে আমার প্রথম আলাপ। কে জানত, এই সাদামাটা নিতান্ত অমিশুক ছেলেটাকে আমি এতটা পছন্দ করে ফেলব!

ওর নাম শিমুল। সম্পূর্ন নাম মোঃ আখিরুজ্জামান। যাইহোক, পরীক্ষার পরের সময়গুলো আমাদের যে কতটা আনন্দে কেটেছে তা ব্যাখ্যাতীত। আমরা তখন রেগুলার নিয়ম করে যেটা করতাম তা হল, সাইকেল নিয়ে পুরোটা বাগেরহাট চক্কর দেওয়া। ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। এরপর আমরা লঞ্চ টার্মিনালের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে বসে স্ন্যাকস্ আর কফি খেতাম। জীবনে অনেক ভালো ভালো খাবার হয়তো খেয়েছি, কিন্তু সেই সময়ের মতো মজা কখনও উপভোগ করতে পারিনি। আর এই সবকিছুই শিমুলের জন্য। আমাদের প্রতিদিনকার ভ্রমনের জায়গা ছিল সাধারনত ষাটগম্বুজ স্টেশন, সাবেকডাংগা, হাঁড়িখালির কাঠের পুল, ভৈরব নদীর পাড়, দশানী প্রভৃতি। কিছুদিন পর আমাদের সাথে যুক্ত হয় আমাদের স্কুল জীবনের আর এক সহপাঠী রিফাত আদনান রাজন। তবে সেইসময়ে রাজন আমদের সাথে খুব বেশি ঘনিষ্ট না হলেও তার মাধ্যমে আমরা অসাধারন একটা বন্ধু পেয়েছিলাম। তার নাম আল ওয়াসিম রনি। এরপরের দিনগুলোতে প্রধানত আমরা তিনজনেই বেশি আড্ডা দিয়েছি। শিমুল, রনি এবং আমি। কিছুদিন পরে শিমুল খুলনা চলে যায়। সেই সময়ে ভীষণ ভাবে মিস করতাম ওকে। সত্যি বলতে কি, শিমুল কে ছাড়া কোন আড্ডাই কখনও জমত না। তবে পড়াশোনার ফাঁকে কখনও ছুটিছাটা পেলেই শিমুল চলে আসত। ততদিনে আমাদের আড্ডাস্থল পরিবর্তিত হয়ে দশানী পচাঁদীঘির পাইপের ওপর এসেছে।

তখন ২০০৩ সাল। হঠাৎ ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা দিনাজপুর বেড়াতে যাব। যেই কথা সেই কাজ, কোন রকম প্রস্তুতি ছাড়াই আমি আর শিমুল ডিসেম্বরের সেই কনকনে ঠান্ডায় ট্রেনে চড়লাম। গভীর রাতে অন্ধকার ভেদ করে ছুটে যাচ্ছে সীমান্ত এক্সপ্রেস, আমরা দুই বন্ধু বিস্মিত চোখে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছি। এরপর কত অসংখ্য বার যে ট্যুর করেছি, কিন্তু সেই ট্যুরের অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ন ভিন্ন। আসলে শিমুল ছিল অন্য রকম একটা ছেলে। প্রেম করা তো বহুদূরের বিষয়, কখনও কোন মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আসলে চরিত্রগত কারনে নাকি অন্য কোন কারনে ওর প্রতি আমার আলাদা ধরনের এক অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল, যা আজও অবিচল।

এরপর জীবনে এসেছে হাজার রকম চড়াই-উৎরাই, অনেক রকম অভিজ্ঞতায় হয়েছি পরিপূর্ন। পরিচিত হয়েছি অসংখ্য মানুষের সাথে। অনেক বন্ধু এসেছে, অনেক বন্ধু হরিয়েও গেছে। আমি জানিনা, হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন, সেই সব প্রিয় বন্ধু আজ কোথায়! অনেকে আজ কাজের সন্ধানে হয়েছে প্রবাসী, অনেকে সম্পূর্ন ভাবে জড়িয়ে গেছে সংসার জীবনে। জীবন থেকে একটু একটু করে হারিয়ে গেছে দিন, মাস, বছর, যুগ। পৃথিবীও একটু একটু করে ঘুরে যাচ্ছে অবিরত তার নিজের অক্ষে। শুধু অমিই হয়তো এখনও দাঁড়িয়ে আছি একই জায়গায় পুরোনো কিছু স্মৃতিকে আকড়ে নিয়ে। তবে সবকিছু বদলে গেলেও শিমুল কিন্তু এখনও হারিয়ে যায়নি। আজও কর্মব্যাস্ততার মাঝে একটু সময় পেলেই সে আমার কাছে আসে। আমরা আবারো ফিরে চলে যাই ফেলে আসা সেইসব দিনে, হয়তো পুরনো সেইখানে, ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলাম বহু বছর আগের কোন একদিন!

