'সহমত ভাই'
হাইস্কুলে পড়ার সময় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা অসাধারণ একটি কবিতা পড়েছিলাম। তখনকার বাংলা পাঠ্যপুস্তকে 'তোষামোদ' বিষয় নিয়ে লিখিত উক্ত কবিতা'টি ছিল নিঃসন্দেহে একজন কিশোর কিংবা কিশোরীর চরিত্র গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাত্ত। কবিতা'র শুরুটা ছিল এইরকমঃ
সাহেব কহেন, “চমৎকার ! সে চমৎকার !”
মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে !
হুজুরের মতে অমত কার ?”
পুরো কবিতা'টি নিশ্চয়ই অনেকেরই পড়া রয়েছে। এই বিশেষ কবিতার মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমস্ত মানুষ কে চাটুকারিতার ঘৃণ্য প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে চেয়েছিলেন। অথচ সচেতনতা তো আদৌ সৃষ্টিই হয়নি, বরং সময়ের আবর্তে সেই ঘৃণ্য বিষয়'টি এখনকার একটি জনপ্রিয় ট্রেন্ড এ রূপান্তরিত হয়েছে! আমাদের প্রচলিত ভাষায় তোষামোদ'কে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমনঃ তেলবাজী, তৈলমর্দন, স্তাবকতা, চাটুকারিতা, মোসাহেবি, চামচাগিরি ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায় যে, তোষামোদ খুবই জঘন্য এবং কলুষিত একটি বিষয়। কারনে বা অকারনে কারও কোন যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও যখন কোন অনৈতিক সুবিধা লাভ করার জন্য যদি কোন মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করা হয়, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রশংসা তোষামোদ বা চাটুকারিতায় রূপান্তরিত হয়। এর প্রভাব সত্যিই অত্যন্ত মারাত্মক। কারণ শুধুমাত্র এই তোষামোদির মাধ্যমে একজন মানুষের নৈতিকতার যতখানি স্খলন ঘটে, অন্যান্য অনৈতিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ততখানি দৃশ্যমান হয়না।
একুশ শতকের আজকের এই আধুনিক সময়ে যখন পৃথিবী ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে উন্নতির সুউচ্চ চূড়ায়, ঠিক সেই সময়েও বৃহৎ সংখ্যক মানুষ নিজের স্বতঃস্ফূর্ত মেধা ও মননের ব্যবহার কে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেকে দূর্বল একটি পোষা প্রাণীর মতোই নিজের প্রভুর মনোরঞ্জনে নিয়োজিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর এই কারণে ক্রমবর্ধমান ভাবে নিজের অজান্তেই তারা সামাজিক স্তরে নিজের অস্তিত্ব কে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে এবং নিজেদের কালিমালিপ্ত চরিত্র কে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে!
আচ্ছা, এত জটিল বিশ্লেষণ থেকে বেরিয়ে এসে বরং একটু সহজ কথায় বলি। আমাদের সমাজব্যবস্থায় কিছু মানুষ রয়েছে যারা সর্বক্ষণ নিজের অবস্থান নিয়ে একধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। নিজেকে কিভাবে চটজলদি 'জাতে' তোলা যায়, এই চিন্তা থেকেই তারা কুলীন শ্রেণীর চারপাশে গিয়ে কুলীনত্ব নিজের গায়ে মেখে নিতে চায়। ঠিক যেভাবে কুৎসিত কাক ময়ূরের পালক ধারণ করে নিজেকে রূপবান আর অভিজাত প্রমাণের চেষ্টা করেছিল! কিন্তু এটা করে নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করার চেয়ে যে হাসির পাত্র হিসেবে প্রমাণ করা হচ্ছে, মুর্খ কাকের মগজে সেই তথ্য কখনও ঢোকেনি। আজকাল ফেসবুক সহ প্রায় সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলে নিশ্চিত ভাবেই এই প্রাচীণ কাকের আধুনিক উত্তরসূরীদের দেখতে পাবেন, যারা গাঁটের পয়সা খুইয়ে সুন্দর সুন্দর জায়গায় গিয়ে দামী ক্যামেরায় ছবি তুলে, আরও দশজন কে ট্যাগ করে নিজের টাইমলাইন ভরিয়ে দিচ্ছে। বাপ-মায়ের ঘাড় ভেঙে একটি দামী ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে গলায় ঝুলিয়ে সোনামুখ করে এরা নিজেদের 'ফটোগ্রাফার' বলে পরিচয় দেয়। যে ছেলেটি শুদ্ধ বানানে একটা প্যারা লিখতে গিয়ে এর ওর প্রোফাইলে হাতা পিতা করে, সে নিজেকে 'রাইটার' হিসেবে পরিচয় দেয়! মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এদের দু'একটা কে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি, পরে ভাবি- না, থাকুক। কী দরকার এদের বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে!
এই পর্যন্ত বিষয়টি মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু যখনই চোখে পড়ে কেউ একজন নিজের পরিচয় হিসাবে পিতৃদত্ত তথ্য এবং নিজস্ব যোগ্যতা কে বাদ দিয়ে কোন একজন রাজনৈতিক কিংবা বিখ্যাত একজন ব্যক্তির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিজেকে হাইলাইট করার চেষ্টা করে! উদাহরণ দিচ্ছিঃ ভাই, আপনি কে? এর উত্তর হলো- 'আমি অমুক ভাইয়ের লোক কিংবা তমুক স্যারের সমর্থক!' এটা আদৌ কি কারো ব্যক্তিগত পরিচিতি হতে পারে? আচ্ছা, বিখ্যাত ব্যক্তির পাশে সেজেগুজে দাঁড়ালে কেউ কি বিখ্যাত হয়? ময়ূরের পাশে দাঁড়ানো কাক কি ময়ূরের মর্যাদা পেয়েছে কখনও?! আমার মনেহয় কোন একজন ক্ষমতাবান মানুষের সাথে ছবি তুলে কেউ যখন সেটা প্রকাশ করে- তখন সে সম্ভবত সমস্ত মানুষকে এটা বলতে চায়, 'দ্যাখো, আমি কতবড় একজন হনু!' এখানে 'হনু' শব্দটি সবচেয়ে যুৎসই, কারণ 'হনুমান' ছিল রামচন্দ্রের অনুগত পোষ্যজীব। রাম যেখানে যেতেন, হনুও তাঁর পিছুপিছু ছুটে যেতো! রামের ক্ষমতার দাপটে হনুও নিজেকে 'হ্যাডাম' মনে করতো। আধুনিক সময়ের এইসব হনু'র সংখ্যাটা আশংকাজনক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুরুতেই যেটা বলতে চেয়েছিলাম- তোষামোদ করতে করতে এইসমস্ত 'হনু'দের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এতো এতো বেশি ত্রুটি দেখা যাচ্ছে যে, আগামী প্রজন্মের মানুষ এগুলো দেখে কি শিক্ষা পাবে সেটা ভেবেই শিহরিত হতে হয়! চার্লস ডারউইন তাঁর বিবর্তনতত্ত্বে বলেছিলেন- বানর থেকে বেরিয়ে এসে কিভাবে হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতিটির উদ্ভব হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে এখন মনেহচ্ছে বিবর্তন হয়তো উল্টো দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো পৃথিবীজুড়ে বিরাট সংখ্যক 'হনুস্যাপিয়েন্স' অর্থাৎ মানুষরূপী এইসব হনুদের দল লম্ফঝম্প করে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নিজেদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করবে!
© কৃষ্ণেন্দু দাস/
০৯.০৯.২০২১ খ্রিঃ