দক্ষিণপূর্ব ইংল্যান্ডের 'সারে' নামক কাউন্টি শহরে জেমস বোয়েন নামে একজন গৃহহীন মাদকাসক্ত ব্যক্তি বাস করতেন। তার সম্পূর্ণ নাম জেমস অ্যান্থনি বোয়েন। শৈশবে তার বাবা-মায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এবং সেই সময়ে তিনি তার মায়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার ব্যায়বহুল শিক্ষাব্যবস্থা এবং নিজের মনঃসংযোগের ঘাটতির কারণে মাঝপথে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর মাত্র সতেরো বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষনে তিনি আবারও তার জন্মভূমি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ডের সারে রাজ্যে ফিরে তিনি নানান পেশায় যুক্ত হবার চেষ্টা করার পাশাপাশি সঙ্গীতচর্চা শুরু করেছিলেন। চলমান জীবনের নানান খুটিনাটি অসংগতি এবং জটিলতা তার মানসিক শান্তি বিনষ্ট করে দিয়েছিল সেই সময়। ফলশ্রুতিতে তিনি অসৎসঙ্গে জড়িয়ে পড়ে হেরোইনে আসক্ত হয়ে যান। মাদকাসক্ত হবার কারণে তার সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ ছিল না। তিনি মাঝেমধ্যে রাতের বেলা কোন নির্জন পার্কে কিংবা রাস্তার পাশের যাত্রীছাউনিতে ঘুমিয়ে থাকতেন। নানান ধরনের ছোটখাটো কাজ করে এভাবেই একটি মানবেতর জীবন কেটে যাচ্ছিল জেমস বোয়েনের।
২০০৭ সালের এক সন্ধ্যা বেলায় নির্জন একটি রাস্তা দিয়ে আপনমনে গানের সুর ভাজতে ভাজতে জেমস বোয়েন তার বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তিনি রাস্তার পাশে একটি বিড়াল কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলেন। তিনি স্বাভাবিক ভাবে বিড়ালটির পাশ কাটিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। পরদিন যথারীতি তিনি তার নানাবিধ ছোটখাটো কাজ করে সন্ধ্যা বেলায় হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলেন। আর্থিক অনটনের জন্যে ট্যাক্সি ধরার সুযোগ তার ছিল না। তখনও তার ডিনার হয়নি, অথচ পকেটে পড়ে আছে সর্বসাকুল্যে মাত্র কুড়ি পাউন্ড! আনমনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি রাস্তার পাশে তাকালেন এবং গতকালের সেই বিড়ালটিকে আবারও একই জায়গায় বসে থাকতে দেখলেন। এবার তিনি খানিকটা কৌতূহলী হয়ে বিড়ালটির কাছে গিয়ে দেখলেন— ওটার গলায় কোন বেল্ট কিংবা ট্যাগ নেই, বিড়ালটি কিছুটা রুগ্ন এবং ওর মুখে আঁচড়ের দাগ। এসব দেখে জেমস বোয়েনের মন খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি নিজেও একজন গৃহহীন ধরনের রাস্তার মানুষ। তিনি বিড়ালটিকে তুলে নিয়ে আশেপাশের কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে বিড়ালটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— এটা কারো হারিয়ে যাওয়া বিড়াল কিনা, কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিড়ালটির কোন মালিক খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি তখন অসুস্থ বিড়ালটিকে নিয়ে একজন পশু চিকিৎসকের দারস্থ হলেন। চিকিৎসার খরচ বাবদ তিনি তার কাছে থাকা বিশ পাউন্ডের পুরোটাই দিয়ে দিলেন। এরপর বিড়ালটি কিছুটা সুস্থ হলে তিনি বিড়ালটিকে নিয়ে ঠিক সেই জায়গায় হাজির হলেন— যেখানে তিনি বিড়ালটিকে পেয়েছিলেন। তিনি ওটাকে ওখানে ছেড়ে দিলেন, যাতে বিড়ালটি তার ঠিকানায় নিজে নিজে ফিরে যেতে পারে। জেমস বোয়েন ওটাকে রেখে নিজের ঘরের পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন এবং একটা সময় হঠাৎ খেয়াল করলেন যে, বিড়ালটি তার পেছন পেছন হেঁটে আসছে। তিনি তখন বিড়ালটিকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। তিনি বিড়ালটির নাম রাখলেন 'বব'।
জেমস বোয়েন অনেকদিন ধরে মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কেন জানি কোনভাবেই এটা সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ করে এই বিড়ালটিকে নিজের কাছে এনে রাখার পর তার মনে আবারও সুস্থভাবে বাঁচার ইচ্ছে জাগ্রত হলো। তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নেওয়া শুরু করলেন এবং আবারও নিজের মতো করে পুনরায় সঙ্গীতচর্চা শুরু করলেন। দৃঢ়ভাবে মনঃসংযোগ ঘটিয়ে এরপর একটা সময়ে তিনি মাদকদ্রব্যের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেন। এরপর তিনি একটা গীটার নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইতেন এবং বব নামের বিড়ালটি তার পাশে চুপচাপ বসে থাকতো। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে তিনি যে অর্থ উপার্জন করতেন, তাতে তার এবং ববের জীবন মোটামুটি ভাবে চলে যাচ্ছিল। প্রায়ই জেমস বোয়েন কে হাতে গীটার এবং কাঁধে পোষা বিড়াল নিয়ে রাস্তায় চলতে দেখা যেতো। স্থানীয় মানুষদের কাছে আস্তে আস্তে তিনি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন। এভাবেই একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার গান শুনতে আসা একজন শ্রোতা তাকে একটি বই লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন— যিনি ছিলেন একজন প্রকাশক। জেমস বোয়েন সেই প্রকাশকের কথা বিবেচনা করে নিজের জীবন এবং বব নামের বিড়ালটির সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে তার অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে 'এ স্ট্রিট ক্যাট নেমড বব' নামে একটি বই লিখলেন। বইটি ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল এবং বইটি 'বেস্টসেলার বুক' হবার কৃতিত্ব অর্জন করে। পরবর্তী সময়ে এই বইটি নিয়ে একটি সিনেমা তৈরি হয়, যেটা ২০১৬ সালে মুক্তি পেয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে একসাথে থাকার পর ২০২০ সালে বব নামের এই বিড়ালটি রাস্তায় একটি গাড়ির ধাক্কায় মারা যায়। তখন বিড়ালটির বয়স হয়েছিল আনুমানিক পনের বছর।
আমি কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি বিচ্ছিন্ন ছবি দেখে সেটাকে নিজের প্রোফাইলের স্টোরি হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম— যেখানে একজন লোক রাস্তার পাশে গলায় গীটার ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবং তার পায়ের কাছে একটি বিড়াল চুপচাপ বসে ছিল। গতকাল রাতে হঠাৎ কি মনে করে 'স্ট্রিট মিউজিশিয়ান উইথ ক্যাট' লিখে গুগলে সার্চ দেবার পর জেমস বোয়েন সম্পর্কিত তথ্যগুলো জানতে পারলাম। অনেক সময় একটি চতুষ্পদ প্রাণীও যে একজন মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী এবং ভীষণ আপনজন হয়ে উঠতে পারে, তার জলন্ত উদাহরণ হলেন জেমস বোয়েন।
© কৃষ্ণেন্দু দাস ||
১০.০৩.২০২৪ খ্রিঃ