© কৃষ্ণেন্দু দাস/
🍂

'ব্যক্তিগত দর্শন'


খুব সম্ভবত নবম কিংবা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে আমি মোতাহের হোসেন চৌধুরী'র লেখা 'শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব' নামক গদ্যটি পড়ে ভীষণ ভাবে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখনকার বয়সে যদিও সেইসব দার্শনিক কথার তাৎপর্য বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু বিষয়টি মাথায় ঠিকই থেকে গিয়েছিল এবং বেড়ে ওঠার সাথে সাথে একসময় বুঝতে পারলাম ঠিক কতখানি গভীরতা রয়েছে ঐ লেখাটির মাঝে। এরপর পরিনত বয়সে এসে একটু একটু করে প্রাচ্য দর্শন, আত্মিকবাদী রচনা, স্পিরিচুয়ালিটি ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে প্রচুর পড়েছি এবং নিজে নিজে চিন্তা করে বিষয়গুলোর ব্যাপকতা বুঝতে চেষ্টা করেছি। স্বতন্ত্র একটি প্রাণী হিসেবে এই পৃথিবীতে জন্ম নেবার পর একজন মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত কোথায় ছুটে চলেছি, কি মহান উদ্দেশ্য কে চরিতার্থ করার জন্য আমাদের এই প্রাণপণ প্রচেষ্টা এবং এতো এতো লাফঝাঁপ করে অবশেষে আমাদের প্রাপ্তি ঠিক কতটুকু? এই ভাবনাগুলো আমাকে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। আমি দেখেছি- প্রাচীণকাল থেকে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা এবং পুরুষানুক্রমিক প্রথা কে আঁকড়ে ধরে অনিশ্চিত পথে ছুটে যাচ্ছে বর্তমানের মানুষ। অনেকে আদৌ জানেই না কেন তারা বাধ্যতামূলক ভাবে এসব করে যাচ্ছে! মুলত একটি সদ্যোজাত শিশুর জন্মের পর যখন সে একটু বড়ো হয়, তখনই তাকে তার পরিবার এবং পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থায় অনিবার্য ভাবেই কিছু শিক্ষা নিতে হয়। তাকে শেখানো হয়ঃ

'তুমি এখন স্কুলে যাবে তারপর আরও একটু বড়ো হয়ে কলেজে যাবে। তোমার পাঠ্য বইয়ে মোতাহের হোসেন চৌধুরী কি লিখেছেন তা শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় লিখে আসবে, তাহলে রেজাল্ট ভালো হবে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে অর্থাৎ ভালো রেজাল্ট করতে হবে। সবশেষে তোমাকে একটি সনদপত্র দেওয়া হবে, যেটি দেখিয়ে তুমি একটি মানসম্মত চাকরি পেতে পারো। তারপর তোমার উপার্জন প্রদর্শন করে তুমি বিপরীত লিঙ্গের একজন সঙ্গী বেছে নিয়ে সন্তান উৎপাদন করবে এবং তাদের প্রতিপালন করবে, একটি সময় সমূহ জরা নিয়ে বার্ধক্য এসে তোমাকে ঢেকে দেবে আর তুমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হবে। ব্যাস! এটাই তোমার পুরো জীবন। তুমি নিজেকে এভাবেই পরিচালিত করবে কারণ তোমার পূর্বপুরুষেরাও ঠিক এটাই করে এসেছেন!'
কোমলমতি শিশুরাও পারিবারিক কিংবা সামাজিক সেই আদেশ শিরোধার্য করে রণপা হয়ে এগিয়ে চলে অদেখা আগামীর পথে। যদি তাদের মধ্যে কেউ প্রশ্ন করে বসে, 'আচ্ছা, আমার পূর্বপুরুষগন এই কাজ করে গেছেন বলে আমাকেও কেন একই ট্রেডিশন মেনে চলতে হবে? আমি তো স্বতন্ত্র একটি প্রাণী, আমি তো স্বতঃস্ফূর্ত সত্তা, আমার মগজেও তো ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন নিউরন রয়েছে, যেখানে ইউনিক সব ভাবনা কিলবিল করে!' এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পরিবার কিংবা সমাজ একবাক্যে বলবে- তুই দুই লাইন বেশি বুঝিস, তোর মাথায় সমস্যা আছে। হাহাহা... ম্যাক্সিমাম মানুষের চিন্তার সাথে ম্যাচ না করলেই একজন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায়, তাই না?! খুবই হাস্যকর থিওরী!

ছোটবেলায় দেখতাম গ্রামাঞ্চলে ধান মাড়াই করার জন্য সারা উঠোনে সদ্য কাটা ফসল ছড়িয়ে রাখা হতো। উঠোনের মাঝখানে একটি খুঁটি পুঁতে সেই খুঁটির সাথে পাঁচ-ছয়টি গরুকে সারিবদ্ধভাবে বেঁধে রাখা হতো। কেন্দ্রে যে গরুটি থাকতো, বাকী গরুগুলো তাকে অনুসরণ করে চলতে থাকতো। কেন্দ্রের গরুটি দাঁড়িয়ে পড়লে অন্য গরুগুলোও দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হতো। পুরুষানুক্রমিক প্রথা আমার কাছে একই সিস্টেম। এই প্রথার মাধ্যমে আমাকে শেষপ্রান্তে উপস্থিত গরুটির মতো পরপর সারিবাঁধা হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের গরু অর্থাৎ আমার পূর্বপুরুষ কিভাবে হাঁটা-চলা করে, আমাকেও সামাজিক ভাবে সেভাবে হাঁটতে বাধ্য করা হয়। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, এই ধান মাড়াইয়ের গরু হতে রাজি না হলে বলা হয়- তুমি একটু বেশি বোঝো। তোমার মতো দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো, যার মানে তোমার সমাজচ্যুত হয়ে যাওয়া উচিৎ! মাত্র তিন কি চারদিন আগে আমার এলাকার একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আমাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বললেন, 'বাপ্পী, তুমি সবসময় একটু বেশিই বোঝো। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেক ছেলেপুলে তোমার চিন্তা ভাবনার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। তুমি দয়া করে নতুন প্রজন্মের কাউকে কোন ভুলভাল থিওরী দিও না!'
তার কথায় আমি হোহো করে হেসে উঠলাম। তিনি বিব্রত হয়ে বললেন, আমি কি কোন হাসির কথা বলেছি?
আমি বিনীতভাবে তাকে বললাম, 'জানেন, বহুকাল আগে প্রাচীণ গ্রীসে সক্রেটিস নামে একজন মানুষ ছিলেন। তিনিও একটু বেশিই বুঝতেন। তাঁর চিন্তার প্যাটার্ন বুঝতে না পেরে সেই সময়ের মানুষেরা প্রায়ই অভিযোগ করতেন যে, তিনি নতুন প্রজন্মের মানুষকে ভুলভাল শিক্ষা দিচ্ছেন!' আমার কথাটি শুনে ভদ্রলোক ভ্যাবদা মেরে বসে থাকলেন।
যাইহোক, যে নিজস্ব দর্শন শেয়ার করতে চেয়েছিলাম, সেই বিষয়টি নিয়েই বরং কথা বলা যাক। খাঁচায় বন্দী করে রাখা একটি পাখির জীবন লক্ষ্য করেছেন কখনও? বন্দী পাখিটির সর্বক্ষণ চেষ্টা থাকে কিভাবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায়। সে যখন লোহার খাঁচা থেকে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মনের মধ্যে কি চলে সেটা কি উপলব্ধি করতে পারেন? পাখিটিকে কিন্তু খাঁচার মধ্যে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু প্রচুর পরিমাণ খাবারের লোভ তাকে একবিন্দু আকৃষ্ট করতে পারে না। সে যদি কোনভাবে খাঁচা থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, তখন নীল আকাশে ডানা মেলে সে যে মুক্তির স্বাদ পায়, তার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় সুস্বাদু খাবার তুচ্ছ। হয়তো অক্লান্ত চিত্তে আকাশে উড়ে বেড়াতে গিয়ে সারাদিনে সে খাবার হিসেবে একটি পোকা পেতেও পারে কিংবা অভুক্ত থাকতেও পারে। তবুও তার মনে কোন খেদ থাকেনা। সে কি কখনো খাবারের লোভে আপনার খাঁচায় বন্দী হবে?!

ঠিক একইভাবে ব্যক্তিগত জীবনেও একজন মানুষ স্বাধীনভাবে একটি জীবন কাটাতে চাইতেই পারে। তার জীবনে হয়তো অর্থকষ্ট থাকবে, সামাজিক প্রতিকূলতা থাকবে, বিলাসী জীবনের অভাব থাকবে, কিন্তু সে যে কতখানি গভীর আত্মিক প্রশান্তির মাঝে বেঁচে থাকবে- সেটা কি কল্পনা করতে পারেন?
আমি অসংখ্য মানুষ দেখেছি, পরিশ্রম করতে করতে যারা রাতদিন এক করে ফেলে। দিনশেষে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে ঘরে ফিরেও বউ-বাচ্চা এবং পরিবারের সবাইকে সে খুশি করতে পারে না। এই শ্রমক্লান্ত মানুষটি যখন বারান্দায় বসে ফ্যালফ্যাল করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে, তখন তার মধ্যে আমি খাঁচায় বন্দী সেই পাখিটিকে খুঁজে পাই, যে চারপাশে প্রচুর খাবার থাকা সত্ত্বেও খাঁচা ভেঙে উড়াল দিতে চায়। একটি বারের জন্য মুক্তির স্বাদ পেতে চায়! কিন্তু সংসার নামক এক জগদ্দল পাথর তার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে থাকে। সে না পারে এই বিতৃষ্ণা থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে। তাহলে এতো এতো কাঠখড় পুড়িয়ে কতটুকু লাভ হলো? এর সদুত্তর দেবার ক্ষমতা কিন্তু আপনার ট্রেডিশনাল সমাজব্যবস্থার নেই।

তাই শৈশবে একটি শিশুর জন্ম দিয়েই আপনি তার কানে কানে প্রতিনিয়ত পরম্পরা মেনে চলার যে গুরুমন্ত্র দিয়ে যাচ্ছেন, সেটা থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। আপনার সন্তান কে তার নিজের মতো করে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করুণ। এমন তো নয় যে, আপনার মগজেই শুধুমাত্র ঘিলু আছে আর আপনার সন্তানটির মগজে রয়েছে আলুভর্তা! তাই বলছি কি- যে অজানা ভুল কে বুকে আগলে রেখে জীবন পার করে দিলেন, সামান্য আর্থিক সুবিধা পেয়ে একটু যৌনতার জন্য ঢ্যাংঢ্যাং করে বিয়ে করে ফেলে ভেবে নিলেন, আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! কিন্তু কয়দিন পরেই তো সেই জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকার নিয়তি। কথায় আছে না, ডাইলের মজা তলে!

যাইহোক, আমি আমার ব্যক্তিগত দর্শনের প্রতি কাউকে প্রলুব্ধ করতে চাই না। যে যার মতো করে ভালো থাকুক। তবে আমার একটাই চাওয়া, তা হলো- ধান মাড়াইয়ের গরুর মতো ট্রেডিশনাল জীবন ছেড়ে সত্যিকারের মানুষ বের হয়ে আসুক। অবশ্য সে যে একজন বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষ, এটা যদি কারো বোঝার ক্ষমতা থাকে, তবেই সে তার চিন্তার স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবে।
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
০৭.০৪.২০২২ খ্রিঃ

'দানে দানে তিন দান'

সেই আশির দশকের সূচনালগ্ন থেকেই নিজস্ব অবস্থান থেকে আমি আমার চোখে পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত নিশ্চলভাবে দেখে যাচ্ছি ...